গত ১০ বছরে চারবার নদীভাঙন দেখেছেন মিলন বেপারি। প্রথম ভাঙন দেখেছিলেন ছয় বছর বয়সে। এরপর টানা চারবারের ভাঙনে ভিটামাটি, জমি, পানের বরজসহ সবকিছুই গিলেছে রাক্ষুসে আড়িয়াল খাঁ নদী। সব হারিয়ে অন্যের জমিতে আশ্রয় নেওয়া মিলনের শেষ সম্বলটুকুও এখন ভাঙনের কবলে। শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন, সেই চিন্তায় দিশেহারা তিনি।
বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার আড়িয়াল খাঁ নদীতীরবর্তী মীরগঞ্জ ফেরিঘাট সংলগ্ন লোহালিয়া গ্রামের সুখরঞ্জন বেপারির ছেলে মিলন বেপারি। একসময় যার সবকিছু থাকলেও এখন নিঃস্ব। শুধু মিলন নয়, তার মতো অনেকেই আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙনে হারিয়েছেন বাবা-দাদার ভিটা। মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু হারিয়ে গ্রামছাড়া হয়েছে অসংখ্য পরিবার। রাক্ষুসে আড়িয়াল খাঁর করাল গ্রাসে শেষ চিহ্নটুকুও রক্ষা করতে পারেনি তারা।
নদীভাঙন এলাকার মানুষের দাবি—দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর ধরেই চলছে আড়িয়াল খাঁ এবং পার্শ্ববর্তী সন্ধ্যা নদীর ভাঙন। যার ধারাবাহিকতা চলছে এখনো। সম্প্রতি বর্ষা মৌসুমের শুরুতে ভাঙনের তীব্রতা আরও বেড়ে যায়। গত এক মাসে উপজেলার মীরগঞ্জ, লোহালিয়া, কেদারপুর, জাহাঙ্গীরনগর, দেহেরগতি এবং পার্শ্ববর্তী উজিরপুর উপজেলার দোয়ারিকা-শিকারপুর এলাকায়র অসংখ্য বসতঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ফসলি জমি ও গাছপালা বিলীন হয়েছে আড়িয়াল খাঁ এবং সন্ধ্যা নদীতে।
সবশেষ গত ২৫ জুলাই রাতে আকস্মিক ভাঙনে সন্ধ্যা নদীতে বিলীন গেছে বাবুগঞ্জের জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের দক্ষিণ চর হোগল পাতিয়া গ্রামের মজিদ বেপারি, আজিদ বেপারি, সালেক বেপারি ও বারেক বেপারির বসতঘর। এখনো ভাঙন চলছে আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরবর্তী রহমতপুর ইউনিয়নের লোহালিয়া গ্রামে।
রোববার দুপুরে সরেজমিন লোহালিয়া গ্রামে দেখা যায়, আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙন চলছে। নদীর তীরের বসতঘরগুলো ভেঙে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কেউ কেউ আশ্রয় নিয়েছেন স্বজনদের বাড়িতে, আবার কেউ দিনে খোলা আকাশের নিচে এবং রাতে আশ্রয় খুঁজছেন প্রতিবেশীদের বাড়িতে।
আলাপকালে লোহালিয়া গ্রামের বাসিন্দা সুফিয়া বেগম জানান, আগে তারা আড়িয়াল খাঁ নদীর ওপারে থাকতেন। গত ১০ বছরে ওপারে তাদের বসতঘর দুই দফা নদীভাঙনে গেছে। পরে পরিবার নিয়ে এপারে লোহালিয়া গ্রামে অন্যের জমিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এখন ভাঙনে সেই ঘরটাও বিলীনের পথে। তাই ঘর ভেঙে অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। মালপত্র নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন গ্রামের প্রতিবেশীদের বাড়িতে।
একই কথা উপজেলার সিংহেরকাঠি গ্রামের বাসিন্দা মো. শাহীনের। তিনি বলেন, দফায় দফায় ভাঙনের কবলে পড়ছি। ভাঙনের কারণে এক গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে আশ্রয় নিচ্ছি। অথচ ভাঙন রোধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না সরকার। সরকার আসে সরকার যায়, কিন্তু আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না। আমরা টাকা চাই না, ত্রাণ চাই না। সরকারের কাছে আমাদের দাবি একটাই—যাতে আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরে ভাঙন রোধে টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এর আগে মীরগঞ্জ ফেরিঘাট থেকে লোহালিয়া গ্রাম হয়ে চাঁদপাশা পর্যন্ত আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরে বেড়িবাঁধ ছিল। গত ১০ বছরে বেড়িবাঁধ ভেঙে নদীতে বিলীন হয়েছে। এখন যাতায়াতের রাস্তাও নেই। স্থানীয়দের উদ্যোগে নদীর তীরে বিশাল এক সাঁকো বানিয়ে তা দিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থী এবং বয়স্ক মানুষ এ সাঁকো দিয়ে চলতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। এখানে জরুরি ভিত্তিতে একটি বেড়িবাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি ভাঙন রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ড উদ্যোগ না নিলে লোহালিয়া, সিংহেরকাঠিসহ আশপাশের গ্রাম আড়িয়াল খাঁ নদীতে বিলীন হয়ে যাবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
তা ছাড়া আড়িয়াল খাঁ ও সন্ধ্যা নদীর ভাঙনের আতঙ্কে রয়েছে অনেক বসতঘর, ফসলি জমি, গাছপালা, রাস্তাঘাট, মসজিদ-মাদ্রাসা এবং একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তাই ভাঙন রোধে দ্রুত টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি ভাঙনকবলিত মানুষের।
বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিব হোসেন জানান, আড়িয়াল খাঁ এবং সন্ধ্যা নদীর ভাঙনের বিষয়টি তারা অবগত। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। বরাদ্দ পেলে প্রাথমিকভাবে ভাঙন রক্ষার কাজ করা যাবে। তবে নদীভাঙন রোধে টেকসই বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রকল্প গ্রহণের কথাও জানান তিনি।
মন্তব্য করুন