পদ্মার ভাঙনে নিঃশেষ হওয়া একটি জীবনের নাম শিরিনা বেগম। সাত দশকের বেশি সময় পেরিয়ে আসা এই নারী এক দিনও নিজের জন্য কিছু চাইতে শেখেননি—শুধু বেঁচে থাকার লড়াই করে গেছেন। কিন্তু আজ সেই লড়াইয়ের সব অস্ত্রও পদ্মার গহ্বরে হারিয়ে গেছে। এখন তার একমাত্র সম্বল—কয়েক টুকরো পরিত্যক্ত ছেঁড়া জিও ব্যাগ।
শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা ইউনিয়নের মাঝিরঘাট জিরোপয়েন্ট এলাকায় ঘুরে এ দৃশ্য চোখে পড়ে।
শিরিনা থাকেন শরীয়তপুরের জাজিরার মাঝিরঘাট এলাকায়। যেখানে বিগত কয়েক দফার ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে গেছে শতাধিক পরিবার। নেই খাদ্য, নেই কাপড়চোপড়, নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই। কারও কারও কপালে জোটেনি একটুকরো চট বা বস্তাও।
জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা এলাকায় পদ্মা সেতুর দক্ষিণ প্রান্ত নির্মাণ করা হয়েছে। এই এলাকার পদ্মা নদীর তীরবর্তী স্থানে রয়েছে পদ্মা সেনানিবাস, জাজিরা ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো।
২০১২ সালে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ নদীভাঙনের হাত থেকে এসব অবকাঠামো রক্ষায় প্রায় ১১০ কোটি টাকা ব্যয়ে দুই কিলোমিটার দীর্ঘ তীররক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে। কিন্তু নদীর স্রোতের পরিবর্তিত গতিপথ বাঁধের দিকে চলে যাওয়ায় পুরো বাঁধটি ঝুঁকির মুখে পড়ে, যা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সমীক্ষায় স্পষ্ট হয়েছে।
গত বছরের নভেম্বর থেকে ওই বাঁধের নাওডোবা জিরো পয়েন্ট এলাকায় প্রথমবারের মতো ভাঙন শুরু হয় এবং বাঁধের শত মিটার অংশ নদীতে বিলীন হয়। এরপর চলতি বছরের ৭ জুন, ৭ জুলাই, ৯ জুলাই, ২৩ জুলাই ও ৩১ জুলাইয়ে কয়েক দফায় ভাঙনের কারণে বাঁধের অন্তত ৭৫০ মিটার অংশ নদীতে বিলীন হয়ে যায়। এই ভাঙনের ফলে আলম খাঁরকান্দি, ওছিম উদ্দিন মাদবরকান্দি, উকিল উদ্দিন মুন্সিকান্দি ও মাঝিরঘাট এলাকার অন্তত ৫০টি বাড়ি ও ৩০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নদীতে বিলীন হয়।
পাশাপাশি, ভাঙনের আতঙ্কে শতাধিক পরিবার ঘরবাড়ি ত্যাগ করেছে। বর্তমানে ভাঙনের প্রবণতা বাড়ায় প্রায় ৬০০ পরিবার ও মাঝিরঘাট বাজারের ২০০টিরও বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙন প্রতিরোধে অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ও জিও টিউব ডাম্পিং করছে। এ পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে, যার জন্য খরচ হয়েছে প্রায় ৫ কোটি টাকা। তবে নদীর প্রবল স্রোতের কারণে এসব চেষ্টা কার্যকর হয়নি এবং জিও ব্যাগসহ নদীর তীর আরও ১৫০ মিটার ভেতরে সরে গেছে।
পদ্মা সেতুর দক্ষিণ প্রান্ত ও তার আশপাশে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা গড়ে ওঠার পর থেকেই নদীর গতিপথ বদলে স্রোত ধেয়ে আসে তীররক্ষা বাঁধের দিকে। পানি উন্নয়ন বোর্ডও সেই ঝুঁকির কথা জানিয়েছিল আগে থেকেই; কিন্তু তাতে থেমে থাকেনি বিপর্যয়।
গত বছর নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া ভাঙনে এবার জুলাইয়ে এসে বাঁধটির আরও ৭৫০ মিটার নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এর প্রভাবে মাঝিরঘাটসহ অন্তত চারটি এলাকায় প্রায় ৫০টি বাড়িঘর ও ৩০টির বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পদ্মায় হারিয়ে গেছে। আতঙ্কে ঘর সরাতে বাধ্য হয়েছে আরও শতাধিক পরিবার। জমি, ঘর, দোকান হারিয়ে এখন অনেকে একেবারে পথে বসেছেন।
শিরিনা বেগম বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবা-মা মারা গেছে, পরে স্বামীরে হারাইছি। কষ্ট কইরা একটা ঘর তুলছিলাম—সেটাও চোখের সামনে নদীতে গেল। এখন ছিঁড়া কয়ডা বস্তা কইরা লইছি, রাতে শুইতে তো হইবো… সরকার যদি না দেখে, তাইলে মইরা যাওন ছাড়া আমার কোনো উপায় নাই।’
ভুক্তভোগী তাহাজ্জুদ আলী বলেন, ‘কয়ডা কাঠ আর টিন রক্ষা করছি, কিন্তু রাখুম কই? রাস্তার ধারে ফালাইয়া রাখছি। বৃষ্টি আসলে রাইতে বাচ্চাগো নিয়া ভিজা ছাড়া উপায় থাকব না।’
আলম খাঁরকান্দি এলাকার বাসিন্দা হনুফা বেগম (৭০) দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এ পর্যন্ত ৮ বার ভাঙনের শিকার হয়েছেন। সম্প্রতি ভাঙনে মসজিদের পাশে থাকা তার বসতবাড়িটি বিলীন হয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘আমাগো আর কোনো অবস্থা নাই। এই পর্যন্ত আটবার নদীতে সব নিয়া গেছে। অহন এই বাড়িডাও নিয়া গেল। কই যামু কি করমু জানি না।’
মাঝিরঘাট এলাকার বাসিন্দা সোনিয়া আক্তার বলেন, ‘তিনটা ঘরের একটাও রাখতে পারি নাই। খাবার নাই, রান্নার কিছু নাই। পোলাপাইনডারে কি খাওয়াম, কই থাকমু—এই চিন্তায় মাথা পাগল হইয়া যায়।’
ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে মাঝিরঘাট বাজারের আরও ২০০টির বেশি দোকান। পানির তোড়ে জিও ব্যাগ ফেলার কাজ চালালেও তেমন ফল মেলেনি। এ পর্যন্ত ১ লাখ ২০ হাজার জিও ব্যাগ ফেলতে খরচ হয়েছে ৫ কোটি টাকা; কিন্তু সেগুলোও নদীর সঙ্গে টিকতে পারেনি।
শরীয়তপুর জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মাদ তারেক হাসান জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ড বেশ কিছু চেষ্টা চালিয়েও নদীভাঙন রোধে সম্পূর্ণ সফল হতে পারেনি। তিনি বলেন, আমরা আপৎকালীন ভিত্তিতে ভাঙন রোধের কাজ করছি, তবে পদ্মা নদীর প্রবল স্রোত ও ভাঙন থামানো একপ্রকার অসম্ভব। ভাঙন রোধের একমাত্র কার্যকর উপায় হিসেবে তিনি স্থায়ী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণের গুরুত্বের কথা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, এই স্থায়ী প্রকল্পের প্রস্তাবনা এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন মিললে দ্রুত প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।
অন্যদিকে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর তালিকা তৈরি করে দ্রুত খাদ্য সহায়তা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করার কথা জানিয়েছেন শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক তাহসিনা বেগম। তিনি জানান, জাজিরার বিভিন্ন এলাকায় কোথায় কোথায় খাস জমি রয়েছে তা খুঁজে বের করার নির্দেশ উপজেলা প্রশাসনকে দেওয়া হয়েছে। যারা নদীর তীরে সবকিছু হারিয়েছেন তাদের তালিকা প্রস্তুত করে সেসব জায়গায় দেওয়া হবে। আর যাদের জমি থাকলেও ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের জন্যও টিনের ছাউনি ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।
মন্তব্য করুন