তিস্তা নদী থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে এক সময়ের জনপ্রিয় ও সুস্বাদু দেশি মাছ বৈরালি। কয়েক দশক আগেও উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোতে প্রচুর বৈরালি ধরা পড়ত; কিন্তু এখন তা বিরল দৃশ্য। বাজারে যা অল্প আসে, তার দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ভারতের অভ্যন্তরে তিস্তার ওপর নির্মিত একাধিক বাঁধ পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত করছে। ফলে নদীর বুক জুড়ে জেগে উঠছে চর, পানির গভীরতা কমছে, আর এতে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে বৈরালি মাছকে। শুধু বৈরালি নয়, তিস্তার দেশীয় নানা প্রজাতির মাছও দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। নদীতে একসময় প্রচুর দেখা যেত শুশুক, ঘড়িয়াল ও মিঠাপানির কচ্ছপ; এখন সেগুলো প্রায় বিলুপ্ত।
স্থানীয়ভাবে ‘বৈরালি’ নামে পরিচিত এ মাছকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বলা হয় ‘বোরালি’। স্বচ্ছ ও স্রোতস্বিনী পানির মাছ হিসেবে বৈরালি মূলত তিস্তা, ধরলা ও আংশিক ব্রহ্মপুত্র নদীতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে এর বিস্তার সীমিত লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও কুড়িগ্রাম জেলায়। এ ছাড়া ভারত, নেপাল ও মিয়ানমারের পাহাড়ি নদীতেও এ মাছের দেখা মেলে।
আকারে ছোট হলেও স্বাদে অনন্য বৈরালি মাছের গড় দৈর্ঘ্য ৬-৭ ইঞ্চি। রুপালি গায়ে হালকা মেটে পিঠ ও হলুদাভ পেট, আর পুঁটি মাছের মতো কাঁটা থাকলেও তা নরম হওয়ায় খেতে সুবিধা হয়। জুন থেকে আগস্ট প্রজনন মৌসুম, তবে মে মাসের শেষ থেকেই ডিম ছাড়তে শুরু করে। বর্ষার বন্যা ও স্রোত এদের প্রজননে সহায়ক ভূমিকা রাখে। বৈরালির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো—ইলিশের মতো ঝাঁক বেঁধে উজান মুখে দ্রুত সাঁতার কাটা। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত নদীর ধারে এদের চলাচল বেশি থাকে।
নদীপাড়ের বাসিন্দা হাসেম আলী বলেন, আগে অতিথি এলে বৈরালি মাছ রান্না করে আপ্যায়ন করতাম। এখন বাজারে খুঁজেও পাওয়া যায় না। ব্যারাজ এলাকায় কিছু মাছ পাওয়া গেলেও দাম এত বেশি যে সাধারণ মানুষ কিনতে পারে না। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকে এ মাছ কিনতে আসে, ফলে দামে আরও আগুন লেগে যায়।
তিস্তা ব্যারাজ এলাকার জেলে লোকমান হোসেন বলেন, আগের মতো মাছ আর পাওয়া যায় না। শীতে নদী শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে যায়, বর্ষায় পানি আসে কিন্তু মাছ থাকে না। সারাদিন জাল টেনে যে অল্প মাছ পাই, তা বিক্রি করে সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
উপজেলার গয়াবাড়ি ইউনিয়নের শুটিবাড়ি হাটের স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ী আমির আলী বলেন, বৈরালির চাহিদা অনেক, কিন্তু নদীতে মাছ নেই। যা পাই ৫০০-৬০০ টাকা কেজি বিক্রি করেও চাহিদা মেটানো যায় না। আগে তিস্তা থেকে আইড়, বোয়ালসহ বড় বড় মাছও পাওয়া যেত। এখন সেগুলো নেই বললেই চলে।
ক্রেতাদের অভিযোগ, পুকুরে চাষ করা মাছ নদীর পাড়ে এনে ‘তিস্তার মাছ’ নামে বিক্রি করা হয়, যা আসল বৈরালি নয়।
নদী সুরক্ষা আন্দোলন ও রিভারাইন পিপল নীলফামারী জেলা আহ্বায়ক আব্দুল ওদূদ বলেন, আশির দশকেও তিস্তা নদীতে প্রচুর জলজ প্রাণী ছিল। বর্তমানে পানির প্রবাহ ব্যাহত ও দূষণের কারণে সেগুলো প্রায় বিলুপ্তপ্রায়। তিস্তার ন্যায্য পানির হিস্যা আদায় ও ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ বাস্তবায়নই একমাত্র সমাধান।
ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইমরানুজ্জামান জানান, তিস্তার পানি সংকট একটি বাস্তব সমস্যা। আমরা স্থানীয় জেলেদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা সীমিতকরণ এবং বিকল্প জীবিকায় সহায়তার পরিকল্পনা করছি।
নীলফামারীর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবু সাইদ বলেন, আমরা বিষয়টি জানি। বৈরালির প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা বন্ধ করা গেলে এ প্রজাতি সংরক্ষণে সুফল পাওয়া যাবে।
মন্তব্য করুন