ঢাকের শেষ আওয়াজ মিলিয়ে গেছে দুদিন আগেই। তবু পুকুরের জলে ভেসে বেড়ায় সেই সুরের প্রতিধ্বনি। কচুরিপানায় ঢেকে যাওয়া পুকুরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক কাঠের মঞ্চ। বৃষ্টিতে নীল ত্রিপল খানিকটা উড়ে গেছে, কিন্তু আলো-আঁধারিতে সেটিই যেন উৎসবের এক নতুন প্রতীক।
শুক্লপক্ষের চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে চারদিক। বাতাসে ধূপের গন্ধ, মঞ্চের চারপাশে তরুণদের ব্যস্ততা। কারও হাতে মাইক, কারও হাতে সাজসজ্জার তার। দেবী গেছেন, কিন্তু পূজার মায়া এখনো কাটেনি। বরং উৎসবের গল্প এগিয়ে চলেছে নতুন অধ্যায়ে। এই দৃশ্য চট্টগ্রামের দক্ষিণ পাহাড়তলীর আমান বাজার এলাকার রেবতী মহাজন বাড়ির।
এখানেই শনিবার (৪ অক্টোবর) সন্ধ্যা থেকে বসেছে ব্যতিক্রমী আয়োজন ‘বিজয়া সম্মিলনী’।
এর আয়োজক ‘পরিবর্তন সার্বজনীন দূর্গাপূজা উদযাপন পরিষদ’, আর মঞ্চে গান পরিবেশন করে বাংলাদেশের প্রথম সনাতনী রক ব্যান্ড ‘প্রণাম’। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি মেয়র শাহাদাত হোসেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন সমাজসেবক ও রাজনীতিবিদ সৈয়দ নেছার উদ্দিন বুলু। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ট্রাস্টি দীপক কুমার পালিত।
পরিবর্তন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জে এস জিশুর ভাষায়, এটি কেবল একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নয়, বরং উৎসব-পরবর্তী পুনর্মিলনের মধ্য দিয়ে ভ্রাতৃত্ব, আনন্দ ও সংস্কৃতির বন্ধনকে আরও দৃঢ় করার প্রয়াস।
শতবর্ষের অন্ধকার ভাঙার গল্প: রেবতী মহাজন বাড়ি চট্টগ্রামের সনাতনী ইতিহাসে এক বিশেষ নাম। ব্রিটিশ আমল থেকে এই বাড়িতে কখনো হয়নি দুর্গাপূজা। অথচ দেড় শতাধিক সনাতনী পরিবারের বসবাস এখানে। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক ঐক্যে পিছিয়ে থাকা এই এলাকায় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে সম্পর্ক ভেঙেছে বারবার। বিভাজনে ডুবে থাকা মানুষ একসময় বিশ্বাসই হারিয়ে ফেলেছিল এখানে কখনো পূজা হতে পারে না।
এই অন্ধকার ভাঙতে এগিয়ে আসেন স্থানীয় তরুণ আয়ান শর্মা। তিনি স্থানীয় দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনের উপদেষ্টা সম্পাদক ও প্রকাশক, শ্রীশ্রী জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যকরী সভাপতি এবং পরিবর্তন সামাজিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
মাত্র ১৮ জন বাড়ির মানুষকে নিয়ে ২০১৩ সালে গড়ে তোলেন সংগঠনটি। স্লোগান ছিল, ‘ইতিবাচক পরিবর্তনের অঙ্গীকার’। দরিদ্র পরিবারের কন্যার বিয়ের সহায়তা, অসহায়দের পাশে থাকা, সাংস্কৃতিক কর্মসূচি— এভাবেই ধীরে ধীরে ভাঙতে থাকে অবিশ্বাসের দেয়াল।
আয়ান শর্মা বলেন, আমি সবসময়ই ভেবেছি পরিবর্তন আসবে ভেতর থেকে। আমরা যদি নিজেদের ভেদাভেদ ভুলে এক হই, তবে অসম্ভব কিছু নেই। পূজা শুধু ধর্মীয় আচার নয়; এটি সংস্কৃতি, ঐক্য আর আত্মপরিচয়ের প্রতীক।
মন্তব্য করুন