দেশের অনেক স্থানে বধ্যভূমির সংখ্যা থাকলেও চুয়াডাঙ্গা জেলায় বধ্যভূমির সংখ্যা যেন একটু বেশিই। যুদ্ধকালীন গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে আগুন ধরিয়ে এবং নির্বিচারে মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের পেছনে, নাটুদহের স্কুলের পেছনে, জীবননগরের ধোপাখালী গণকবর, মদনার হৈবৎপুর গ্রামে পাঁচকবর, নাটুদহের আটকবর, আলমডাঙ্গার লালব্রিজ সংলগ্ন বধ্যভূমি মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি বহন করে চলেছে।
চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গায় বধ্যভূমি ১৯৭১ সালের গণহত্যার নিদর্শন। আলমডাঙ্গার কুমার নদের ওপর লালব্রিজের দুপাশে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প। রেললাইনে খুলনাগামী ডাউনে অর্থাৎ লালব্রিজের আলমডাঙ্গার পাশে একটি ও নদের অপর পাড়ে কুষ্টিয়ার দিকে কালিদাসপুরে আরেকটি ক্যাম্প ছিল। আপের দিকে আসা ট্রেন লালব্রিজের আলমডাঙ্গা মাথায় দাঁড় করাত পাক বাহিনী।
অন্যদিকে, যাওয়া ট্রেন লালব্রিজের কালিদাসপুর প্রান্তে দাঁড় করিয়ে নিরপরাধ যাত্রীদের ধরে ধরে নিয়ে যেত। অকথ্য নির্যাতন শেষে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশ এ বধ্যভূমিতে ফেলে রাখত। মুক্তিযুদ্ধকালীন পাক ঘাতকরা ট্রেন থামিয়ে স্বাধীনতাকামী প্রায় ২ হাজার নারী-পুরুষ হত্যা করে রেলব্রিজের পাশে ওয়াপদা ভবনের বাউন্ডারির মধ্যে ও পার্শ্ববর্তী দুটি বধ্যভূমিতে ফেলে রাখে। এ গণহত্যার প্রধান হোতা ছিলেন মেজর রানা, মেজর আজম খান, ক্যাপ্টেন নকডি ও হাবিলদার এনায়েত।
এই লালব্রিজ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও বাঙালি নর-নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতনের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের জুন থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত নারকীয় নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। সেই সময় এখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের হলুদ খালাসি ঘর ছিল। এ কক্ষেই স্বাধীনতাকামী যুবক, নারী-পুরুষকে নির্যাতন করে হত্যা করা হতো। সে স্মৃতি স্মরণ রেখে চুয়াডাঙ্গা ১ আসনের এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান ছেলুনের নেতৃত্বে এখানে বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ ও কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়। টর্চার সেল নামক সেই হলুদ কক্ষটি ঘিরে এখন বধ্যভূমির স্তম্ভ বা কমপ্লেক্স।
প্রতিদিন দর্শনার্থীরা আলমডাঙ্গা রেলস্টেশনের লালব্রিজের কাছের এ বধ্যভূমিতে আসেন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্থানি ও রাজাকারদের নারকীয় তাণ্ডবের ধ্বংসলীলা দেখে যান। ২০০৯ সালে পাকবাহিনীর বাঙালি জাতির ওপর জঘন্যতম এ নির্যাতনের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে আলমডাঙ্গা বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও বাস্তবায়ন কমিটি বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ২০১২ সালে নির্মাণ করা হয় এ স্মৃতিস্তম্ভ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ বধ্যভূমির গর্তে পাওয়া গেছে শত শত মাথার খুলি ও হাড়।
স্মৃতিস্তম্ভের দেয়ালে নানা ধরনের ভাস্কর্য। সামনের সবুজ ঘাসের আঙিনায় রয়েছে শহীদদের ভাস্কর্য, মিউজিয়ামের ভেতরে আছে আরও কিছু ভাস্কর্য। এ ছাড়া ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাঙালির ধারাবাহিক মুক্তি সংগ্রামের সচিত্র ছবিও কমপ্লেক্সে পাওয়া যাবে।
মন্তব্য করুন