শীতে খেজুরের রসের পাশাপাশি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আরেকটা জিনিস সবাইকে আকৃষ্ট করে তা হলো দারুণ সুস্বাদু আখের রসে তৈরি গুড়। এ গুড় ঘন তরল। স্থানীয়ভাবে একে বলা হয় লালি। এ লালি দিয়ে ঘরে ঘরে তৈরি পিঠাপুলি শীতের খাদ্য তালিকাকে ভিন্নমাত্রায় নিয়ে যায়।
জেলার বিজয়নগর উপজেলার বিষ্ণুপুর, কালাছড়া, দুলালপুর গ্রামে আবাদকৃত আখ মাড়াই করে তৈরি হচ্ছে সুস্বাদু লালি। লালি উৎপাদনের সাথে জড়িতরা জানালেন, একসময় ঘরে ঘরে লালি তৈরি হতো কৃষিনির্ভর এ উপজেলায়। বর্তমানে অন্যান্য ফসল চাষ অধিকতর লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা আখ চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছেন বিজয়নগর উপজেলায় চলতি মৌসুমে ২৫ হেক্টর জমিতে আখের আবাদ হয়েছে।
লালির কদর শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই না, দেশের নানা অঞ্চলে পাইকারদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যানমতে, চলতি শীত মৌসুমে শুধু বিজয়নগর থেকে প্রায় ৭৫.২ টন লালি বিক্রি হবে। যার বাজারমূল্য প্রায় এক কোটি ১২ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
আখের রসে তৈরি এ তরল গুড় দারুণ মুখরোচক, মূলত পিঠাপুলি ও পায়েস তৈরিতেই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় এ গুড়। এ ছাড়া চিড়া-মুড়ির সঙ্গে খেতেও অনন্য এ লালি। শীত মৌসুমেই লালি তৈরি করেন স্থানীয় কৃষক পরিবারগুলো। বছরের চার মাস লালি তৈরি করে বাড়তি টাকা আয় করেন তারা।
সোমবার (১৫ জানুয়ারি) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে লালি তৈরি ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত আখের মৌসুম ধরা হয়। এ সময়টাতেই জেঁকে বসে শীত। এর ফলে এ চার মাস উৎপাদিত আখ থেকে লালি তৈরি করেন স্থানীয়রা। ১০-১২ জন কৃষক লালি উৎপাদনের কাজ করলেও শতাধিক কৃষক আখ চাষের সঙ্গে জড়িত। পারিবারিক বংশপরম্পরায় এ লালি ব্যবসায় জড়িত কৃষকরা। এখনো পরিবারগুলো এ ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। প্রতিদিন অন্তত ১ টন বা এক হাজার কেজি লালি তৈরি হয় সেখানে।
বিজয়নগর উপজেলার বিষ্ণুপুর, কালাছড়া, দুলালপুর গ্রাম ঘুরে দেখা যায় কৃষকরা মহিষ দিয়ে আখ মাড়াইয়ের কাজ করছেন। দিনভর আখ মাড়াইয়ের মাধ্যমে রস সংগ্রহের পর রাতে সেই রস চুলায় জ্বাল দেওয়া হয়। প্রায় তিন ঘণ্টারও বেশি সময় জ্বাল দেওয়ার পর তৈরি হয় সুস্বাদু লালি। এখনো প্রাচীন পদ্ধতিতে মহিষ দিয়ে মাড়াই করে আখের রস সংগ্রহ করা হয়। প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে লালি তৈরির কাজ। প্রতি কেজি লালি পাইকারদের কাছে বিক্রি হয় ১২০ থেকে ১৩০ টাকা দরে। আর খুচরা বিক্রি হয় ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায়।
জেলার কৃষি বিভাগ কালবেলাকে জানিয়েছে, এক সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রচুর জমিতে আখের চাষ হতো। কিন্তু অন্যান্য ফসল চাষ অধিকতর লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা আখ চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। তারপরও চলতি মৌসুমে জেলার বিজয়নগর উপজেলায় ২৫ হেক্টর জমিতে আখের চাষ হয়েছে। আর এসব জমিতে ২ হাজার ৭০০ টন আখ উৎপাদন হবে।
বিজয়নগর উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের কৃষক মো. রাজিব মুল্লা কালবেলাকে জানান, ১০ বিঘা জমিতে আখ চাষ করেছেন তিনি। তিনি বলেন প্রতি বিঘ জমিতে যে আখ হয় তা থেকে লালি তৈরি হয় ৪০০ কেজি। যা তিনি বিক্রি করতে পারবেন ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। এতে সব খরচ বাদ দিয়ে তার লাভ হবে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা।
মো. আলী নামে আরেক কৃষক বলেন, আগে বাজারে নিয়ে লালি বিক্রি করতে হতো। এখন বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আর পাইকাররা বাড়িতে এসে লালি কিনে নিয়ে যান। এ বছর লালি বিক্রি করে আমার এক লাখ টাকার মতো লাভ হবে। প্রতি বছর শীতের সময়টাতে লালির ব্যবসা করে ভালো টাকা আয় হয়। এতে করে পরিবারের অভাব-অনটন দূর হয়।
ইদ্রিস মোল্লা নামে গ্রামের প্রবীণ এক ব্যক্তি জানান, কৃষকরা এখন জমিতে অন্য ফসল চাষের কারণে আখ চাষ কমে গেছে। কিছু কৃষক পরিবার পূর্ব-পুরুষদের ব্যবসা ধরে রাখতে লালি তৈরির জন্য আখ চাষ করেন। প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে কৃষকরা আখ চাষেও আগ্রহী হয়ে উঠবে বলে মনে করেন তিনি।
এ ব্যাপারে জেলা কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সুশান্ত সাহা, বলেন, আমরা আশা করছি এবারের মৌসুমে বিজয়নগরে এক কোটি ১২ লাখ ৮০ হাজার টাকার লালি বিক্রি হবে। আগে প্রচুর পরিমাণে লালি তৈরি হতো এ উপজেলায়। কিন্তু এখন কৃষকরা জমিতে ধানের পাশাপাশি বিভিন্ন লাভজনক ফসল চাষ করছেন। যার জন্য আখ চাষ কমিয়ে দিয়েছেন তারা। এতে করে লালিও কম তৈরি হচ্ছে। এখনও কিছু কৃষক ঐতিহ্য হিসেবে আখ চাষ করছেন। প্রয়োজনীয় ঋণ সহায়তাসহ নতুন জাত ও প্রযুক্তির সম্প্রসারণের মাধ্যমে আখ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করার কথা জানালেন জেলার কৃষি বিভাগের এ কর্মকর্তা। ইক্ষুর আধুনিক জাতের মাধ্যমে আখ চাষ বাড়ানোর মাধ্যমে লালি উৎপাদন আরও বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। আবাদের লক্ষমাত্রা স্থিতিশীল হলেও পরিমাণ কীভাবে বাড়ানো যায় সে ব্যাপারে জেলা কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তর কাজ করছে বলেও জানান তিনি।
মন্তব্য করুন