চট্টগ্রামে সোর্সের নানা ধরনের তথ্যের কারণে পুলিশের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগে নিরপরাধীকে অপরাধী সাজানো, ভুল তথ্যে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের হয়রানি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সখ্য ইত্যাদি।
অন্যদিকে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের অপকর্মের দায় পুরো পুলিশ বাহিনী নেবে না। এখানে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অজান্তে কৌশলে কিছু পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যরা অপকর্মে জড়াচ্ছেন। পুলিশের সোর্সদের বিষয়ে চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশের ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীলরা কঠোর বার্তা নিয়ে মাঠে তৎপর বলেও জানান সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ১৯ মে চট্টগ্রাম নগীরর আখতারুজ্জামন ফ্লাইওভারের উপরে লোহাগাড়ার বাসিন্দা প্রবাসী আব্দুল মালেকের কাছ থেকে ১৭ ভরি সোনা ছিনতাইয়ের ঘটনায় পুলিশের এসআই আমিনুল ইসলাম ও সোর্স মো. জাহেদ জনতার হাতে আটক হন। পরে তাদের খুলশী মডেল থানার পুলিশের কাছে সোপর্দ করে স্থানীয়রা। এ ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠে চট্টগ্রামে।
ভুক্তভোগী প্রবাসী আব্দুল মালেক বলেন, গত ১২ মে সৌদি আরব থেকে দেশে আসি। এরপর ফেলে আসা ৮টি সোনার চুড়ি নিকট আত্মীয়কে দিয়ে বৈধ কাগজের মাধ্যমে দেশে আনা হয়। এরপর আমার নিকট আত্মীয় আব্দুল মালেক নগরীর টাইগারপাস এলাকায় সিটি বাস বদল করে আরেকটি বাসে ওঠার সময় এসআই আমিনুল ইসলাম তাকে পুলিশ পরিচয় দিয়ে তার কাছে সোনা আছে কিনা জিজ্ঞাসা করেন। পরে তার কাছ থেকে এসআই আমিনুলের হাতে ৮টি চুড়ি তুলে দেন। এ সময় কেনার সেই রসিদও দেখানো হয়েছিল।
তিনি বলেন, এসআই আমিনুল চুড়িগুলো হাতে নিয়ে আব্দুল মালেককে থানায় যেতে বলে। তখন সে যেতে রাজি হলে পুলিশ গড়িমসি শুরু করে। এ সময় এসআই আমিনুল বলেন, এখানে ৮টি চুড়ি নয়, দুটি চুড়ি আছে। এ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে তর্কে জড়ার প্রবাসী মালেক। তিনি এসআইকে বারবার তাকে থানায় নিয়ে যেতে চাইলেও তিনি গাড়ি আসছে বলে অপেক্ষায় রাখেন। পরে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় আব্দুল মালেককে নিয়ে আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের ওপরে নিয়ে সিএনজি চালককে দুই হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে চলে যেতে বলেন। পরে মালেককে ফ্লাইওভার থেকে ফেলে দেওয়ার জন্য ধাক্কা মেরে পালানোর সময় প্রবাসী চোর বলে চিৎকার দেয়। পরে স্থানীয় জনতা আমিনুল ও তার সোর্স জাহেদকে ধরে ফেলে। পরে পাঁচলাইশ থানা পুলিশের কাছে তাদের দুজনকে সোপর্দ করে স্থানীয়রা।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) মোখলেছুর রহমান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানিয়েছিলেন, পাঁচলাইশ থানা পুলিশ তাদের আটক করলেও ঘটনার স্থান খুলশী থানা এলাকা হওয়াতে তাদের খুলশী থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। আটক এসআই আমিনুল ইসলামও খুলশী থানায় কর্মরত। তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলা প্রক্রিয়াধীন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকেই বলছেন, সোর্সের মিথ্যা তথ্যে কিছু কিছু অসাধু পুলিশ সদস্যের অপকর্মের ঘটনাগুলো পুরো পুলিশ বাহিনীর ওপর পড়ছে। নগরীর সবকটি থানায় কোনো না কোনো পুলিশ সদস্য অপকর্ম করে যাচ্ছে। এসব করার পর সোর্সকে বলি দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও অপকর্মের পর পুলিশ সদস্যদের সাময়িক বরখাস্তসহ বিভাগীয় মামলা দায়ের হয়। কিন্তু স্থায়ী বরখাস্ত তেমন হয় না। ফলে অপরাধ বেড়েই চলছে।
পুলিশে অপকর্মে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে কিনা- জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (উত্তর) মোখলেছুর রহমান কালবেলাকে বলেন, অপরাধীকে আমরা অপরাধী হিসেবেই দেখি। রোববারের ঘটনায় আমরা আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে যা যা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তা নিয়েছি। তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি নগরীর বায়েজিদ থানার থানার গুলাবাগ আবাসিক এলাকায় অভিযান চালিয়ে জুয়া খেলার অভিযোগে আবু বক্কর ছিদ্দিকী ও ফয়জুল আমিন নাম দুইজনকে গ্রেপ্তার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ (উত্তর)। প্রেপ্তারের পর আবু বক্কর ছিদ্দিকীর মোবাইল থেকে কোটি টাকা বিট কয়েন সরিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে নগর গোয়েন্দা (উত্তর) পুলিশের ছয় সদস্যের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত ছয় পুলিশ সদস্য বরখাস্ত হয়েছেন। পরে সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় বরখাস্তের আদেশ দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়েরের নির্দেশ দিয়েছেন। এ সময় বরখাস্তরা হলেন, সিএমপি উত্তর জোনের এসআই আলমগীর হোসেন, এএসআই বাবুল মিয়া, মো. শাহ পরাণ জান্নাত, মঈনুল হোসেন, কনস্টেবল জাহিদুর রহমান ও আব্দুর মান্নান।
তখন আবু বক্কর অভিযোগ করে বলেছিলেন, তাকে গ্রেপ্তারের পর মনসুরবাদ ডিবি কার্যালয়ে আটক রাখা হয়েছিল। সেখানে তার মোবাইলে ‘বাইন্যান্স অ্যাপ’ ব্যবহার করে ২ লাখ ৭৭ হাজার ডলারের কিপ্টোকারেন্সি এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে ৫ লাখ করে মোট ১০ লাখ টাকা সরিয়ে ফেলা হয়। পরে ঘটনা অন্যদিকে মোড় ঘুরাতে সোর্সের ঘটনার পাঁচ দিন পর ২ মার্চ আবু বক্কর ও গোয়েন্দা পুলিশের দুই সোর্স মো. কাউসার আহম্মদ (৩৫) ও শাহাদাত হোসেন (৩৫) করে আসামি করে বায়েজিদ বোস্তামী থানায় ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনের অভিযোগে মামলা করে ডিবি।
একইভাবে ২০২০ সালের ১৮ জুলাই সোর্সের দেওয়া তথ্যে নগরীর আগ্রাবাদ বাদামতলী মসজিদ গলির একটি বাসায় ডবলমুরিং থানার এসআই হেলাল উদ্দীনের নেতৃত্বে ইয়াবার সন্ধানে সাদা পোশাকধারী ডিবি পরিচয়ে অভিযান চালায় পুলিশের একটি দল। এ ঘটনায় মোটরসাইকেল দোকানের কর্মচারী মারুফ (১৭) নামে এক কিশোরকে পুলিশি নির্যাতনে মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে।
এ ঘটনায় ডবলমুরিং থানার এসআই হেলাল উদ্দীনকে বরখাস্ত করে ঘটনার তদস্তে তৎকালীন সিএমপি ডবলমুরিং জোনের সহকারী কমিশনার শ্রীমা চাকমাকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। বর্তমানে সেই হেলালউদ্দীন ঢাকা ডিবিতে কর্মরত আছেন।
মন্তব্য করুন