সুফলভোগীদের পরিবর্তে সিরাজগঞ্জের নিমগাছী সমাজভিত্তিক মাছচাষ প্রকল্পের বেশিরভাগ পুকুরই এখন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাদের দখলে। এসব পুকুর সাব-লিজ দিয়ে মোটা অংকের টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। নীতিমালা অনুযায়ী খাস পুকুরের পাশে বসবাসরত হতদরিদ্র সুফলভোগীদের শতভাগ অধিকার দেওয়ার কথা থাকলেও বঞ্চিত করা হচ্ছে তাদের। ভয়ে মুখ খুলতেও সাহস পাচ্ছে না সুফলভোগীরা।
প্রকল্প এলাকা সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও রায়গঞ্জ উপজেলার একাধিক পুকুরে সরেজমিন অনুসন্ধানে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এদিকে এসব অনিয়ম বন্ধে প্রকল্প কর্মকর্তারা তাদের অসহায়ত্বের কথা জানিয়েছেন।
নিমগাছী সমাজভিত্তিক মাছচাষ প্রকল্পের কার্যালয় সূত্র জানায়, সিরাজগঞ্জের তাড়াশের ৫১৫, রায়গঞ্জের ১০৪, পাবনার চাটমোহরের ১০০ ও ভাঙ্গুড়ার ৬০টি মিলে মোট ৭৭৯টি সরকারি পুকুর যার মোট আয়তন ৬৭৪ দশমিক ৭৬ হেক্টর। এসব পুকুরে মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যে মৎস্য অধিদপ্তরকে ২০২৩ সালে তৃতীয়বারের মতো হস্তান্তর করে ভূমি মন্ত্রণালয়।
এর আগে ২০১১ সালে ৬ বছর মেয়াদি সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে পুকুরগুলো নিয়েছিল মৎস্য মন্ত্রণালয়। সেই সময় ‘নিমগাছী সমাজভিত্তিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা’ নামে একটি নীতিমালা প্রণয়ন এবং ২০১৪ সালের জুন মাসে ৫ বছর মেয়াদি নিমগাছী সমাজভিত্তিক মৎস্যচাষ প্রকল্প অনুমোদিত হয়। নীতিমালায় পুকুরপাড়ের বেকার, যুবক, যুবমহিলা, মৎস্যজীবী, বিধবা ও হতদরিদ্রদের সুফলভোগী সদস্য করে সমিতির মাধ্যমে মাছ চাষের কথা বলা হয়। এ ক্ষেত্রে সুফলভোগী সদস্যদের শতভাগ অধিকার দেওয়া হয়।
রায়গঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ২০১৭ সালে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকের মেয়াদ শেষ হলে সেটি আবারও ৬ বছরের জন্য নবায়ন করা হয়। এদিকে ২০১৯ সালে মেয়াদ শেষ হওয়ায় প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ভূমি মন্ত্রণালয়ের চুক্তির মেয়াদ থাকায় পুনরায় প্রকল্পটি শুরুর সিদ্ধান্ত নেয় মৎস্য বিভাগ। ৪ বছর চেষ্টার পর ২০২৩ সালের জুন মাসে নতুন করে শুরু হয় প্রকল্পটি।
সরেজমিনে প্রকল্প এলাকার পুকুরগুলো ঘুরলে অবৈধভাবে আওয়ামী লীগ নেতাদের সাবলিজ দেওয়াসহ নানা অনিয়মের চিত্র উঠে আসে।
সোনাখাড়া ইউনিয়নের বন্দিহার এলাকায় ৭৯ বিঘা আয়তনের রুদ্রদিঘীর সুফলভোগী সদস্য ১৩৮ জন। প্রকল্প শুরুর দিকে বেশ কয়েক বছর সুফলভোগীরা মাছচাষ করে উপার্জিত টাকা নিজেরা বণ্টন করে নিতেন। কিন্তু ৪ বছর ধরে এই পুকুরটি সাব-লিজ দিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সুফলভোগী দলের সভাপতি-সম্পাদকসহ কমিটির কয়েকজন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুফলভোগীরা বলেন, পুকুরটা আমাদের নামে সরকার লিজ দেয়। সমিতির নামেই ডিসিআর কাটা হলেও সভাপতি এটিকে সাব-লিজ দিয়েছেন। এবার ফরিদ নামে একজন লিজ নিয়েছে। কত টাকা লিজ দিয়েছে তা আমরা জানি না। সদস্যদের নিয়ে মিটিংও করা হয় না। শোনা যাচ্ছে ৩০ লাখ টাকায় লিজ দেওয়া হয়েছে। সদস্যদের ৬-৭ হাজার টাকা দিয়েছে। কিছু বলতে গেলে সদস্য পদ থেকে বাদ দেওয়ার হুমকি দেন। আব্দুল জব্বার পুকুরপারের বাসিন্দা না হয়েও এমপি ডা. আব্দুল আজিজের ডিও লেটারে সভাপতি হয়েছেন। তার পরিবারের ৫-৬ জন সদস্য রয়েছেন।
এদিকে এই পুকুর সাবলিজ দেওয়ার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন সুফলভোগী সদস্য রামেন্দ্রনাথ মাহাতো। অভিযোগ দেওয়ার পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে দাবি করেন তিনি। তিনি বলেন, আমরা বেশ কয়েক বছর চাষাবাদ করেছি। গত চার বছর ধরে সেটা করতে দিচ্ছে না স্থানীয় নেতারা।
এ বিষয়ে ওই পুকুরের সভাপতি আব্দুল জব্বার পুকুর সাব-লিজ দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, আমরা মিটিং করে রেজুলেশন করি। সামনা-সামনি আসেন কথা হবে।
পার্শ্ববর্তী গোতিথা গ্রামে ড্যাবরা পুকুর ও আন্ধিয়া পুকরের সুফলভোগীরা একই কথা বলেন। ড্যাবরা পুকুরপারের এক নারী সুফলভোগী বলেন, আমরা আগে পুকুরে আবাদ করেছি। এখন কার কাছে কত টাকায় সাবলিজ দিয়েছে জানি না। সদস্যদের ৫-৬ হাজার করে টাকা দেয় বছরে। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান রিপন এই সাবলিজ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত।
এই পুকুরের সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন বলেন, আগে পুকুর লিজ দেওয়া হয়েছিল। অফিসাররা নিষেধ করায় এ বছর কোনো লিজ দেওয়া হয়নি। তবে পুকুরের কয়েকজন সুফলভোগী জানান, এ বছর নতুন করে ১৮ লাখ টাকায় সাব-লিজ দিয়ে ৪৪ সুফলভোগীকে ৯ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছে। বাকি টাকা নেতারা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছে।
সুরপাই পুকুর মৎস্যজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের এলাকায় কোনো সুফলভোগী সদস্য এখন আর পুকুর চাষ করে না। সব লিজ দেওয়া হয়। আগে নিজেরা চাষ করে ২০-৩০ হাজার করে টাকা বছরে সুফলভোগীরা আয় পেয়েছে। এখন বছরে ৬-৭ হাজার করে টাকা দেওয়া হচ্ছে। কত টাকায় লিজ দেয় তাও জানি না।
৭৩ বিঘার জলাশয় ধামাইনগর ইউনিয়নের ক্ষিরিতলা গ্রামের প্রতাপদিঘীর সুফলভোগী রাজু বলেন, এ পুকুরের সুফলভোগী সদস্য সংখ্যা ১৪৫। গত বছর নিমগাছী বাজারের রফিকুল উকিল নামে এক ব্যক্তিকে সাবলিজ দেওয়া হয়। সদস্যদের মাত্র ২ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছিল। এবার এখনো টাকা দেওয়া হয়নি। লিজ দেওয়ার বিষয়ে কাউকে কিছু জানানো হয় না।
কাতলাদিঘীর সুফলভোগী আনোয়ার বলেন, এলাকার সকল পুকুরই সাবলিজ সিস্টেমে চলছে। উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ফেরদৌস আলম তালেব এই পুকুর লিজ নিয়েছে বলে সুফলভোগীরা জানায়।
কাতলাদিঘীর সভাপতি মাসুম সাবলিজ দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, দেখা করে সরাসরি এ বিষয়ে কথা বলব।
যোগী পুকুর সাবলিজ নিয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শরিফুল ইসলাম ঝন্টু।
তাড়াশের উলিপুর দিঘী এলাকার শাহজাহান, জিয়াউর রহমান ও ছানোয়ার হোসেন বলেন, পুকুর পাড়ে বাড়ি এবং দরিদ্র হলেও আমাদের সদস্য নেওয়া হয়নি।
ওই পুকুরের সুফলভোগী সদস্য মায়া খাতুন ও মনজিল বলেন, উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ইকবাল হাসান রুবেল পুকুরটি সাবলিজ নিয়ে মাছচাষ করছে।
তাড়াশ ছাত্রলীগের সভাপতি ইকবাল হাসান রুবেল বলেন, দুই বছর ধরে আমি উলিপুর দিঘী সাবলিজ নিয়ে চাষ করি। এবার ১৪ লাখ টাকায় নিয়েছি। আমার সঙ্গে আরও ২ জন পার্টনার রয়েছে।
মাধাইনগর ইউনিয়নের ভিকমপুর গ্রামের বড়ঘোনার পুকুরের সুফলভোগী জহুরুল, আক্তার ও রশিদ বলেন, পুকুরটি সাবলিজ দিয়েছেন সমিতির সভাপতি ও ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম শান্ত। স্থানীয় আব্দুল হাকিমসহ আরও দুজন পুকুরটি সাবলিজে চাষ করছেন।
হাজেরা খাতুন নামে এক বিধবা বলেন, আমি ভূমিহীন বিধবা, আমার ছেলে নেই। তারপরও আমাকে সদস্য করা হয়নি।
মাধাইনগর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম শান্ত পুকুর সাবলিজের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, পুকুর আমরাই চাষ করছি। আপনি দেখা করেন বিস্তারিত বলব।
একই চিত্র দেখা যায়, রায়গঞ্জের সোনাখাড়া ইউনিয়নের শিতলাই বিল, কাড়ালিয়া পুকুর, ঘোড়ামারা, তেঁতুলিয়া, ধামাইনগর ইউনিয়নের যোগী পুকুর, মায়া পুকুর, তাড়াশের মাধাইনগর, দেশীগ্রাম, তালম, বারুহাস ও নওগাঁ ইউনিয়নের অধিকাংশ পুকুরেই।
এসব পুকুরপারের সুফলভোগীরা জানান, সবই পুকুর সাবলিজ নিয়ে প্রভাবশালী নেতারা চাষ করছেন। সমিতির সভাপতি-সেক্রেটারির সঙ্গে যোগসাজশে মোটা অংকের টাকায় তারা সাবলিজ নিচ্ছেন। সুফলভোগী সদস্যদের নামমাত্র টাকায় সান্ত্বনা দিয়ে সাবলিজের অধিকাংশ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ প্রভাবশালীরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিচ্ছেন।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্বে) মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, যারা একটু চালাক ও প্রভাবশালী তারা পুকুরগুলো নিজেরা আয়ত্তে নিয়ে চাষ করতে চায়। প্রতিটি পুকুর মনিটরিং করার মতো জনবল আমাদের নেই। প্রথম দিকে পন্ড এটেন্ডডেন্ট ছিল ৫৪ জন। এখন ওই পদই বিলুপ্ত হয়েছে। এখানে যারা আছি সবাই আমরা অতিরিক্ত দায়িত্বে। তাছাড়া প্রকল্পের কাজ শুধু পুকুর সংস্কার, মাছচাষের উপকরণ সহায়তা ও প্রশিক্ষণ প্রদান। সুফলভোগী সদস্য নির্বাচন বা বাতিল করে উপজেলা সমাজভিত্তিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা কমিটি। যার সভাপতি ইউএনও। ওই কমিটি শক্তিশালী হলেই অনিয়ম প্রতিরোধ করা সম্ভব।
রায়গঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা সমাজভিত্তিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি নাহিদ হাসান খান বলেন, সাবলিজের বিষয়টি আমিও নিজেও দেখেছি। আমরা যখন জিজ্ঞেস করি সাবলিজ কেন দিয়েছেন তখন আর কেউ কথা বলে না। সাবলিজের লিখিত কোনো চুক্তি থাকে না, ফলে আমরা তাদের খুঁজেও পাই না।
তিনি বলেন, সাবলিজ দেওয়া বেইআইনি। আমরা চাই নীতিমালা অনুযায়ী এটা পরিচালিত হোক। যারা প্রকৃত দরিদ্র সুফলভোগীরাই চাষাবাদ করুক। কদাচিৎ লিখিত অভিযোগ আসলে সে বিষয় আমরা দেখি। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপকারভোগীরা অভিযোগ দেয় না। আমরা বিষয়টি আবার দেখব। যদি কোথাও সাবলিজ দেওয়া হয় আমরা সেই কমিটি বাতিল করে দিতে পারি।
এদিকে বিষয়টি সম্পূর্ণ এড়িয়ে যান জেলা প্রশাসক মীর মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান। জেলা মৎস্য ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হলেও এ বিষয়ে তিনি তেমন কিছুই জানেন না বলে জানান। তিনি বলেন, পুকুরগুলো আমরা মৎস্য বিভাগকে হস্তান্তর করি। তারাই এটা ভালো বলতে পারবে।
স্থানীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডা. আব্দুল আজিজ বলেন, আওয়ামী লীগের নেতারা এইভাবে পুকুর নেওয়ার কথা নয়। একসময় সমাজে যারা আধিপত্য বিস্তার করত তারাই পুকুরগুলো নিয়ন্ত্রণ করত। আমরা আসার পর বলেছি সুফলভোগীদের চাষ করতে হবে। জয়সাগর, প্রতাপদিঘীর মতো পুকুর প্রভাবশালীরা খেত, আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সেগুলো সুফলভোগীদের হাতে তুলে দিয়েছি।
তিনি বলেন, ২-১ বছরের মধ্যে আমি কাউকে সভাপতি হওয়ার জন্য ডিও লেটার দিইনি। তবে কয়েক বছর আগে একটি পুকুরে দুটি গ্রুপ ছিল। এটা সমাধানের জন্য আলোচনা করে হয়তো ডিও লেটার দেওয়া হয়েছিল।
মন্তব্য করুন