মৌলভীবাজার জেলার সাত উপজেলার তিন লক্ষাধিক মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠলেও অধিকাংশ মানুষ খাদ্য সংকটে বিপাকে পড়েছেন। কোথাও সামান্য ত্রাণ পৌঁছালেও এখনো বরাদ্দ অপ্রতুল। মানুষের সঙ্গে বিপাকে পড়েছে গবাদিপশুও।
সরেজমিনে দেখা যায়, মৌলভীবাজার সদর ও রাজনগর উপজেলাসহ জেলার সাতটি উপজেলার সিংহভাগ ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামই এখন পানিতে নিমজ্জিত। মনু, কুশিয়ারা ও ধলাই নদীর পানি বেড়ে দুদিন ধরে এসব গ্রামের পর গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। ডুবে গেছে রাস্তাঘাট। বন্ধ হয়ে গেছে যান চলাচল। বসতঘর ছেড়ে মানুষ উঠেছেন আশ্রয়কেন্দ্রে।
মৌলভীবাজার জেলার মনু কুশিয়ারা ও জুড়ী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রভাহিত হচ্ছে। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে কেউ ছুঠছেন স্বজনের বাড়ি আবার কেউ ছুটছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। তবে আশ্রয়কেন্দ্রে এখনো পৌঁছায়নি ত্রাণ। তাই শুকনো চিড়া-মুড়ি দিয়েই আহার নিবাড়নের চেষ্টা।
প্যারালাইজড হয়ে দুই বছর ধরে পঙ্গু জুলেখা বেগম। ছেলে দিনমজুর। বন্যায় বন্ধ হয়ে গেছে কাজ। তাই ঘরে নেই খাবার। আজ সারাদিন ধরে তাদের ঘরের চুলোয় জ্বলেনি আগুন। অসুস্থ মাকে নিয়ে কোথায় যাবে এখন সেই চিন্তুায় চোখে অন্ধকার দেখছেন ছেলে নুরুল মিয়া।
হামরকোনা গ্রামের বাসিন্দা নুরুল মিয়া বলেন, আমার অসুস্থ মাকে আজ খাবার দিতে পারিনি। কাজে যেতে পারিনি। সরকারি কোনো ত্রাণও আসেনি। আমরা খুব কষ্টে দিন পাড় করছি।
দাউদপুর আশ্রয়কেন্দ্রে আসা রহিমা বলেন, সাঁতার দিয়ে ঘর থেকে বাহির হয়ে এসেছি। আশ্রয়কেন্দ্রে এসে এখন আমরা খাদ্যের অভাবে পড়েছি।
সকালে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার পশ্চিম শ্যামেরকোনা এলাকায় বন্যার পানিতে ভেসে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন, চাঁদনিঘাট ইউনিয়নের পশ্চিম শ্যামেরকোনা গ্রামের জমির আলীর ছেলে হৃদয় (১৫) ও ফয়ছল মিয়ার ছেলে সাদি (১০)।
জানা যায়, মনু নদীর পানি বেড়ে ও ধলাই নদীর বাঁধ ভেঙে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের শ্যামের কোনা, মাঝপাড়াসহ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়। মৌলভীবাজার-শমসেরনগর সড়কে পানি উঠে বন্ধ হয়ে গেছে যান চলাচল। হৃদয় ও সাদিকে পরিবারের লোকজন খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে সকালে বন্যার পানিতে মরদেহ ভেসে উঠেছে দেখতে পান। তাৎক্ষণিকভাবে মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে আনলে চিকিৎসকরা তাদের মৃত্যু ঘোষণা করেন।
পাউবো সূত্রে জানা যায়, বিকেল ৬টায় মনু নদীর পানি কুলাউড়ায় রেলওয়ে ব্রিজে বিপৎসীমার ১৩০ সেন্টিমিটার নিচে প্রবাহিত হলেও সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট ব্রিজে বিপৎসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সদর উপজেলার কুশিয়ারা নদী শেরপুর ব্রিজে বিপৎসীমার ২১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে ধলাই নদীর পানি বিপৎসীমার ১৮৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে কমলগঞ্জ ও সদর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন।
এদিকে পানিবন্দি মানুষদের খোঁজখবর নিতে কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী মৌলভীবাজার সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন মৌলভীবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার নির্বাহী অফিসার নাসরিন চৌধুরী বলেন, মৌলভীবাজার সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের পশ্চিম শ্যামেরকোনা এলাকায় বন্যার পানিতে ভেসে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে দুজনকে ২৫ হাজার করে ৫০ হাজার টাকার অনুদান প্রদান করা হয়েছে। মানুষদের উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্র নিয়ে যেতে আমরা চেষ্টা করছি।
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলায় মোট ২০৫টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ৬ হাজার ২৫৩ জন মানুষ আশ্রয়গ্রহণ করেছেন। ২০০টি গবাদিপশু আশ্রয় নিয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ পরিস্থিতিতে ২৪০টি ১০ লিটার পরিমাপের বোতল ও ৬৫ হাজার পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবরাহ করা হয়েছে। এছাড়া জি আর চাল ৪২২ টন ও ২ লাখ ৮৭ হাজার ৫০০ নগদ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ৪৬৫ প্যাকেট শুকনো খাবার ও ১২০০ প্যাকেট রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হয়েছে।
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক উর্মি বিনতে সালাম জানান, জেলার সাতটি উপজেলায় দুই শতাধিক আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ৭০টি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় পানিবন্দি লোকদের উদ্ধারে প্রয়োজনীয় তৎপরতা চালাচ্ছে উপজেলা প্রশাসন।
মৌলভীবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান বলেন, মৌলভীবাজার সদর ও রাজনগরের বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছি। কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্রের বন্যাদুর্গত মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্র ও বন্যাদুর্গত এলাকার জন্য প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত ত্রাণের মজুদ আছে। ইতোমধ্যে বিতরণ শুরু হয়েছে।
মন্তব্য করুন