মো. আবু সাহেব, হাবিপ্রবি প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ০২:৩৫ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

তীব্র সেশনজটে হাবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা

হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক। ছবি : কালবেলা
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক। ছবি : কালবেলা

হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) বিভিন্ন অনুষদে বিভাগভিত্তিক তীব্র সেশনজট সৃষ্টি হয়েছে। ছয় মাসের এক সেমিস্টার শেষ করতে সময় লাগছে আট থেকে ৯ মাস। ফলে চার বছরের স্নাতক শেষ করতে সময় লাগছে প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে মোট ছয়টি ব্যাচ (১৮, ১৯, ২০, ২১, ২২ ও ২৩) অধ্যয়নরত।

এদিকে শিক্ষার্থীদের স্টুডেন্ট আইডি কার্ডের নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার ফলে অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় দিতে জটিলতায় পড়ছেন হাবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টির ২১, ২২ ও ২৩ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের একাডেমিক কার্যক্রম যথাসময়েই অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই তিনটি ব্যাচে করোনাজনিত ভর্তি বিলম্ব ছাড়া জট নেই।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, একাডেমিক রুটিন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ফর্মালিটিজ পেপার মাত্র। রুটিন অনুযায়ী ক্লাস পরীক্ষা নিতে না পারায় সেশনজট তীব্র আকার ধারণ করেছে। শিক্ষক সংকট, এমনকি বিভিন্ন বিভাগে ক্লাসরুম সংকটের কারণেও বাড়ছে সেশনজট। করোনা পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছয় মাসের সেমিস্টার চার মাসে শেষ করার ঘোষণা দিলেও বাস্তবে তার বাস্তবায়ন না হওয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ যেন আরও চরমে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের অধিকাংশ বিভাগে এক থেকে দেড় বছরের সেশনজট রয়েছে। এর মধ্যে সোশ্যাল সায়েন্স অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ অনুষদের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সেশনজট সব থেকে বেশি। এই বিভাগের ১৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের স্নাতক ২০২১ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও গত মাসের (আগস্ট) ২০ তারিখে ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করেছে। একই বিভাগের ১৯ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা লেভেল ৩ সেমিস্টার ২-এর ফাইনাল শেষ করেছে মাত্র তবে তাদের ভাইভা এখনো হয়নি।

বিজ্ঞান অনুষদের বিভিন্ন বিভাগও চরম সেশনজটের কবলে পড়েছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা। এক্ষেত্রে এই অনুষদের সব থেকে বেশি জটে রয়েছে রসায়ন বিভাগ। এই বিভাগের ১৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা চার বছরের স্নাতক শেষ করতে সাড়ে পাঁচ বছরের বেশি সময় নিলেও কেবল সপ্তম সেমিস্টার পার করে অষ্টম সেমিস্টারে পা দিতে পেরেছে। জানা যায়, এই বিভাগের ১৮ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা এখন পর্যন্ত মিড সেমিস্টার পরীক্ষাও দিতে পারেনি। তবে এই অনুষদের বাকি তিনটি বিভাগ (গণিত, পরিসংখ্যান ও পদার্থ) তুলনামূলক এগিয়ে রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে প্রবীণ অনুষদ অর্থাৎ কৃষি অনুষদের অবস্থাও ভয়াবহ। প্রতিষ্ঠার এত বছর পরেও এই অনুষদে বিরাজ করছে তীব্র সেশনজট। জানা যায়, এই অনুষদের ১৮ তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের স্নাতক ২০২১ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সবে মাত্র তারা অষ্টম সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছে। এ ছাড়াও এই অনুষদের ১৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরাও অন্যান্য অনুষদগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের তিনটি বিভাগেও রয়েছে সেশনজট। এ ছাড়াও ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের বিভিন্ন বিভাগ থেকে শুরু করে ভেটেরিনারি অনুষদ, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ এবং ফিশারিজ অনুষদেও এক থেকে দেড় বছরের জট রয়েছে।

এদিকে নির্ধারিত সময়ে কোর্স শেষ না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়েই অবস্থান করতে হচ্ছে। ফলে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের পক্ষে থাকা খাওয়াসহ বিভিন্ন খরচ বহন‌ করা কষ্টসাধ্য। এ ছাড়াও সেশনজটের ফলে পরিবহন সংকট, আবাসিক সংকটসহ আরও নানা সংকট জটিল আকার ধারণ করেছে।

ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ১৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী আহমেদ সাকিল বলেন, বর্তমানে আমাদের সপ্তম সেমিস্টারের ফাইনাল চললেও আইডি কার্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে। সেশনজটের অন্যতম কারণ হচ্ছে সঠিক সময়ে কোর্স শেষ করতে না পারা। সমাধানের ক্ষেত্রে প্রথমত রুটিন অনুসরণ করা যেতে পারে। অনেক সময় আগের সেমিস্টারের রেজাল্ট দেরিতে প্রকাশ হওয়ার কারণে চলমান সেমিস্টারের পরীক্ষা পিছিয়ে যায়। এক্ষেত্রে শিক্ষক এবং ক্লাসরুম সংকট নিরসন অতীব জরুরি। জট নিরসনে রুটিনে দেওয়া তারিখেই ফাইনাল পরীক্ষা শুরু করা সময়ের দাবি।

সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ১৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আলী মানিক বলেন, মধ্যবিত্তদের জন্য উচ্চশিক্ষা না। আমার কাছে মনে হয় উচ্চশিক্ষা বর্তমানে একটি শৌখিন বিষয়। আমি আমার পরিবারের একমাত্র ছেলে সবাই আমার দিকে চেয়ে আছে, আমি কবে পাস করে বের হব এবং কর্মজীবী হয়ে পরিবারের হাল ধরব। সেশনজটের জন্য ৫ বছরেও অনার্স শেষ হলো না। এসব ভাবলে ডিপ্রেশনের ভূত চেপে বসে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রসায়ন বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, বিজ্ঞান অনুষদের অন্যান্য বিভাগের থেকেও পিছিয়ে আছে রসায়ন বিভাগ। যেখানে অন্যরা ৫ম সেমিস্টারের ফাইনাল দিবে সেখানে আমরা কেবল চতুর্থ সেমিস্টার শেষ করলাম। শিক্ষক সংকট, ক্লাসরুম সংকট, ল্যাব সংকট এগুলো বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখলে সহজে সমাধান হয়। ল্যাব রুমের সংকটের কারণে থিউরি পরীক্ষা শেষ করার পর ১ থেকে ২ মাস বসেই থাকতে হয় আমাদের।

এ বিষয়ে কৃষি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. বিধান চন্দ্র হালদার বলেন, বর্তমানে সেশনজট বৃদ্ধি হওয়ার মূল কারণ করোনা ভাইরাসজনিত কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা। এতে দীর্ঘ প্রায় ১৮ মাস বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় জট সৃষ্টি হয়। বর্তমানে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে দ্রুত সেশনজট কাটানোর চেষ্টা করছি। সেই লক্ষ্যে ২০ ব্যাচের থেকে পূর্ববর্তী ব্যাচগুলোর শিক্ষার্থীদের ৪ মাসে সেমিস্টারের সময় নির্ধারণ করে বর্তমান কার্যক্রম চলছে। আর ২১ ব্যাচ থেকে আমরা প্রত্যেক সেমিস্টার ৬ মাসের মধ্যেই শেষ করতেছি। কৃষি অনুষদের শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত ল্যাব থাকায় সেমিস্টার শেষ করতে একটু বেশি সময় লেগে যায়। তবে সেশনজট নিরসনে যে আমাদের চেষ্টার কমতি রয়েছে এ রকম অভিযোগ শিক্ষার্থীরা কখনোই করতে পারবে না। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আশা করছি অতি শিগগিরই আমরা সেশনজট কাটিয়ে উঠত পারব।

সিএসই অনুষদের ডিন অধ্যাপক মেহেদি ইসলাম বলেন, করোনার পূর্ববর্তী ব্যাচগুলো অনেকটা পিছিয়ে পড়েছিল। তাদের এগিয়ে নিতে চার মাসের সেমিস্টার করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের যে একাডেমিক রুটিন দেওয়া হয়েছে সে অনুযায়ী পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। হয়তো কয়েক দিনের গ্যাপ হয়ে যাচ্ছে। করোনার ক্ষতি সহজেই নিরসন করা সম্ভব নয়। তবে আমরা সর্বদা চেষ্টায় আছি কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়কে সেশনজট মুক্ত করা যায়।

পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক ড. মো. নাজিম উদ্দীন বলেন, সেশনজট নিরসনের জন্য আমরা করোনার পর থেকেই কাজ করে যাচ্ছি। জট সৃষ্টির মুখ্য কারণ হচ্ছে শিক্ষক সংকট এবং অপর্যাপ্ত ক্লাস রুম। এ ছাড়াও একটি সমস্যা সেশনজটে ভূমিকা রাখছে সেটি হলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করে জমা দেওয়ার প্রতি দায়িত্বহীনতা। অল্প কিছুসংখ্যক শিক্ষক রয়েছেন যারা নির্দিষ্ট সময়ে খাতা মূল্যায়ন করে জমা দেন না। ফলে একটি বা দুইটি কোর্সের ফলাফলের জন্য সম্পূর্ণ রেজাল্ট প্রকাশ করতে দেরি হয়ে যায়। যার প্রভাব পরবর্তী ব্যাচগুলোতেও পরে। তবে শুধু সেমিস্টার শেষ করলেই হবে না। লেভেল ১ এবং লেভেল ২ এ যে পড়াগুলো থাকে সেগুলো অত্যন্ত বেসিক পড়াশোনা। এগুলো ভালোভাবে আয়ত্ত না করেই পরীক্ষা দিয়ে পার হয়ে গেলে হবে না। বেসিক ভালোভাবে গড়ে না উঠলে শিক্ষার্থীদের পরবর্তীতে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এ জন্য আমরা চাইলেও লেভেল ১ ও ২ এর কোর্সগুলোর ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত পরীক্ষা নিতে পারি না। তবে লেভেল ৩ ও ৪ এ আমরা আরো দ্রুত শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করার প্রচেষ্টায় রয়েছি। উপাচার্য সেশনজট নির্মূলে অত্যন্ত তৎপর। বর্তমানে সব অনুষদেই প্রত্যেক সেমিস্টারে পূর্বের তুলনায় সেমিস্টার শেষ করতে গড়ে ২ থেকে ৩ মাস সময় কম লাগছে। আশা করি আগামীতে সেশনজট নিরসনে আমরা আরও অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পারব।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম. কামরুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি পরবর্তীতে যোগাযোগ করতে বলেন। কিন্তু পরবর্তীতে মোবাইল ফোনে একাধিকবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘আমরা তো অ্যাটাকিং ক্রিকেট খেলছি, আরও অ্যাটাকিং চাচ্ছেন’

রণবীরের মুখটা ছিল একেবারে স্বাস্থ্যকর: ধনশ্রী বর্মা

স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা রফিকুল ইসলামের পদ স্থগিত 

কোটি টাকা হাতিয়ে আত্মগোপন জনপ্রতিনিধি, জীবন দিলেন ব্যবসায়ী

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পরিদর্শনে ২ উপদেষ্টা

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিলেন বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেটার

যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘জনযুদ্ধের’ জন্য প্রস্তুত ভেনেজুয়েলা, মাদুরোর হুঁশিয়ারি

নুরকে দেখতে হাসপাতালে শামা ওবায়েদ, চাইলেন সুষ্ঠু তদন্ত

জাগপা সভাপতির ওপর হামলার ঘটনায় জামায়াতের নিন্দা

ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিচ্ছে বেলজিয়াম, ইসরায়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞার হুমকি

১০

ডিএনসিসির সতর্কবার্তা

১১

আজ থেকে নতুন দামে বিক্রি হবে স্বর্ণ, ভরি কত?

১২

সুমনার গাড়ি ঘিরে বিক্ষোভ

১৩

জুতার মধ্যে লুকিয়ে থাকা সাপের কামড়ে যুবকের মৃত্যু

১৪

সেই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শিবিরের লিখিত অভিযোগ

১৫

সাংবাদিক বুলুর মৃত্যু ঘিরে সামনে এলো ‘ভিডিও’, বাড়ছে রহস্য

১৬

শোবিজে হেনস্তার শিকার, অভিনয় ছাড়ার ঘোষণা দিলেন আলিজাহ

১৭

এলপি গ্যাসের দাম বাড়বে না কমবে, সিদ্ধান্ত আজ

১৮

চাকরি দিচ্ছে ওয়ান ব্যাংক, থাকছে না বয়সসীমা

১৯

তিন মাস পর সুন্দরবন উন্মুক্ত, খুশি জেলে-দর্শনার্থী

২০
X