স্বপন চন্দ্র দাস, সিরাজগঞ্জ
প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৫:৪৯ এএম
অনলাইন সংস্করণ

শিক্ষকদের শিক্ষাবাণিজ্য থেকে বেরিয়ে আসতে হবে

সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবদুল হামিদ। ছবি : কালবেলা
সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবদুল হামিদ। ছবি : কালবেলা

আশি ও নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষেই গুরুত্ব সহকারে পড়াতেন শিক্ষকরা। কিছু শিক্ষক প্রয়োজনমতো প্রাইভেট পড়ালেও সেটি বাণিজ্যিক ছিল না। শিক্ষার্থীর বিষয়ভিত্তিক উন্নয়নের জন্য বিনা পয়সায় বাড়িতে ডেকে পড়াতেন অনেক শিক্ষক। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থাকে ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছে। কোচিং, প্রাইভেট আর গাইডভিত্তিক পড়াশোনায় শিক্ষার্থীরা বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করতে পারলেও মানসিকতার উন্নয়ন ঘটছে না।

এমনটাই দাবি করলেন সিরাজগঞ্জের প্রবীণ ও বর্তমান শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। শিক্ষক দিবস উপলক্ষে কথা হয় জেলার বৃহৎ বিদ্যাপীঠ সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবদুল হামিদের (৭৫) সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের সময় নিবেদিত ছিলাম ছাত্রদের প্রতি। সেটা কোথায় যেন বিচ্যুত ঘটে গেছে। আমরা এখন দেখি শিক্ষকদের পদ থেকে জোর করে সরিয়ে দিতে। তখন বলা হতো শিক্ষকদের গায়ে হাত তুললে তার লেখাপড়া হবে না। এখন ছাত্ররা শিক্ষকদের টেনে ধরে নামায়।

তিনি আরও বলেন, আমি ক্লাস নিতাম, ছাত্র যদি কোনো বিষয় না বুঝত, মনে করতাম হয়তো উপযোগী করে লেকচার ডেলিভারি করতে পারিনি। প্রতিদিন বিকেলে ওদের সময় দিতাম। যে বুঝতে পারোনি চলে আসবে, বুঝিয়ে দেব। ছিল না কোনো প্রাইভেট বা শিক্ষাবাণিজ্য। এখন ছেলেরা যে বুঝল না তার জন্য শিক্ষকরা দায়ী—এটা তারা মাথায় আনতে পারে না। যার জন্য শিক্ষক সমাজের অবস্থান এত খারাপ। এখান থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। আমাদের সময় ছাত্র-শিক্ষকের মধুর সম্পর্ক ছিল। আমি এখনো বেঁচে আছি ছাত্রদের ভালোবাসায়।

বেলকুচি সরকারি ডিগ্রি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপক সুনীল কুমার পাল (৭৬) বলেন, আমরা ক্লাসে বোর্ডের নির্ধারিত বইগুলো ফলো করতাম। কোনো গাইড ব্যবহার হতো না। সাবজেক্টগুলো বোঝানোর মধ্যেই পড়ানো হতো। মুখস্থবিদ্যা নয়, বিশ্লেষণমূলক পড়ানো হতো। কোচিংয়ের জন্য শিক্ষকরা ছাত্রদের উৎসাহিত করতেন না। বিশেষ কোনো সাবজেক্টে ছাত্ররা প্রাইভেট পড়তে শিক্ষকের কাছে যেত। তবে এখন যেমন ব্যবসা হিসেবে নেওয়া হয়েছে, ছাত্রদের কোচিং করতে বাধ্য করা হচ্ছে, তখন তেমনটা ছিল না। শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের শ্রদ্ধাবোধ আর ছাত্রদের প্রতি শিক্ষকদের স্নেহ ছিল।

সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের ৮৯ ব্যাচের ছাত্র অজয় দত্ত বলেন, আমাদের সময় শিক্ষকরা ক্লাসেই সুন্দর করে বোঝাতেন। তখনকার লেখাপড়া আর এখনকার লেখাপড়ার অনেক তফাত। আমরা যখন লেখাপড়া করেছি, তখন কিন্তু টিউশন লাগেনি। আমাদের যত সুন্দর করে লেখাপড়া করাত প্রাইভেটের প্রয়োজন পড়ত না। কিন্তু এখন দেখছি প্রাইভেট ছাড়া চলছেই না।

আশির দশকের ছাত্রী মিনা দত্ত বলেন, তখনকার শিক্ষকরা আন্তরিকতার সঙ্গে ক্লাস নিয়েছেন। তাই প্রাইভেটের কথা চিন্তাও হতো না। ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক থাকায় কোনো কিছুতেই দূরের মনে হয়নি। আমরা এখনো স্যারকে দেখলে গুরু হিসেবে তার প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার চেষ্টা করি। এখন সেই জিনিসগুলো কমে গেছে।

রায়গঞ্জের সরকারি নুরুন্নাহার তর্কবাগীশ কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আতাউর রহমান বলেন, শিক্ষা এখন বাণিজ্যিক অবস্থায় আছে। শিক্ষার্থীরা টাকার বিনিময়ে হলেও বড় ডিগ্রি নিতে চায়। ফলে মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ডটা থাকছে না। শ্রেণিগত শিক্ষার একটা বৈষম্য রয়েছে। স্বাবলম্বী লোকজন ছেলেকে প্রাইমারি স্কুলে পড়ায় না। তারা মনে করে আমার টাকা আছে আমার ছেলে প্রাইমারিতে কেন পড়বে। প্রাইমারি শিক্ষকরা বিভিন্ন স্ট্যান্ডার্ডমানের ট্রেনিং করে। কিন্তু কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক কিন্তু ট্রেনিং করেনি। বর্তমান যুগে কীভাবে ফার্স্টলি চলা যাবে তারা সেই ব্যবস্থাটা করছে। শিক্ষাটা আসলে সেটা নয়, শিক্ষাটা হওয়া উচিত দেশীয় কালচার, মননকে ডেভেলপ করা ও মানসিকতাকে উন্নত করার একটি কোর্স।

সিরাজগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফরিদুল ইসলাম বলেন, শিক্ষক-অভিভাবক ও শিক্ষার্থী বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক দরকার। সরকারি-বেসরকারি, অভিভাবক-শিক্ষক-ছাত্রের বৈষম্য দূর করা প্রয়োজন। শিক্ষকদের উচিত শিক্ষার্থীদের নিজের সন্তানদের মতো মনে করে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করা। আমাদের কোচিং-বাণিজ্য নিয়ে থাকা যাবে না।

সিরাজগঞ্জ ইসলামীয় সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী শান্ত বলেন, এখন স্যাররা ক্লাসে গুরুত্বটা কম দিয়ে কোচিংকেই প্রাধান্য দেন। এ কারণে ছাত্রদেরও মন বসে না। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কও খারাপ হচ্ছে। বাবার কাছে শুনতাম, তারা যখন ক্লাস করত, স্যার-ম্যাডামদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। সেটা আর নেই।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে যুক্তরাষ্ট্রের ভোট পর্যবেক্ষণ

তেঁতুলিয়ার আকাশে উঁকি দিচ্ছে অপরূপ সৌন্দর্যের কাঞ্চনজঙ্ঘা

বান্দরবানের চার উপজেলায় পর্যটনকেন্দ্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ইইউ রাষ্ট্রদূতের সৌজন্য সাক্ষাৎ

ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়ে নেতানিয়াহুর বার্তা

ময়মনসিংহে ফিলিং স্টেশনে ভয়াবহ আগুনে নিহত বেড়ে ৪

বিপিএলের প্রধান স্পন্সর হিসেবে যুক্ত হলো ডাচ-বাংলা ব্যাংক

না‌জিরপুরে আ.লীগ নেতা সবুজ গ্রেপ্তার

শমী কায়সারের ৭ দিনের রিমান্ড চাইবে পুলিশ

কাগজের নৌকা ভাসাতে গিয়ে নিখোঁজ শিশুর লাশ উদ্ধার

১০

বিজয়ী ভাষণ দিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প

১১

এবার বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ প্যাকেজ ঘোষণা

১২

করতোয়ায় নিখোঁজ ইন্দোনেশীয় নাগরিকের মরদেহ উদ্ধার

১৩

আমির হোসেন আমু গ্রেপ্তার

১৪

জমিসংক্রান্ত বিরোধে চাচাকে পিটিয়ে মারল ভাতিজা

১৫

আফগানিস্তানের বিপক্ষে যে একাদশ নিয়ে নামতে পারে বাংলাদেশ

১৬

বিএনপির মিছিলে গুলি / ডা. ইকবালসহ ১৫ জনকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ

১৭

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামানের পিস্তল উদ্ধার

১৮

ক্যালিফোর্নিয়ায় জিতলেন যিনি

১৯

দুই বছরের মধ্যে মোংলা বন্দরের কর্মচাঞ্চল্য বৃদ্ধি পাবে : নৌপরিবহন উপদেষ্টা

২০
X