বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ৫২.৪ শতাংশের মাথায় একবার হলেও আত্মহত্যার চিন্তা এসেছে। আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন ৫.৯ শতাংশ এবং আত্মহত্যার উপকরণ জোগাড় করেছেন ৭.৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই চিন্তা বাসা বাধার পেছনে প্রধান কারণ ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা। এ হতাশায় ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যার চিন্তা করেছেন।
এছাড়া ১৬.২ শতাংশ বাবা-মায়ের সাথে অভিমান করে, ৯.৭ শতাংশ প্রেমঘটিত বিষয়ে, ৯ শতাংশ অর্থনৈতিক সমস্যাগ্রস্ত হয়ে, অন্যরা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করায় ৪.৩ শতাংশ এবং ৩০.৮ শতাংশ শিক্ষার্থী বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যার চিন্তা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর চালানো এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
শুক্রবার (৭ জুন) অনলাইনে আয়োজিত এক ওয়েবিনারে আঁচল ফাউন্ডেশনের ‘বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির কারণ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে গবেষণার তথ্য তুলে ধরা হয়।
গত ১৫ থেকে ৩০ মে দেশের ৮৮ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ হাজার ৫৭০ জন শিক্ষার্থী এ জরিপে অংশ নেন। তাদের মধ্যে ৯৫ শতাংশের বয়স ১৭ থেকে ২৬ বছরের মধ্যে। জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪৮.১৫ শতাংশ পুরুষ, ৫১.৭৮ শতাংশ নারী এবং তৃতীয় লিঙ্গের ১ জন শিক্ষার্থী ছিলেন।
জরিপের ফল বলছে, ৭৯.৯ শতাংশ শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে হতাশার বিভিন্ন উপসর্গ যেমন- ক্লান্তি, ওজন কমে যাওয়া, কোন কিছু উপভোগ না করা, ঘুমের ধরনের পরিবর্তন, আত্মহত্যার চিন্তা, কাজে মনোযোগ দিতে না পারা ইত্যাদি অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। এছাড়া নিজেকে অন্যদের সাথে তুলনা করার কারণে ১৬.২ শতাংশ, পড়াশোনা নিয়ে ৯.৪ শতাংশ, হল বা আবাসিক পরিবেশ নিয়ে ৯ শতাংশ, সহপাঠী বা শিক্ষকের মাধ্যমে বুলিংয়ের কারণে ৫.৩ শতাংশ শিক্ষার্থী হতাশাগ্রস্থ। আর সবগুলো কারণের জন্য ১.৬ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণে ৩.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী হতাশায় ভুগছেন।
জরিপে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্ট নয় ৩৩.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। মোটামুটি সন্তুষ্ট ৫৮.১ শতাংশ এবং পুরোপুরি সন্তুষ্ট মাত্র ৮.৪ শতাংশ শিক্ষার্থী।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পড়াশুনার পরিবেশ নিয়ে অসন্তুষ্টি হওয়ায় পরবর্তীতে বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা তৈরি করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন।
জরিপের ফল বলছে, ৩১.৭ শতাংশ শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। আর ২৯.৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্যারিয়ার হিসেবে সরকারি চাকরি করতে চান, ৯.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ব্যবসা বা উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। এছাড়া মাত্র ৭.১ শতাংশ শিক্ষার্থী বেসরকারি চাকরি করতে চান। এছাড়া বাকি শিক্ষার্থীরা এখনও কোনোরূপ ক্যারিয়ার ভাবনা ঠিক করেনি যা মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ২২ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন ৩১.১ শতাংশ শিক্ষার্থী। যার মাঝে বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন ১৫.৯ শতাংশ, র্যাগিং এর শিকার হয়েছেন ১৩.৪ শতাংশ, যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১.৮ শতাংশ এবং কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হননি ৬৮.৯ শতাংশ। বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহপাঠী বা সিনিয়র দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছেন ৮৫.৫ শতাংশ, শিক্ষক কর্তৃক ৭.৬ শতাংশ, স্টাফ কর্তৃক ১.২ শতাংশ এবং অন্যান্যদের দ্বারা ৫.৭ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বুলিং, র্যাগিং ও যৌন হয়রানির তিক্ততা যখন কোনো শিক্ষার্থীকে গ্রাস করে তখন সে নিজেকে যাবতীয় সব কিছু থেকে গুটিয়ে নেয় এবং ধীরে ধীরে বিষণ্ণতার দিকে ধাবিত হয়।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে হতাশার উপসর্গ অনুভব করার হার বেশি বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তথ্য বলছে, ৮৩.৪ শতাংশ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বিষণ্ণতার উপসর্গগুলোর মুখোমুখি হয়েছেন। বাকি ১৬.৬ শতাংশ জানিয়েছেন তাদের মাঝে হতাশার উপসর্গ দেখা যায় নি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে হতাশার চিত্র তুলনামূলক কম। ৭৯.৯ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন তারা হতাশার উপসর্গগুলো অনুভব করেছেন। অন্যদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬১.৩ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন তারা এ ধরনের উপসর্গের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন।
হলের পরিবেশ নিয়ে ৩৯.৩ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তারা পুরোপুরি অসন্তুষ্ট। সন্তুষ্টির কথা বলেছেন মাত্র ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী। বাকিরা জানিয়েছেন তারা মোটামুটি সন্তুষ্ট। অসন্তুষ্টির কারণ হিসেবে ৯.৯ শতাংশ থাকার পরিবেশকে, অনুন্নত খাবারকে ৭.৮ শতাংশ শিক্ষার্থী, রিডিং রুম বা গ্রন্থাগারের সংকটের কারণে ৩.৭ শতাংশ এবং সবগুলো কারণকেই দায়ী করছেন ৬৮.২ শতাংশ শিক্ষার্থী।
শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সমাধানে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মশালার আয়োজন করা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সম্মান ও আস্থার সম্পর্ক উন্নয়নসহ ৮টি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
মন্তব্য করুন