রক্তচাপ হচ্ছে সেই চাপ, যা আপনার রক্ত চলাচলের সময় ধমনিতে তৈরি হয়। যদি এটি বেশি হয়, তাহলে তা আপনার হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালিতে ক্ষতি করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ রক্তচাপ (হাইপারটেনশন) হৃদরোগ বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
আরও পড়ুন : রক্তচাপ সম্পর্কে যা জানা জরুরি
আরও পড়ুন : হাই ব্লাড প্রেশার নিয়ে যা জানা জরুরি
American Heart Association-এর ২০১৭ সালের গাইডলাইন অনুযায়ী:
স্বাভাবিক রক্তচাপ: ১২০/৮০ mm Hg এর কম, এর বেশি হলে উচ্চ রক্তচাপের প্রাথমিক স্তর ও ১৩০/৮০ mm Hg এর বেশি হলে হাইপারটেনশনের এক বা দুটি ধাপে পড়ে।
প্রায় ৯০-৯৫% ক্ষেত্রে এটি প্রাইমারি হয়ে থাকে। কিন্তু যাদের সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন আছে, তাদের ক্ষেত্রে মূল রোগটি চিকিৎসা করলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে।
১. শরীরের অন্য কোনো সমস্যা
নিম্নোক্ত শারীরিক সমস্যাগুলো উচ্চ রক্তচাপের কারণ হতে পারে:
- অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা
- ডায়াবেটিস
- কিডনির রোগ
- গর্ভাবস্থা
- হৃদযন্ত্রের অসামঞ্জস্যতা
সাধারণত মূল রোগের চিকিৎসা করলে উচ্চ রক্তচাপ কমতে পারে।
২. অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা
২০২০ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৬৫% থেকে ৭৮% প্রাইমারি হাইপারটেনশনের পেছনে ওজন বেশি থাকাটাই মূল কারণ।
স্থূলতা শরীরে হরমোন ও কিডনির কার্যক্রমে পরিবর্তন ঘটায়, ইনসুলিন প্রতিরোধ তৈরি করে যা টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়—এবং এটি উচ্চ রক্তচাপের আরেকটি কারণ।
মাত্র ২%-৩% ওজন কমালেই হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমে।
৩. শরীরচর্চার অভাব
ব্যায়াম না করলে:
- ওজন বেড়ে যায়
- মানসিক চাপ বাড়ে
- রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে
মনে রাখবেন, সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি ধরনের ব্যায়াম বা ৭৫ মিনিট জোরে ব্যায়াম করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
৪. বেশি লবণ খাওয়া
সোডিয়াম (লবণের মূল উপাদান) বেশি খেলে রক্তচাপ বেড়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রে গড়পড়তা মানুষ প্রতিদিন ৩,৪০০ মি.গ্রা. সোডিয়াম খায়, যা সুপারিশকৃত মাত্রার তুলনায় ৪৮% বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) প্রতিদিন ২,০০০ মি.গ্রা. আর AHA মাত্র ১,৫০০ মি.গ্রা. খাওয়ার পরামর্শ দেয়—বিশেষ করে যাদের হাইপারটেনশন আছে।
৫. অ্যালকোহল পান
অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান হৃদযন্ত্রসহ শরীরের অনেক ক্ষতি করতে পারে। এটি:
- রক্তচাপ বাড়ায়
- ডায়াবেটিস এবং কিছু ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়
খেয়াল রাখবেন—পুরুষদের দিনে ২ গ্লাস, মহিলাদের ১ গ্লাস অ্যালকোহলের বেশি না খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
৬. ক্যাফেইন
ক্যাফেইন (কফি, চা, এনার্জি ড্রিঙ্ক, সফট ড্রিঙ্কে থাকে) সাময়িকভাবে রক্তচাপ বাড়াতে পারে। FDA প্রতিদিন ৪০০ মি.গ্রা. পর্যন্ত ক্যাফেইন গ্রহণকে নিরাপদ মনে করে। তবে ৩-৪ কাপ কফির বেশি পান না করাই ভালো।
রক্তচাপ মাপার আগে কমপক্ষে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করুন, যাতে ক্যাফেইনের প্রভাব না পড়ে।
৭. ধূমপান
ধূমপান মূলত :
- রক্তচাপ সাময়িক বাড়ায়
- ধমনিকে শক্ত ও সরু করে তোলে (অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস)
- হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়
আরও পড়ুন : যেসব লক্ষণে বুঝবেন আপনি লো ব্লাড প্রেশারে ভুগছেন
আরও পড়ুন : ৯ সংকেতে বুঝবেন টেস্টোস্টেরন হরমোন কমেছে
জেনে রাখুন—ধূমপান বন্ধ করলে ২০ মিনিটের মধ্যেই শরীরে ইতিবাচক পরিবর্তন শুরু হয়।
৮. ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
কিছু ওষুধ উচ্চ রক্তচাপ বাড়াতে পারে। যেমন:
- স্টেরয়েড
- ব্যথানাশক (NSAIDs)
- সর্দির ওষুধ (ডিকনজেস্ট্যান্ট)
- মানসিক রোগের ওষুধ
- জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি
যদি রক্তচাপ বেশি থাকে, তাহলে কোনো ওষুধ খাওয়ার আগে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা জরুরি।
৯. ঘুমের অভাব
ঘুম কম হলে শরীর বিশ্রাম পায় না, যার ফলে রক্তচাপ কমার সুযোগ থাকে না। CDC বলছে, ১৮ বছরের বেশি বয়সীদের অন্তত ৭ ঘণ্টা ঘুম দরকার।
ভালো ঘুমের জন্য:
- প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যান
- রাতে ভারী খাবার বা অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন
- ঘরের আলো-শব্দ কমিয়ে রাখুন
- রাতে মোবাইল বা কম্পিউটার কম ব্যবহার করুন
১০. গর্ভাবস্থা
গর্ভাবস্থায় রক্তচাপ বেড়ে গেলে তাকে জেস্টেশনাল হাইপারটেনশন বলা হয়। এটি মা ও শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- ওজন বেশি থাকা
- ধূমপান বা অ্যালকোহল পান
- বয়স ৩৫-এর বেশি
- যমজ সন্তান ধারণ
- পারিবারিক ইতিহাস
মনে রাখবেন, প্রতিরোধের জন্য ওজন নিয়ন্ত্রণ, ধূমপান/মদ না খাওয়া এবং সময়মতো চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।
১১. বয়স
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্তচাপ বাড়ার ঝুঁকিও বাড়ে। যেমন:
১৮-৩৯ বছর বয়সে: ২২.৪%
৪০-৫৯ বছর বয়সে: ৫৪.৫%
৬০+ বয়সে: ৭৪.৫%
বয়স বাড়লে রক্তনালিগুলো শক্ত হয়ে যায়, যার ফলে রক্তচাপ বাড়ে। তবে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও নিয়মিত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ এই ঝুঁকি কমাতে পারে।
১২. বংশগত কারণ
পরিবারে কারও উচ্চ রক্তচাপ থাকলে আপনারও এই সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, ৩০% থেকে ৬০% হাইপারটেনশনের পেছনে জেনেটিকসের ভূমিকা থাকতে পারে। তবে এখনো গবেষণা চলছে যে, আসলে পরিবারে ইতিহাস থাকলে কতটুকু ঝুঁকি বাড়ে।
American Heart Association-এর মতে, নিচের অভ্যাসগুলো উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে:
আরও পড়ুন : নিজেই বাড়াচ্ছেন স্ট্রোকের ঝুঁকি, জানুন কীভাবে
আরও পড়ুন : যাদের জন্য ডাবের পানি খাওয়া উচিত নয়
- নিয়মিত ব্যায়াম করুন
- ধূমপান বন্ধ করুন
- অ্যালকোহল কমান
- ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন
- কম লবণযুক্ত খাবার খান
- স্ট্রেস কমান
- চিকিৎসকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন
উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার পেছনে অনেক কারণ কাজ করে—কিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে (যেমন খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম), কিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে (যেমন বয়স, জেনেটিকস)।
আপনার যদি এরই মধ্যে হাইপারটেনশন থাকে, চিন্তার কিছু নেই— অনেকেই এই সমস্যায় আছেন। কিন্তু কিছু ভালো অভ্যাস গড়ে তুললে ও প্রয়োজন অনুযায়ী ওষুধ খেলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
যদি না থাকে, নিয়মিত রক্তচাপ মাপুন, বিশেষ করে পরিবারের কারও যদি এই রোগ থাকে। ভালো অভ্যাস আপনাকে এই সমস্যার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।
সূত্র: হেলথলাইন
সতর্কতা: এই প্রতিবেদনটি একটি সাধারণ বিশ্লেষণ। আবশ্যই প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
মন্তব্য করুন