বর্তমান সময়ে অতিরিক্ত ওজন শুধুই একটি শারীরিক সমস্যা নয়, এটি বহু মানুষের মানসিক চাপ, আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং নানা জটিল রোগের মূল কারণ হয়ে উঠেছে। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে অনেকেই জিমে গিয়ে ঘাম ঝরান, খাওয়া-দাওয়ায় নিয়ন্ত্রণ আনেন, নানা ডায়েট ফলো করেন।
কিন্তু বাস্তব জীবনে সময় ও ব্যয়ের কারণে প্রতিদিন জিমে যাওয়া বা পার্কে হাঁটতে বের হওয়া সবসময় সম্ভব হয় না। অনেক সময় পরিবারের দায়িত্ব ও পেশাগত চাপের কারণে স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবার সুযোগই থাকে না।
তবে চিকিৎসক ও ফিটনেস বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিদিনের ব্যস্ত রুটিনের মাঝেও কিছু সহজ অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে ঘরেই থাকা অবস্থায় ওজন কমানো সম্ভব। এর অন্যতম কার্যকর পদ্ধতি হলো—সিঁড়ি ব্যবহার।
সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা : সাধারণ তবে কার্যকর এক্সারসাইজ
ইন্টারন্যাশনাল স্কাই রানিং ফেডারেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট লরি ভ্যান হাউটেন জানিয়েছেন, প্রতিদিন কয়েকবার সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করলেও তা শরীরের ক্যালোরি বার্নে জিমের বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, সমতল জায়গায় হাঁটার তুলনায় সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামায় প্রায় ২০ গুণ বেশি ক্যালোরি খরচ হয়।
মিলান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিওলজিস্ট এবং বায়োমেকানিস্ট ডক্টর আলবার্তো মিনিটে তার গবেষণায় বলেন, ১ কেজি ওজন অনুভূমিকভাবে নাড়িয়ে ফেলতে ০.৫ ক্যালোরি খরচ হয়। কিন্তু যদি সেই ওজন উল্লম্বভাবে—অর্থাৎ সিঁড়ি বেয়ে উঠিয়ে নেওয়া হয়—তাহলে ক্যালোরি খরচ বেড়ে যায় কয়েক গুণ। এর অর্থ হলো, সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা শরীরের শক্তি ব্যয় বাড়ায় এবং এটি দ্রুত ক্যালোরি বার্ন করে।
আরও কিছু গবেষণা কী বলছে?
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল-এর তথ্য অনুযায়ী, একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি যদি গড়ে ৩০ মিনিট ধরে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করেন, তাহলে তার শরীর ২৮৬ ক্যালোরি পর্যন্ত খরচ করতে পারে (ওজন আনুমানিক ৭০ কেজি ধরা হলে)।
ব্রিটিশ জার্নাল অফ স্পোর্টস মেডিসিনে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দিনে ৭-৮ মিনিট সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করলে হৃদযন্ত্র আরও শক্তিশালী হয় এবং দীর্ঘমেয়াদে মৃত্যুর ঝুঁকি ১৫%-২০% পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
নিয়মিত সিঁড়ি ব্যবহারে পায়ের পেশি ও হাঁটুর সংযোগস্থলে থাকা জয়েন্টগুলোর কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, ফলে দীর্ঘদিন বসে কাজ করলেও শরীর নমনীয় থাকে।
সিঁড়ি ব্যবহারের উপকারিতা
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে : শরীরের বাড়তি ক্যালোরি বার্ন করে দ্রুত ওজন কমাতে সাহায্য করে।
কার্ডিওভাসকুলার ফিটনেস বাড়ায় : হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং রক্ত চলাচল উন্নত করে।
মাংসপেশি শক্তিশালী করে : পা, কোমর, পিঠ এবং পেটের পেশিকে মজবুত করে।
মানসিক চাপ কমায় : ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি হওয়ায় মস্তিষ্কে অ্যান্ডোরফিন হরমোন নিঃসরণ হয়, যা মন ভালো রাখে।
এছাড়াও দীর্ঘমেয়াদি অভ্যাসে এটি ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
করণীয় ও সতর্কতা
যদিও সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা একটি সহজ অভ্যাস, তবুও কিছু বিষয় খেয়াল রাখা দরকার
- যদি আপনি হাঁটু, গোড়ালি বা হৃৎপিণ্ডের সমস্যায় ভোগেন, তবে নিয়মিত সিঁড়ি ব্যবহারের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
- একবারে খুব বেশি সিঁড়ি ওঠার চেষ্টা না করে ধীরে ধীরে সময় ও ধাপ বাড়ান।
- ভালো গ্রিপযুক্ত জুতা পরুন যাতে পা না পিছলে যায়।
- প্রথম দিকে দিনে ৫-৭ মিনিট দিয়ে শুরু করে ধীরে ধীরে ১৫-২০ মিনিট পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে।
- অফিসে বা বাড়িতে লিফটের বদলে সিঁড়ি ব্যবহার করুন।
সঠিকভাবে সিঁড়ি ব্যবহার করলে এটি হয়ে উঠতে পারে একেবারে বিনামূল্যে এবং সহজলভ্য এক্সারসাইজ যা বাড়তি ওজন কমানোর পাশাপাশি শরীরকে করে তোলে আরও ফিট ও শক্তিশালী। সময় না থাকা, জিমে না যাওয়া কিংবা হাঁটতে না বেরোনোর অজুহাতগুলোকে পেছনে ফেলে সিঁড়ির বেয়েই আপনি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের পথে অনেকটাই এগিয়ে যেতে পারবেন।
তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইলে আজ থেকেই লিফট নয়, সিঁড়ি ব্যবহার করুন। সময়ের অভাবে জিমে না গেলেও দিনে কয়েকবার সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে পারেন। তবে কারও হাঁটু বা হৃৎপিণ্ডের সমস্যা থাকলে এই অভ্যাস শুরু করার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
মন্তব্য করুন