মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা অনেক কথা বলেলেও বেশিরভাগ সময় আলোচনায় পুরুষদের বিষয়টি আড়ালেই থেকে যায়। অথচ বাস্তবতা হলো—পুরুষরাও মানসিক সমস্যায় ভোগেন, তবে তা প্রকাশ করেন কম, সাহায্য চান আরও কম।
আজকের এই লেখায় আমরা জানব পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। কেন এটা আলাদা, কী কী লক্ষণ দেখা দেয়, কীভাবে সাহায্য করা যায় এবং কীভাবে এ পরিস্থিতি প্রতিরোধ সম্ভব।
চলুন প্রথমেই জেনে নিই পুরুষদের মানসিক সমস্যা কেন আলাদা?
সমস্যা এক, প্রকাশ ভিন্ন
নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে মানসিক রোগ ধরা পড়ে কম; কিন্তু বাস্তবতা ভয়াবহ। পুরুষদের আত্মহত্যার হার নারীদের তুলনায় ৩.৫ গুণ বেশি। কারণ, তারা সাধারণত বেশি প্রাণঘাতী পদ্ধতি বেছে নেয়।
সমাজ ও ‘পুরুষালি’ চাপ
ছোটবেলা থেকেই পুরুষদের শেখানো হয়—তুমি পরিবার চালাবে, পুরুষ মানুষ কাঁদে না, দুর্বলতা দেখানো যাবে না বা তুমি ছেলে তাই নিজেই নিজেকে সামলে নিতে হবে।
এই বিশ্বাসগুলোই অনেক সময় পুরুষদের মাঝে মানসিক চাপ সৃষ্টি করে এবং সাহায্য চাওয়ার পথ রুদ্ধ করে দেয়।
সাহায্য চাইতে অনিচ্ছুক
পুরুষরা নারীদের তুলনায় অনেক কম হারে চিকিৎসা নেন মানসিক সমস্যার। অনেক সময় তারা নিজের সমস্যাকে গুরুত্ব দেন না, কিংবা ‘বলার মতো কিছু না’ ভেবে চুপচাপ থাকেন।
এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতি ৩ জনে মাত্র ১ জন পুরুষ নিয়মিত ওষুধ খান বিষণ্নতা বা দুশ্চিন্তার জন্য। আর প্রতি ৪ জনে ১ জন মানসিক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেন।
কোন কোন লক্ষণ দেখলে সাবধান হবেন?
পুরুষদের মানসিক সমস্যার কিছু সাধারণ লক্ষণ:
- হঠাৎ রেগে যাওয়া বা খুব চটচটে মেজাজ
- ঘুম ও খাওয়ার অভ্যাসে পরিবর্তন
- একাকিত্ব, বিষণ্নতা, শূন্যতা
- অ্যালকোহল বা মাদকে ঝুঁকে পড়া
- ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করা (দ্রুত গাড়ি চালানো, মারামারি)
- কাজে মন না বসা
- শারীরিক অসুস্থতা, যার কোনো ব্যাখ্যা নেই
- আত্মহত্যার চিন্তা বা চেষ্টা
এই লক্ষণগুলো যদি কারও মধ্যে দেখা যায়, অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
কারা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন?
কিছু পুরুষগোষ্ঠী মানসিক সমস্যায় বেশি আক্রান্ত হন। গবেষণা বলছে—
- বয়সে অনেক বেশি পুরুষ (৮৫+)
- যারা যুদ্ধ, দুর্ঘটনা বা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন
- চাকরি হারিয়েছেন বা কর্মক্ষেত্রে চাপের মধ্যে আছেন
- যাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে বা একাকী জীবনযাপন করেন
- আইনগত বা অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে আছেন
- অ্যালকোহল বা মাদক সেবন করেন
- যাদের পরিবারে মানসিক রোগের ইতিহাস আছে
- শারীরিক অসুস্থতা বা প্রিয়জন হারানোর ধাক্কা পেয়েছেন
কোন কোন মানসিক সমস্যা পুরুষদের মধ্যে বেশি দেখা যায়?
বিষণ্নতা (ডিপ্রেশন)
মন খারাপ, আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, ক্লান্তি—এসবই বিষণ্নতার লক্ষণ। পুরুষরা এসব বিষয়ে চিকিৎসা কম নেন, কিন্তু তাদের আত্মহত্যার হার বেশি।
দুশ্চিন্তা (অ্যাংজাইটি)
অকারণ ভয়, উদ্বেগ, সব সময় দুশ্চিন্তা—এগুলোই এর লক্ষণ। অনেক সময় বিষণ্নতার সঙ্গেও মিলে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষরা এতে কম কথা বলেন, তাই অনেক সময় এ সমস্যাগুলো শনাক্ত হয় না।
স্কিজোফ্রেনিয়া
বাস্তবতা থেকে বিচ্যুতি, বিভ্রম, অদ্ভুত চিন্তা—এসব লক্ষণ নিয়ে স্কিজোফ্রেনিয়া হয়। যারা ৩০ বছরের মধ্যে এই রোগে আক্রান্ত হন, গবেষণা বলছে তাদের ৯০ শতাংশই পুরুষ।
পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (PTSD)
যুদ্ধ, দুর্ঘটনা বা ভয়ংকর অভিজ্ঞতার পর মন থেকে সেই স্মৃতি না মুছে যাওয়া, ভয়, ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি—এসব PTSD-এর লক্ষণ। পুরুষরাই এ ঝুঁকিতে বেশি থাকেন।
মাদক ও অ্যালকোহল নির্ভরতা
পুরুষরা নারীদের চেয়ে বেশি হারে অ্যালকোহল ও মাদক ব্যবহার করেন। এর ফলে মানসিক সমস্যা আরও বেড়ে যায়। প্রতি বছর ৬৮ হাজার পুরুষের মৃত্যু হয় শুধু অ্যালকোহলজনিত কারণে।
চিকিৎসা কী কী হতে পারে?
থেরাপি বা কাউন্সেলিং
একজন পেশাদার থেরাপিস্টের সঙ্গে নিয়মিত কথা বললে মানসিক চাপ কমে। এ ছাড়া সমস্যা বোঝা যায় ও সমাধানের পথ তৈরি হয়।
চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট, অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি বা ঘুমের ওষুধ নেওয়া হতে পারে। ওষুধের সঙ্গে থেরাপি আরও ভালো কাজ করে।
জীবনধারায় পরিবর্তন
- সময়মতো ঘুম
- স্বাস্থ্যকর খাবার
- নিয়মিত ব্যায়াম
- মেডিটেশন বা যোগব্যায়াম
- অ্যালকোহল ও মাদক থেকে দূরে থাকা
সাপোর্ট গ্রুপ বা পিয়ার সাপোর্ট
একই অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন মানুষের সঙ্গে কথা বলা মানসিক শক্তি দেয়।
প্রতিরোধ কীভাবে সম্ভব?
- পরিবার-বন্ধুর সঙ্গে খোলামেলা কথা বলুন
- চাপ এড়াতে মেডিটেশন, সৃজনশীলতা বা যে কোনো শখে সময় দিন
- সময়মতো চিকিৎসা নিন, দেরি করবেন না
- নিজের যত্ন নিন—শরীর ও মনের
আপনি কীভাবে সাহায্য করতে পারেন?
আপনার কাছের কোনো পুরুষ যদি মানসিক সমস্যায় ভোগেন, আপনি যা যা করতে পারেন:
- তার আচরণে পরিবর্তন খেয়াল করুন
- খোলামেলা কথা বলুন
- চিকিৎসার পরামর্শ দিন, প্রয়োজনে সাহায্য করুন চিকিৎসক খুঁজতে
- সময় দিন, পাশে থাকুন
- যদি আত্মহত্যার ইঙ্গিত থাকে, কখনো একা ছেড়ে যাবেন না—জরুরি সেবা ডাকুন
পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলা এখন সময়ের দাবি। তারা সাহায্য চাইতে লজ্জা পায়, সামাজিক চাপের মধ্যে থাকে। চিকিৎসা,সচেতনতা ও সহানুভূতির মাধ্যমে একজন পুরুষ আবার সুস্থ জীবন ফিরে পেতে পারেন।
আপনার পাশে থাকা কোনো মানুষ যদি এমন সমস্যায় ভোগেন—তাকে কথা বলতে দিন, তার কথা শুনুন। আপনি হয়তো তার জীবন বদলে দিতে পারেন।
সূত্র: মেডিকেল নিউজ টুডে
মন্তব্য করুন