গরমে স্বস্তি দিতে কিংবা শরীর ঠান্ডা রাখতে ডাবের পানির জুড়ি নেই। সেইসঙ্গে থাকা প্রাকৃতিক ইলেকট্রোলাইট শরীরকে দ্রুত হাইড্রেট করে, ক্লান্তি কমায় এবং অনেকের মতে এটি একটি প্রাকৃতিক ডিটক্স পানীয়। যার জন্য অনেকে ভাবেন, ডাব সব বয়সী মানুষের জন্যই নিরাপদ ও উপকারী পানীয়। তবে একটি প্রশ্ন রয়েই যায়, ডাবের পানি কি সবার জন্য উপকারী?
সম্প্রতি ভারতীয় গণমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদেন এ তথ্য বের হয়ে আসে। প্রতিবেদনে চিকিৎসকরা জানান, ডাবের পানি যতই স্বাস্থ্যকর হোক না কেন, এটি সবার জন্য উপকারী নয়।
তবে চলুন জেনে নেওয়া যাক কারা ডাবের পানি পান করা থেকে বিরত থাকবেন—
১. কিডনির সমস্যা থাকলে
ডাবের পানি সাধারণত স্বাস্থ্যকর একটি প্রাকৃতিক পানীয় হিসেবে পরিচিত হলেও, এটি সবার জন্য নিরাপদ নয়। বিশেষ করে কিডনি সমস্যায় ভোগা মানুষের জন্য এটি হতে পারে মারাত্মক ক্ষতির কারণ।
প্রাকৃতিকভাবে ডাবের পানিতে থাকে উচ্চমাত্রার পটাশিয়াম। প্রতি ২৪০ মিলিলিটারে প্রায় ৬০০ মিলিগ্রাম। এই উপাদান সাধারণত শরীরের জন্য দরকারি হলেও, যাদের কিডনি স্বাভাবিকভাবে কাজ করে না, তাদের শরীরে এই অতিরিক্ত পটাশিয়াম ঠিকমতো বের হতে পারে না। ফলে রক্তে পটাশিয়ামের মাত্রা বেড়ে হাইপারক্যালেমিয়া হতে পারে। এই অবস্থা হৃৎস্পন্দনের অনিয়ম (Arrhythmia), দুর্বলতা, বমি বমি ভাব, এমনকি হৃদরোগের ঝুঁকিও বাড়ায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কিডনির রোগীদের পক্ষে মাত্রাতিরিক্ত পটাশিয়াম শরীরে জমে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের মতো প্রাণঘাতী পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কিডনি রোগীরা ডাবের পানি খাওয়া থেকে বিরত থাকাই ভালো।
২. ডায়াবেটিস থাকলে
ডাবের পানি যতই প্রাকৃতিক হোক না কেন, এটিকে সম্পূর্ণ নিরাপদ মনে করা ভুল হতে পারে। বিশেষ করে যারা ডায়াবেটিসের রোগী। কারণ, এক কাপ (প্রায় ২৪০ মিলিলিটার) ডাবের পানিতে প্রায় ৬ থেকে ৮ গ্রাম প্রাকৃতিক শর্করা থাকে।
এই শর্করা রক্তে প্রবেশ করে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা হঠাৎ বাড়িয়ে দিতে পারে, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। অনেকেই ভুল করে ভাবেন যে প্রাকৃতিক চিনি ক্ষতিকর নয়। কিন্তু ফ্রুকটোজ ও গ্লুকোজ মিশ্রিত এই প্রাকৃতিক চিনি শরীরে একইভাবে প্রভাব ফেলে, যেমনটি সাধারণ সুগার করে।
তাই যারা ডায়াবেটিসে ভুগছেন, তাদের ক্ষেত্রে ডাবের পানি পরিমিতভাবে ও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাওয়াই উত্তম। একই সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে, খালি পেটে ডাবের পানি পান করলে শর্করার প্রভাব আরও বেশি হতে পারে।
৩. ক্যালোরি সচেতন হলে পরিমাণে নিয়ন্ত্রণ আনুন
অনেকে ভাবেন ডাবের পানি ক্যালোরি-ফ্রি, কিন্তু আদতে একটি মাঝারি ডাবের পানিতে ৫০ থেকে ৬০ ক্যালোরি থাকে।
যারা ওজন কমানোর জন্য ডায়েট করছেন, তাদের প্রতিটি ক্যালোরির হিসাব জরুরি। সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত ডাবের পানি খাওয়া ডায়েট প্ল্যানের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।
৪. ওয়ার্কআউটের পরে
শরীরচর্চা, খেলাধুলা কিংবা অতিরিক্ত গরমে কাজ করার পর শরীর প্রচুর ঘাম ঝরে যায়। যার মাধ্যমে শরীর শুধু পানির সঙ্গে ইলেকট্রোলাইট যেমন সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্লোরাইডও বেরিয়ে যায়। এই সময় অনেকে ডাবের পানি পান করেন শরীরকে তরতাজা করতে।
নিশ্চয়ই ডাবের পানিতে পটাশিয়ামের পরিমাণ অনেক বেশি, যা শরীরের কোষীয় কার্যক্রম ও হৃৎস্পন্দন নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। তবে এর মধ্যে সোডিয়ামের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে অনেক কম থাকে। অথচ ঘামের মাধ্যমে শরীর সবচেয়ে বেশি যে ইলেকট্রোলাইট হারায়, তা হলো সোডিয়াম।
ফলে দীর্ঘ সময় পরিশ্রম করার পর কেবল ডাবের পানি পান করলে শরীরের সোডিয়াম ঘাটতি ঠিকভাবে পূরণ না। ফলে দুর্বলতা, মাথা ঘোরা, ক্লান্তি বা কখনো হাইপোনাট্রেমিয়া দেখা দিতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন, ঘাম ঝরানোর পর শরীরে ইলেকট্রোলাইট ব্যালেন্স ঠিক রাখতে খাবার স্যালাইন, লবণ-চিনির পানি বা ইলেকট্রোলাইট সমৃদ্ধ পানীয় গ্রহণ করাই বেশি কার্যকর। ডাবের পানি তৃষ্ণা মেটানোর জন্য ভালো হলেও, এটি সবসময় ঘামের পরে শরীরের পূর্ণ ইলেকট্রোলাইট চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট নয়।
৫. বাদামে অ্যালার্জি থাকলে
যাদের বাদাম, নারকেল বা অন্যান্য উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে তৈরি খাবারে অ্যালার্জি রয়েছে, তাদের মধ্যে ডাবের পানিতেও অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া অনুভব করতে পারেন। যদিও এ ধরনের প্রতিক্রিয়া খুব সাধারণ নয়। তবুও এটি একেবারে উপেক্ষা করার মতো নয়।
ডাবের পানি মূলত তরল নারকেলজাত উপাদান। ফলে যারা নারকেল বা ট্রি নাটস জাতীয় খাবারে সংবেদনশীল, তাদের শরীরেও ডাবের পানির উপাদান ইমিউন সিস্টেম অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। এর ফলে শরীরে চুলকানি, ত্বকে র্যাশ, গলায় চুলকানি বা জ্বালাভাব, চোখ ও ঠোঁট ফুলে যাওয়া, এমনকি কারও ক্ষেত্রে হালকা থেকে মাঝারি শ্বাসকষ্টও দেখা দিতে পারে।
এখন জানা যাক, কারা নিশ্চিন্তে পান করতে পারবেন ডাবের পানি—
যারা সম্পূর্ণ সুস্থ এবং যাদের উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি সমস্যা বা রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিক রয়েছে, তাদের জন্য ডাবের পানি হতে পারে আদর্শ প্রাকৃতিক পানীয়। গরমে অতিরিক্ত ঘাম হলে কিংবা হালকা দুর্বলতা বা জ্বর-জারির সময় ডাবের পানি দ্রুত শরীরকে আর্দ্রতা ও প্রয়োজনীয় খনিজে ভরিয়ে দেয়।
তবে যাদের শরীরে আগে থেকেই কোনো ধরনের জটিলতা রয়েছে—বিশেষ করে কিডনি, ডায়াবেটিস বা ইলেকট্রোলাইট ভারসাম্যের সমস্যা—তাদের জন্য ডাবের পানি সবসময় উপকারী না-ও হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে না বুঝে বেশি পরিমাণে ডাবের পানি খেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই যে কোনো ধরনের শারীরিক সমস্যায় ভোগা ব্যক্তি যদি ডাবের পানি খেতে চান, তবে তা অবশ্যই সচেতনভাবে, প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খাওয়া উচিত।
অন্যথায় যেটি প্রাকৃতিকভাবে উপকারী, সেটিই কখনো কখনো শরীরের জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
মন্তব্য করুন