’৯০-এর দশকের শেষ থেকে একবিংশ শতাব্দীর শুরুর সিনেমাগুলোতে দেখা যেত কত দ্রুতই পাল্টে যেত প্রধান চরিত্রের জীবন। প্রথমে রেলস্টেশনের কুলি থেকে শুরু ধাপে ধাপে গাড়িচালক। একটা সময় কোনো ধনীর সঙ্গে পরিচয়- পরে চাকরি। কিছুদিন না যেতেই নিজে হয়ে উঠতেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক। ঠিক তেমনি পালেট গেছে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক আলীর গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর জীবন।
এক যুগ আগেও অর্থকষ্টে দিন কাটত গাড়ি চালক আবেদ পরিবারের। হঠাৎই পালটে যায় সবকিছু। পিএসসির ড্রাইভার সৈয়দ আবেদ আলীর জীবন মাত্র ৮ বছর বয়সে জীবিকার তাগিদে পাড়ি জমিয়েছিলেন ঢাকাতে। সেখানেই কুলির কাজ করতেন। একসময় ফুটপাতে ঘুমিয়ে নিদারুণ কষ্ট করেছেন তিনি। এরপর গাড়ি চালনা শিখে চাকরি নেন পিএসসিতে। তারপর জড়িয়ে পড়েন পিএসসির প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সঙ্গে। আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। অর্জন করেছেন বিপুল সম্পদ। সঙ্গে ক্ষমতাও। গড়ে তুলেছেন আবাসন শিল্প প্রতিষ্ঠান। থ্রি স্টার মানের হোটেল। গ্রামে শহরে বাড়ি গাড়ি সবকিছুই করেছেন।
চেয়েছিলেন মাদারীপুর জেলার ডাসার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হতে। দীর্ঘদিন থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনের জন্য প্রচার প্রচারণাও চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
যেভাবে গ্রামের একজন সাধারন আবেদ আলী থেকে আজকের অটেল সম্পদের মালিক বনে যান সৈয়দ আবেদ আলী : জানাব তার আদ্যোপান্ত-
১. ৮ বছর বয়সে পেটের দায়ে ঢাকায় এসে করেন কুলিগিরি : পিএসসির সাবেক ড্রাইভার সৈয়দ আবেদ আলীর বাড়ি মাদারীপুর জেলার ডাসার উপজেলার পশ্চিম বোতলা গ্রামে। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ঢাকায় চলে যান। এরপর জীবন যুদ্ধে নেমে পড়েন। প্রথমে কুলির কাজ দিয়ে শুরু হয় তার কর্মজীবন। এরপর রিকশা চালানো, হোটেলে কাজ, চাল বিক্রি করাসহ যখন যে কাজ পেয়েছেন তাই করেছেন। এরপর ড্রাইভিং শিখে চাকরি নেন পিএসসিতে। এরপরই তার ভাগ্য খুলতে থাকে।
বর্তমানে তিনি বহু টাকা ও সম্পত্তির মালিক। ডাসার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হবার স্বপ্নও দেখছেন। নিজ গ্রামে গড়ে তুলেছেন তিন তলা বিশিষ্ট দালানঘর, একটি পাকা মসজিদ ও বাগান। কিনেছেন বহু ফসলি জমি।
সরেজমিন ঘুরে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, মাদারীপুর জেলার ডাসার উপজেলার পশ্চিম বোতলা গ্রামের মৃত সৈয়দ আ. রহমানের ছেলে সৈয়দ আবেদ আলী জীবন। তারা তিন ভাই ও এক বোন। ছোট বেলায় তার বাবা মারা যান। তখন তার মা অনেক কষ্ট করে সংসার চালান। মানুষের জমিতে ধান কুড়িয়েও তা বিক্রি করে সংসারের খরচ যোগাড় করতে তার মা। এমনকি কোরবানির ঈদের সময় মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মাংস কুড়িয়ে তা আবার বিক্রি করে সেই টাকায় খাবার কিনতে হতো সৈয়দ আবেদ আলীর।
৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় অভাবের কারণে পড়াশুনা বাদ দিয়ে জীবন-জীবিকার জন্য ঢাকায় চলে যান তিনি। কুলির কাজ দিয়ে শুরু হয় তার কর্মজীবন। বহুরাত একা একা রেলস্টেশনে ঘুমিয়েছেন। এরপর হোটেলে খাবারের প্লেট ধোয়ার কাজ, রিকশা চালানো, চাল বিক্রিসহ যখন যে কাজ পেয়েছেন তাই করেছেন। এরপর রাতে কখনও কখনও ফুটপাতেও ঘুমিয়েছেন। এভাবেই তার ছোটবেলা কেটেছে। এরপর ড্রাইভিং শিখে পিএসসি’র চেয়ারম্যানের চালক হিসেবে চাকরি নেন।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, তার বড় ভাই জবেদ আলী একজন কৃষক। বাড়িতে কৃষি কাজ করেন। এক বছর হলো তার এক ছেলেকে ইতালি পাঠিয়েছেন। মেঝ হচ্ছেন আবেদ আলী। ছোট সাবেদ আলী। তিনিও দীর্ঘদিন সৌদি আরবে ছিলেন। সম্প্রতি দেশে এসে ধার-দেনা করে ছেলেকে লিবিয়া হয়ে ইতালি পাঠান। কিন্তু পাঁচ মাস হলেও এখনও ইতালি যেতে পারেনি, লিবিয়াতেই আছেন। ডাসার উপজেলার পশ্চিম বোতলা গ্রামের পৈতৃক ভিটায় এক তলার বিল্ডিং এ দুই ভাই থাকেন। সবার বড় বোন মহরজান থাকেন শ্বশুরবাড়ি।
২. পিএসসিতে যেভাবে চাকরি পেয়েছিলেন আবেদ : বাবার মৃত্যুর পর অভারের সংসারে জীবিকার তাগিদে সৈয়দ আবেদ আলী গ্রাম ছেড়ে রাজধানী ঢাকায় গিয়ে কুলির কাজ করেছিলেন। পরে ব্যাচেলর বাসায় পরিচয় হওয়া এক বন্ধুর মাধ্যমে পিএসসির চেয়ারম্যানের গাড়িচালক হিসেবে চাকরি পেয়েছিলেন। মঙ্গলবার সকালে আবেদের ছোট ভাই সৈয়দ সাবেদ আলী এসব তথ্য জানান।
ডাসার উপজেলার বালিগ্রাম ইউনিয়নের পশ্চিম বোতলা গ্রামে গিয়ে জানা গেছে, বালিগ্রাম ইউনিয়নের পশ্চিম বোতলা গ্রামের সৈয়দ আব্দুর রহমান ও জয়গুন নেছা দম্পতির মেজো ছেলে সৈয়দ আবেদ আলী। তারা তিন ভাই ও এক বোন। দুই ভাই কৃষি কাজ করেন।
এরপর সেখানে কুলির কাজ শুরু করেন। পরে এক ব্যক্তির বুদ্ধিতে গাড়ি চালানো শিখে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৮ম শ্রেণির সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে গাড়িচালক হিসেবে চাকরি নেন বেসরকারি একটি কোম্পানিতে (বেক্সিমকো)।
১৯৯৭ সালের দিকে রাজধানী ঢাকার ইন্দিরা রোডের পশ্চিম রাজাবাজার এলাকার একটি ব্যাচেলর মেসে থাকতেন আবেদ আলী। ওই মেসেই আবেদ আলীর সঙ্গে পরিচয় হয় সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর এলাকার শাহিন নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে। শাহিনের মামা মেজবাহ চাকরি করতেন সচিবালয়ে। শাহিনের মাধ্যমেই পিএসসির চেয়ারম্যানের গাড়িচালক হিসেবে চাকরি হয় তার।
সাবেদ আলী আরও বলেন, ১৯৯৭ সালের দিকে আমি মেরাদিয়াতে চানাচুর বিক্রি করতাম। আবেদ আলী থাকত ইন্দিরা রোডে। সে বেকার ছিল। মাঝে মধ্যেই আমার থেকে মেসের খরচের জন্য ৩০০-৫০০ টাকা নিত। তবে শাহিন নামে এক বন্ধুর মাধ্যমে পিএসসিতে চাকরি হওয়ার পর ওই বছরই সে বিয়ে করে। বিয়ের পরে সে আমাদের পরিবারের কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি। এখনও তার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।
৩. যেভাবে পিএসসি থেকে চাকরিচ্যুত হন আবেদ : এরআগে নন-ক্যাডারের প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় পিএসসির চাকরি থেকে ২০১৪ সালে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল।
পিএসসির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নন-ক্যাডারে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ‘সহকারী মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার’ পদের লিখিত পরীক্ষা ২০১৪ সালে ২২ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়। সেই পরীক্ষায় এক পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে হলের বাহির থেকে অবৈধভাবে সরবরাহকৃত সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের উত্তরসহ ৪টি লিখিত উত্তরপত্র হাতেনাতে ধরা হয়। ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথ আইনের ধারায় মামলা করা হয়। ওই মামলার তদন্তে সৈয়দ আবেদ আলীর সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত থাকার তথ্য-প্রমাণ মেলে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।
৪. এলাকায় আবেদ পরিচয় দিতেন শিল্পপতি হিসেবে : স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সৈয়দ আবেদ আলী মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার পশ্চিম বোতলা গ্রামের মৃত আব্দুর রহমান মীরের ছেলে। আব্দুর রহমান মীরের তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে আবেদ আলী মেজ। রহমান মীরের বড় ছেলে জবেদ আলী কৃষিকাজ করেন। ছোট ছেলে সাবেদ আলী এখনো এলাকায় অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাদের ভাই আবেদ আলী জীবন। এলাকার মানুষের কাছে তিনি পরিচয় দিতেন শিল্পপতি হিসেবে।
আবেদ আলীর ছেলে সোহানুর রহমান সিয়ামও ব্যবহার করতেন দামি গাড়ি। আবেদ আলী নিজেও দামি গাড়িতে চড়তেন। অথচ এলাকার কেউ জানতেনই না তিনি গাড়িচালক। তিনি ঢাকায় রিয়েল স্টেটের ব্যবসা করতেন বলে এলাকায় প্রচার ছিল। কয়েক বছর ধরে এলাকায় ব্যাপক দান-খয়রাতও করেন প্রশ্নফাঁস চক্রের এই হোতা।
৫. মীর পদবি পাল্টে ব্যবহার করেন সৈয়দ বিত্ত-বৈভব ফুলেফেঁপে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আবেদ আলী মীর পদবি পাল্টে নামের আগে সৈয়দ পদবি ব্যবহার শুরু করেন। বাবার উত্থান নিয়ে ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়ামও সম্প্রতি একটি সমাবেশে বক্তব্য দেন।
৬. মাদারীপুরের গ্রামে গড়ে তুলেন আলিশান বাড়ি : আবেদ গ্রামের বাড়িতে বিলাসবহুল ভবন নির্মাণ করেছেন। বাড়ির পাশে করেছেন মসজিদ। এ ছাড়া রাস্তার পাশে সরকারি জায়গা দখল করে নির্মাণ করেছেন গরুর খামার ও শপিং সেন্টার। উপজেলার পান্তাপাড়া ও পূর্ব বোতলা গ্রামে করেছেন বিপুল সম্পদ। ঢাকার উত্তরায় ১২ তলা, মিরপুরে ৮ তলা বাড়ি রয়েছে।
৭. ঢাকায় একাধিক বাড়িম ফ্ল্যাটসহ নামে-বেনামে বিপুল সম্পদ : রাজধানী মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় নয়তলা বিশিষ্ট ৩টি ফ্ল্যাট রয়েছে সৈয়দ আবেদ আলীর। মঙ্গলবার সকালে মিরপুর থানার পশ্চিম শেওড়াপাড়ার ওয়াসা রোডে গিয়ে জানা যায়, বিসমিল্লাহ টাওয়ার নামের একটি ৯তলা ভবনে সপরিবার আবেদ আলী থাকেন। ওই বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী সোহেল খান বলেন, আবেদ আলী পঞ্চম তলার একটি ফ্ল্যাটে দুই ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে থাকেন।
ভবনটির পঞ্চম তলায় যেতে চাইলে নিরাপত্তাকর্মী সোহেল আগে ইন্টারকমে আবেদ আলীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ করেন। তিনিই আবেদ আলীর বাসায় ইন্টারকমে যোগাযোগ করে বলেন, তারা সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা বলবেন না।
ওই এলাকার বাসিন্দাদের দাবি, ভবনটিতে আবেদ আলীর ৫টি ফ্ল্যাট ছিল। কয়েক মাস আগে দুটি ফ্ল্যাট তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন রয়েছে তিনটি।
সিআইডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে আবেদ আলী পুলিশ কর্মকর্তাদের বলেছেন, শেওড়াপাড়ার ভবনটির পঞ্চম তলায় দুটি ও চতুর্থ তলায় একটি ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। পাইকপাড়ায় তাঁর একটি ছয়তলা বাড়ি রয়েছে। ব্যাংকে তাঁর নগদ টাকা রয়েছে।
৮. মাদারীপুরের ডাসার উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসাবে প্রচারণা : দুই বছর ধরে সৈয়দ আবেদ আলীকে নিজ এলাকায় বেশ সরব দেখছেন বাসিন্দারা। তিনি ডাসার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থী হতে চান। এ জন্য দীর্ঘদিন ধরে নানাভাবে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এলাকার গরিব-দুঃখীদের দানখয়রাতের পাশাপাশি পোস্টারও সাঁটিয়েছেন। দুই বছর আগে গঠিত ডাসার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল এখনো ঘোষণা করেনি নির্বাচন কমিশন।
৯. ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম ব্যবহার করতেন দামি গাড়ি : সৈয়দ আবেদ আলীর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম বাবার মতো আলোচিত। গত কোরবানির ঈদে তিনি ১ কেজি করে ১০০ জনকে মাংস দিয়েছেন। আর সেই ১০০ কেজি মাংস বণ্টন করেছেন সিয়ামের ব্যবহৃত বিলাসবহুল গাড়িতে চড়ে। সিয়াম শুধু একটি গাড়ি নয়, একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করেন। সিয়াম যেসব গাড়ি ব্যবহার করতেন তার সবই বিলাসবহুল। ভারতে লেখাপড়া করেছে সিয়াম। এরপর বাংলাদেশে এসে একটি ব্যয়বহুল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও। করেন ছাত্রলীগ। নিজ উপজেলা মাদারীপুরের ডাসায় ছাত্রলীগের পদ রয়েছে তার। আলোচিত ও আলোকিত এসব তথ্য আবেদ আলীর ছেলে সিয়াম ও আবেদ আলীর ফেসবুক থেকে পাওয়া।
১০. যেভাবে ফাঁস হয়েছিল পিএসসির প্রশ্ন : বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলীসহ পিএসসির (সরকারি কর্ম কমিশন) বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডি সূত্র জানিয়েছে, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত ছিলেন। তারা একাধিক নন-ক্যাডার পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসেও জড়িত। তাদের সিআইডি কার্যালয়ে এখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) দুজন উপপরিচালক, দুজন সহকারী পরিচালক, পিএসসির আলোচিত সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীও রয়েছেন। সিআইডি সদরদপ্তর সূত্র এ তথ্য দিয়েছে।সিআইডির সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, প্রশ্নফাঁসকারী চক্রটি গত ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত রেলওয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলীর নিয়োগ পরীক্ষাকে বেছে নেয়। এ পরীক্ষা যে প্রশ্নে অনুষ্ঠিত হয় তার একটা কপি পরীক্ষার অন্তত এক ঘণ্টা আগে প্রার্থীদের হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো হয়। পরে ৫ জুলাই সকাল ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত সে প্রশ্নে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
বিপিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম চক্রটির প্রধান বলে জানিয়েছে সিআইডি।
সূত্র জানায়, চক্রের সদস্য উপপরিচালক মো. আবু জাফরের মাধ্যমে দুই কোটি টাকার বিনিময়ে রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করা হয়। তিনি শীর্ষ কর্মকর্তাদের ট্রাঙ্ক থেকে পরীক্ষার আগের দিন তাকে প্রশ্ন সরবরাহ করেন। তিনি সিআইডিকে জানান, ৪৫তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আজাদুর রহমান বলেন, অভিযান চালিয়ে ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরও কে কে এ চক্রের সঙ্গে রয়েছে, তাদেরও গ্রেপ্তার করতে অভিযান চলছে
১১. সরকারি জমি দখল করে আবেদ আলীর ডেইরি ফার্ম/গরুর খামার ও মার্কেট নির্মাণ : পিএসসির প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী মাদারীপুরে নিজ এলাকায় সরকারি জমি দখল করে ডেইরি ফার্ম নির্মাণ করছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। উপজেলা প্রশাসন কাজ বন্ধ করে স্থাপনা সরিয়ে নিতে বললেও তা শোনেননি তিনি।
মঙ্গলবার (৯ জুলাই) মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার কমলাপুর বাজার-সংলগ্ন এলাকায় গিয়ে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা যায়, সৈয়দ আবেদ আলী ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে কয়েক বছর আগে এলাকায় এসে মসজিদ নির্মাণসহ এলাকার বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানে অনুদান প্রদান শুরু করেন। এসব কাজ করে তিনি বেশ পরিচিতি অর্জন করেন। এরপর এলাকায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে একটি ডেইরি ফার্ম করতে ডাসার ইউনিয়নের কমলাপুর বাজার-সংলগ্ন বড় ব্রিজের কাছে সরকারি খাল এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের জমি দখল করেন। ওই জমিতে শতাধিক গরু পালন করা যায় এমন একটি স্থাপনা নির্মাণ শুরু করেন তিনি।
গোপন সংবাদেরভিত্তিতে উপজেলা প্রশাসন বিষয়টি টের পেলে নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরকারি জমির ওপর নির্মিত স্থাপনা সরিয়ে নিতে বললেও আবেদ আলী তা সরিয়ে নেননি। বর্তমানে নির্মাণাধীন ওই স্থাপনাগুলো পতিত অবস্থায় রয়েছে। উপজেলার বালিগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান খান বলেন, আবেদ আলী মাদারীপুরে তেমন কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে না তুললেও কমলাপুর বাজার-সংলগ্ন একটি সরকারি জমিতে ডেইরি ফার্ম নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। তবে উপজেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বর্তমানে ওই ডেইরি ফার্মের কাজ বন্ধ রয়েছে।
১২. পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় রয়েছে তার থ্রি স্টার হোটেল : পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় সান মেরিনা হোটেল নিয়ে সৈয়দ আবেদ আলী তার ফেসবুক আইডিতে গত ১৮ মে পোস্ট দেন। এতে তিনি লেখেন, ‘আমাদের নতুন হোটেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলাম আজ। সমুদ্রকন্যার পাড়ে আজীবন নিজের জন্য একটা থাকার ব্যবস্থা ও একই সঙ্গে একটা হোটেলের মালিকানা অর্জন করতে আপনিও শেয়ার কিনতে পারেন। শেয়ার কিনতে যোগাযোগ করুন।’
তবে মোশারফ হোসেন নামের এক ব্যক্তি নিজেকে সান মেরিনা হোটেলের মূল মালিক হিসেবে দাবি করে বলেন, হোটেলের শেয়ার বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখে একটি শেয়ার কিনতে আগ্রহ দেখান আবেদ। আমার লোকের কাছ থেকে ক্রয়ের বিস্তারিত জেনে যান তিনি। আবেদ আলীকে টাউট প্রকৃতির বলে মনে হয়েছে। এ বিষয়ে থানায় জিডি করব।
সম্প্রতি দেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে বিসিএসসহ ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের তথ্য। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (বিপিএসসি) ছয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর একটি সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। সেই অভিযুক্ত কর্মচারীদের একজন পিএসসি চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী।
এদিকে সোমবার (৮ জুলাই) রাতে সিআইডির পক্ষ থেকে রাজধানীর পল্টন থানায় বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন আইনে এই মামলা দায়ের করা হয়। মামলা নং ১৫। মামলায় আসামির সংখ্যা অর্ধ শতাধিক দেখানো হয়েছে। আর গ্রেফতার দেখানো হয়েছে ১৭ জনকে।
মন্তব্য করুন