দেশের খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ, লেখক, গবেষক ও তাত্ত্বিক বদরুদ্দীন উমরের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছে সর্বস্তরের মানুষ।
সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তার মরদেহ আনা হয়। শেষবারের মতো তাকে শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে ভিড় করেছে হাজারো মানুষ।
এদিন বদরুদ্দীন উমরের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উপস্থিত হন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ ও উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বদরুদ্দীন উমরের মরদেহ নেওয়া হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে। এরপর বাদ জোহর জানাজার পর জুরাইন কবরস্থানে বদরুদ্দীন উমরকে তার মা-বাবার কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হবে।
এর আগে, রোববার (০৭ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টা ৫ মিনিটে রাজধানীর শ্যামলীতে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) মুক্তিকামী মানুষের আন্দোলন সংগ্রামের অন্যতম এই অগ্রনায়ক। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন প্রবীণ এই বামপন্থি নেতা। তার বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর।
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম জানান, গত প্রায় এক মাসে বদরুদ্দীন উমরকে একাধিকবার হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। গতকাল সকালে অবস্থা গুরুতর হলে দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়, তবে চিকিৎসকরা আর বাঁচাতে পারেননি।
পরিবার ও জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আজ সোমবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তার মরদেহ রাখা হবে। বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা শেষে জুরাইন কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
তিনি স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে রেখে গেছেন। বড় মেয়ে বর্তমানে লন্ডনে বসবাস করছেন, বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে জানাজায় অংশ নিতে তিনি দেশের পথে রওনা হয়েছেন। ছোট মেয়ে সারা আকতার বাবার সঙ্গেই থাকতেন।
বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ অনেক নেতা, বিভিন্ন বামপন্থি সংগঠন ও লেখক-চিন্তাবিদরা।
১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর বর্তমান ভারতের বর্ধমানে জন্ম নেন বদরুদ্দীন উমর। বাবা আবুল হাশিম ছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক এবং পাকিস্তান আন্দোলন সময়কার অন্যতম নেতা। রাজনৈতিক ও প্রগতিশীল পরিবারে বেড়ে ওঠায় শৈশব থেকেই সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে সচেতন হয়ে ওঠেন বদরুদ্দীন উমর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর উচ্চশিক্ষার জন্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সেখান থেকে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি (পিপিই) বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরে দেশে ফিরে শিক্ষকতায় যোগ দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও খুব দ্রুতই তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী শিক্ষক হন। সেখানে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব তার। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতির আলো ছড়িয়ে দিতে তার ভূমিকা ছিল অগ্রণী।
ষাটের দশকের শেষ দিকে সামরিক শাসন ও দমননীতির প্রতিবাদে তিনি শিক্ষকতার পদ ছেড়ে সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত তার গ্রন্থ ‘সাম্প্রদায়িকতা’, ১৯৬৭ সালে ‘সংস্কৃতির সংকট’ এবং ১৯৬৯ সালে ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ তৎকালীন পূর্ব বাংলার সমাজে ব্যাপক আলোড়ন তোলে।
১৯৬৮ সালে মোনায়েম খানের দমননীতির প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আসেন। এর পর থেকে আজীবন ছিলেন রাজনীতি, আন্দোলন ও তাত্ত্বিক চর্চায় নিবেদিত।
দেশের বাম রাজনীতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন বদরুদ্দীন উমর। তিনি বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন দীর্ঘদিন। একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেন। এক সময় পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।
২০০৩ সালে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল গঠন করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এ সংগঠন বামপন্থি রাজনীতিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে এসেছে। বদরুদ্দীন উমরের লেখালেখি বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক চিন্তাধারার ভান্ডারে অমূল্য সংযোজন। ভাষা আন্দোলন নিয়ে তার রচিত ‘পূর্ববঙ্গের ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ (তিন খণ্ড) গবেষণা গ্রন্থটি এখনো অন্যতম প্রামাণ্য দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়।
এ ছাড়া তার অসংখ্য বই ও প্রবন্ধ রয়েছে; যেগুলোতে সাম্রাজ্যবাদ, শ্রেণিসংগ্রাম, কৃষক আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, নারী মুক্তি, সংস্কৃতি ও রাজনীতির সম্পর্ক নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। তার গবেষণা শুধু একাডেমিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং রাজনীতির মাঠেও এসব চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।
বদরুদ্দীন উমর রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের ব্যাপারে সব সময় স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি নিজের তাগিদে, নিজের আনন্দে বই লিখি। এর জন্য রাষ্ট্র আমাকে পুরস্কার দেবে, এটা আমি গ্রহণ করতে পারি না।’
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এ বছর তাকে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত করলে সেটিও তিনি নেননি। তার যুক্তি ছিল, রাষ্ট্র যদি জনগণের স্বার্থে কাজ না করে, তবে সেই রাষ্ট্রের দেওয়া পুরস্কার গ্রহণ করা তার নীতির পরিপন্থি। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বদরুদ্দীন উমর ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে তিনি সাক্ষ্য দিলেও ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দেওয়ার সুযোগ হয়নি। আইন অনুযায়ী তার দেওয়া সাক্ষ্য প্রমাণ হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।
বদরুদ্দীন উমরের জীবনে বিতর্কও কম ছিল না। মুক্তিযুদ্ধকালীন চরম বাম রাজনীতির ভূমিকা এবং স্বাধীনতার পর সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার কারণে নানা সময়ে সমালোচিত হয়েছেন। তবে তিনি সবসময় বলেছেন, তার অবস্থান ছিল জনগণের মুক্তির সংগ্রামে। ইতিহাসই একদিন এর সঠিক বিচার করবে।
মন্তব্য করুন