ট্রান্স নারী পরিচয়ের কারণে আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নিতে বাধার মুখে পড়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন হোচিমিন ইসলাম। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির (এনএসইউ) শিক্ষার্থী ও কিছু শিক্ষকের আন্দোলনের কারণে এ ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়। ঘটনার একদিন পর এনএসইউ হোচিমিন ইসলামকে অংশগ্রহণ না করতে দেওয়া নিয়ে গত দুই দিন ধরে চলা আলোচনা-সমালোচনায় বিবৃতি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
রোববার (২৬ নভেম্বর) এক বিবৃতিতে এনএসইউ কর্তৃপক্ষ জানায়, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি শিক্ষার মান ধরে রাখার পাশাপাশি সকলের জন্য একটি সম্মানজনক পরিবেশ বজায় রাখতে সচেষ্ট। তবে সাম্প্রতিককালে উইমেনস ক্যারিয়ার কার্নিভ্যালে ঘটে যাওয়া ঘটনায় এই লক্ষ্য অর্জন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি জানিয়েছে, আমরা এই অনুষ্ঠানে হোচিমিন ইসলামের অংশগ্রহণ বিষয়ে জনগণের ভিন্ন মতামতকে সম্মান করি। এই দৃষ্টিভঙ্গিগুলো আমাদের সমাজের বিভিন্ন বিশ্বাস এবং মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করে। দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তৃতি ও সংলাপকে উৎসাহিত করতে এনএসইউ শিক্ষার শক্তিতে বিশ্বাস করে। হোচিমিনের অংশগ্রহণের উদ্দেশ্য ছিল কর্মক্ষেত্রে প্রান্তিক সম্প্রদায়ের অর্জন তুলে ধরা। তবে, এই ঘটনাটি কোন প্রেক্ষাপটে ঘটেছে সেটিও গুরুত্বপূর্ণ।
হোচিমিন ইসলাম এই অনুষ্ঠানের অন্যতম বক্তা ছিলেন। কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনার ফলে নির্ধারিত আলোচনা বাতিল করা হয়। বক্তা এবং আয়োজক উভয়ের জন্য দুঃখজনক এই ঘটনাকে এনএসইউ বিবেচনায় নিয়েছে। এরপর, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে সমালোচনা হচ্ছে আমর এই প্রতিক্রিয়া গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন করি। আমরা ভবিষ্যতে এই অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাগুলো বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তাও স্বীকার করি কিন্তু আমাদের নজরে এসেছে, এই ঘটনা সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। আমরা স্পষ্ট করতে চাই, সিপিসি এবং ইভেন্টের আয়োজক, হিরোস ফর অল (এইচএফএ) এবং আই-সোশ্যালের মধ্যে সকল যোগাযোগ হয়েছিল। আমরা হিরোস ফর অল (এইচএফএ) এবং আই সোশ্যালকে তাদের অনুষ্ঠান সফলভাবে সম্পন্ন করায় ধন্যবাদ জানাই।
দুই দিনব্যাপী ‘উইমেন্স ক্যারিয়ার কার্নিভাল’-এর এই অনুষ্ঠান শুক্রবার (২৪ নভেম্বর) শুরু হয়। অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে ‘হিরোস ফর অল (এইচএফএ)’ ও ‘আই-সোশ্যাল’। অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য নেটওয়ার্কিং, লার্নিং এবং পেশাগত উন্নয়নের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন।
এদিকে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে না পারার বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে হোচিমিন জানিয়েছেন— কীভাবে আয়োজক ও নর্থ সাউথ কর্তৃপক্ষ একাধিকবার যোগাযোগের মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত নেন, হোচিমিনের অনুষ্ঠানস্থলে যাওয়া নিরাপদ নয় এবং কর্তৃপক্ষও কোনো নিরাপত্তা দিতে পারবে না। পরে তিনি নিজে থেকেই আয়োজকদের কোনো অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলতে চান না বলে জানান।
হোচিমিনের লেখাতেই উঠে আসে— কীভাবে ‘ইসলামিক প্র্যাকটিশনার ফর এনএসইউ’ নামের একটা ফেসবুক পেজে ভিসিকে ইমেইল করে বলা হয়, হোচিমিন বাংলাদেশের আইন অমান্য করে ক্রিমিন্যাল অ্যাক্টিভিটিজ করছেন। সেখানে সমকামিতাকে প্রচার করা হচ্ছে বলেও উল্লেখ করা হয়। এমনকি মেইলে এ নিয়ে ‘স্টুডেন্টরা প্রটেস্ট করছে’, তারা এক্সাম বয়কট করবে, এমনকি দাঙ্গাও হতে পারে বলে হুমকি দেওয়া হয়।
আয়োজক ‘হিরো’স ফর অল’-এর প্রতিষ্ঠাতা রেহনুমা করীম গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, হোচিমিনের সেশন বাদ দিয়েই তাদের অনুষ্ঠান করতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘হোচিমিনের সেশন ও ছবিসহ পোস্টার করার পর থেকেই নর্থ সাউথের ভেতর ও বাইরের কিছু গ্রুপ হুমকি দিতে শুরু করে। তারা এও বলে— আমি পশ্চিমা সংস্কৃতি থেকে ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুটা বাংলাদেশে আনার চেষ্টা করছি এবং এটা বাংলাদেশের আইনের পরিপন্থি। এসব আমেরিকান ধ্যানধারণা। তারপরও আমরা এটা করতে চেয়েছি এবং কর্তৃপক্ষ শুরুতে নিরাপত্তা দেওয়ার কথা জানালেও পরে শিক্ষার্থী এবং হোচিমিনের নিরাপত্তার কথা ভেবে তারা সেটা করতে পারলেন না। আমরা এমন পরিস্থিতি আশা করিনি।’
তিনি বলেন, ‘এই উইমেন্স কার্নিভালের জন্য নর্থ সাউথ তাদের ভেন্যুটা ব্যবহার করতে দিয়েছে। পরে পরিস্থিতি দেখে হোচিমিন সিদ্ধান্ত নেন, এত বিরোধিতার মধ্যে এখানে যাওয়া ঠিক হবে না।’
কার্নিভালে না যেতে পারার প্রসঙ্গে হোচিমিন ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাকে তো ধর্মের দোহাই দিয়ে ঢুকতেই দিল না, কথাটাই শুনল না। আগে শুনতো, তারপর বিরোধিতা করত। তারা ধর্মের দোহাই দিল। অথচ ওখানে অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন গেলেন। চিরকুট ব্যান্ডের সুমী গেলেন। আমিতো অধিকার নিয়ে কথা বলি। আমি সমকামিতাকে প্রমোট করছি না। ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকার নিয়ে কথা বলি। আমার কথা শুনেই না হয় বিরোধিতা করত।’
এ প্রসঙ্গে নারী অধিকারকর্মী ফারহানা হাফিজ তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘নর্থ সাউথ কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি আমি আয়োজকদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে চাই। যে কোনো পাবলিক পরিসরে যে কোনো লিঙ্গ বৈশিষ্ট্যের মানুষের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ বাংলাদেশের সংবিধানের পরিপন্থি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য একটি ভিন্ন খসড়া আইন যেখানে প্রক্রিয়াধীন, সেখানে নর্থ সাউথ কর্তৃপক্ষ বা আয়োজকরা শিক্ষার্থীদের অসংবেদনশীল ও অসহযোগিতামূলক আচরণের দোহাই দিয়ে হোচিমিন বা যে কোনো ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির প্রবেশাধিকার বন্ধ রাখার এখতিয়ার রাখে না।’
মন্তব্য করুন