১৯৬৯ সালের ১২ আগস্ট জন্মের পর পবিত্র আরাফাত ময়দানের নামানুসারে ছেলের নাম আরাফাত রহমান রেখেছিলেন বাবা জিয়াউর রহমান। হাজিদের কষ্ট লাঘবের জন্য পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান আরাফার ময়দানে নিমগাছ রোপণ করেন। আরবরা এই গাছের নাম দিয়েছে ‘জিয়া ট্রি’। বাসায় আরাফাতকে আদর করে কোকো নামেই ডাকা হতো। এ ছাড়া তার আরেকটি নাম ছিল দোদো। বাবার খুবই প্রিয় ছিল এই লাজুক ছোট ছেলেটি। আর মায়ের কাছে আদরের ছোট মানিক। বাবার মতো শ্যামবরণ গায়ের রঙ আর কি গভীর মায়াময় ছিল চোখের চাহনি। বিনয়ী ও শান্ত স্বভাবের আরাফাত রহমান কোকো নিজেকে আড়ালে রাখতেই বেশি পছন্দ করতেন। কোনোভাবেই আলোচনায় থাকতে চাইতেন না তিনি। কিন্তু আল্লাহ তাআলা এটাই নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। ব্যক্তিজীবনে খুবই সাদামাটা কোকোভাইয়ের পুরোটা জীবন ছিল বৈচিত্র্যময়।
১৯৭১ সাল। বাবা জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে। স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন সম্মুখ সমরে। যুদ্ধের ডামাডোলে বড়ভাই পিনো আর মায়ের সঙ্গে ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে ছিলেন বন্দি। একদিন ছোট্ট কোকো একটু দূরে খেলা করছিলেন আর বড়ভাই তারেক রহমান বসে ছিলেন মায়ের পাশে। হঠাৎ মায়ের মনে কী হলো, তিনি গিয়ে ছোট ছেলেকে কোলে তুলে সেখান থেকে নিয়ে এলেন আর পরমুহূর্তেই একটা মর্টার শেলের আঘাতে হুড়মুড় করে ছাদ ভেঙে ধসে পড়ল; কোকো যেখানটায় খেলছিলেন ঠিক সেই জায়গায়। সেদিনকার মতো প্রাণে বেঁচে যান তিনি।
ছোটবেলায় খুবই দুরন্ত ছিলেন কোকো। ‘সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান’ সিরিজ দেখে নিজেকেও তাই ভাবতেন। কল্পনা করতেন তিনি অন্য গ্রহ থেকে এসেছেন রকেটে করে। একবার তো সিঁড়ির ওপর থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে পা ভেঙে বসলেন। এরপর তাকে নিয়ে হাসপাতালে ডাক্তারের কাছে দৌড়াদৌড়ি, সে এক হুলুস্থুল কাণ্ড। ছোটবেলায় প্রায়ই তিনি খাট থেকে মেঝেতে পড়ে যেতেন। ঘরের মেঝেতে কার্পেট না থাকায় শক্ত মেঝেতে পড়ে পড়ে মাথাটা হয়েছিল খুবই শক্ত। আবার পা দিয়ে গাড়ি আটকানোর ছেলেমানুষি চেষ্টা করতেন তিনি। আর সারাদিন ক্রিকেট খেলা। কিন্তু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব দুরন্তপনা চলে গিয়ে কোকো হয়ে যান একেবারে শান্ত।
শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলেন শহীদ আনোয়ার স্কুলে। এরপর বড়ভাই তারেক রহমানের সঙ্গে রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে পড়াশোনা করেন। ১৯৮১ সালে বাবা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতিতে যোগ দিয়ে জাতীয়তাবাদী দলের হাল ধরলে মা তাকে পাঠিয়ে দেন চাচার কাছে যুক্তরাজ্যে। এখান থেকেই তিনি ও লেভেল শেষ করে আমেরিকা চলে যান। আমেরিকা থেকে এ লেভেল শেষ করেন। এরপর তিনি অস্ট্রেলিয়া থেকে সিভিল এভিয়েশনে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন। রেজিস্টার্ড পাইলট ছিলেন কোকো। কিন্তু মা ভয় পেতেন বলে আর পাইলট হিসেবে যোগ দেওয়া হয়ে ওঠেনি। ফিরে এলেন প্রিয় মাতৃভূমি মায়ের কোলে বাংলাদেশে। ভালোবাসতেন দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাতে। যেন উড়োজাহাজকে হারিয়ে দিতে চাইতেন তিনি। লেদার জ্যাকেট আর সানগ্লাস পরা যুবকটিকে দেখলে বোঝাই যেত না যে, বুঝতে শেখার পর থেকে কোনো দিন রোজা বাদ দেননি। নামাজ পড়তেন নিয়মিত। ধর্মীয় রীতিবিরুদ্ধ বলে জন্মদিনের কেক কাটতে চাইতেন না তিনি।
বাবার মতোই খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন। খেতেন খুব অল্প পরিমাণে। হৈ-হুল্লোড়, জোরে মিউজিক পছন্দ করতেন না। নিরিবিলি জীবন পছন্দ করতেন তিনি। ভাবিদের পীড়াপীড়িতে একবার কনসার্টে গিয়ে কিছুক্ষণ পরই রেগেমেগে বললেন, আমাকে এ কোথায় নিয়ে এলেন। শেষে বিরক্ত হয়ে মোবাইলে গেম খেলে সময় কাটালেন। ভাবিদের কাছে ছিলেন আদরের ছোটভাই। মাতিয়ে রাখতেন তাদের। নিয়মিত খেলাধুলা করতেন কোকো। নিজে ক্রিকেটপাগল হলেও ফুটবলে তার প্রিয় দল ছিল ব্রাজিল। বিশ্বকাপ এলে প্রবল উৎসাহে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ব্রাজিলের খেলা দেখতেন।
ক্রীড়াপ্রেমী আরাফাত রহমান কোকো ‘ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান’ থাকাকালীন বিসিবিকে নিয়ে গেছেন অন্য এক উচ্চতায়। তার দক্ষ নেতৃত্বে হাঁটি হাঁটি পা পা করে বাংলাদেশের ক্রিকেট পদার্পণ করেছিল আন্তর্জাতিক পরিসরে। আরাফাত রহমান কোকোর হাত ধরেই আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড় তৈরি করেছে বিকেএসপি। আজকের বিশ্বসেরা সাকিব, তামিম, মুশফিকরা তারই হাতেগড়া। ওল্ড ডিওএইচএসের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ ক্রিকেটে তার অসামান্য অবদান স্বীকার করতেই হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর উদ্যোগে বগুড়ায় আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম তৈরি করা হয়। শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম নিয়ে বগুড়াবাসী যেমন গর্বিত তেমনি কোকোর স্থান তাদের হয়েছে হৃদয়ের মণিকোঠায়।
হৃদয় ভরা ভালোবাসা নিয়ে জন্মেছিলেন কোকো। আর পেয়েছেনও সবার ভালোবাসা। বাবা-মায়ের আদরের সন্তান আর বড়ভাই তারেক রহমানের প্রাণের অধিক প্রিয় ছোটভাই। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন শামিলা রহমান সিঁথিকে। ছিলেন প্রাণপ্রিয় স্বামী আর দুই কন্যাসন্তানের গর্বিত বাবা।
রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম হলেও বরাবরই তিনি থেকেছেন রাজনীতি থেকে অনেক দূরে। রাজনীতি তিনি করতেনও না, রাজনীতি বুঝতেও চাইতেন না। অসম্ভব শান্তিপ্রিয় একজন সদালাপী মিশুক মানুষ ছিলেন তিনি। আর তাই তো বন্ধুবৎসল কোকো ছিলেন সবার প্রিয়। সাদামাটা একটি ছেলে প্রথম দেখায় তেমন আলাদা মনে না হলেও তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি কারও নজর এড়াত না। ছিল বাবার মতো ভরাট গলা আর অসম্ভব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতেন তিনি। আর নেতৃত্ব দেওয়ার সহজাত গুণের কারণে বন্ধুমহলে ছিলেন খুবই জনপ্রিয়।
রাজনৈতিক কোনো অভিলাষ না থাকলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে রাজনীতির বলি হতে হয় আরাফাত রহমানকে। ২০০৭ সালে তাকে গ্রেপ্তার করে চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। জড়ানো হয় ষড়যন্ত্রমূলক বিভিন্ন মামলায়। তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় নির্ভীক কোকো অফিসারদের ভরাট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমাকে নিতে এসেছেন? কোথায় যেতে হবে? চলেন...
কিন্তু গাড়িতে তুলেই তার হাত পেছনে নিয়ে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে দেয় আর কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে ফেলে। এরপর রিমান্ডে নিয়ে চালাতে থাকে অমানুষিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। দুই ভাইকে রাখা হয় একই জেলখানার দুই ব্লকে। যাতে করে জেলখানার ভেতরে দুই ভাইয়ের সাক্ষাৎ না হয়। টগবগে তরুণ কোকোকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়, আর ২০০৮ সালে জেল থেকে বের করা হয় হুইলচেয়ারে করে।
খুব ভালো ছবি তুলতেন কোকো। তার অসাধারণ ফটোগ্রাফি সত্যি যে কাউকে বিমোহিত করবে। প্রকৃতির ছবি তুলতেই বেশি ভালোবাসতেন তিনি। মালয়েশিয়ার নির্বাসিত জীবনে বড্ড অভিমানী এ মানুষটি ফটোগ্রাফিকেই একমাত্র সঙ্গী করেছিলেন। বন্দি জীবনের অপমানের কষ্ট কিছুতেই ভুলতে না পেরে অনেকটা নিঃসঙ্গ নিভৃত জীবন কাটিয়েছেন আরাফাত রহমান। কোনো অপরাধ না করেও মিথ্যা অভিযোগের বোঝা তাকে অকালমৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। তার এই অকালপ্রয়াণ ছুঁয়ে যায় প্রতিটি হৃদয়বান মানুষের মন। তার জানাজায় শরিক হতে সাধারণ মানুষের ঢল নামে। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো প্রতিটি জনস্রোতের লক্ষ্যস্থল ছিল একটাই বায়তুল মোকাররম মসজিদ। এই জনসমুদ্রের দোয়া আরাফাত রহমানের জন্য। এই জনসমুদ্রের ভালোবাসা ও সহমর্মিতা জিয়া পরিবারের জন্য।
ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে বাবার আদর থেকে হয়েছেন বঞ্চিত। পড়াশোনার জন্য দীর্ঘদিন বিদেশে থাকায় আর সবশেষ রাজনীতির বলি হয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রাণপ্রিয় মা এবং বড়ভাইয়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত থেকেছেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর কোটি মানুষের হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা প্রমাণ করে দিয়েছে আসলে তিনি কারও ভালোবাসা থেকে বিন্দুমাত্র বঞ্চিত হননি। তিনি আছেন লাখো কোটি মানুষের হৃদয়ে।
লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী মিডিয়া কর্মী
মন্তব্য করুন