কালবেলা ডেস্ক
প্রকাশ : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:১৫ এএম
আপডেট : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৪:৫৫ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
বিশেষ সাক্ষাৎকারে সাকিফ শামীম

ল্যাবএইডে হচ্ছে বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা

ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাকিফ শামীম। ছবি: কালবেলা
ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাকিফ শামীম। ছবি: কালবেলা

ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাকিফ শামীম। সম্প্রতি ফোর্বস মোনাকো ম্যাগাজিনে পারসন অব দ্য ইয়ার হিসেবে সম্মানিত হয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে এ সম্মাননা পেয়েছেন। এর আগেও সাকিফ শামীম আরও অনেক পুরস্কার অর্জন করেছেন। এশিয়াস গ্রেটেস্ট ব্র্যান্ডস অ্যান্ড লিডারস অ্যাওয়ার্ড এবং লিডারশিপের জন্য ফোর্বস এশিয়া ১০০-এ তালিকাভুক্ত হওয়া তার অন্যতম। বাংলাদেশে ক্যানসার চিকিৎসা ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার নানা দিক নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা হয় তার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পলাশ মাহমুদ।

কালবেলা: বাংলাদেশে বর্তমানে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। প্রতিবছর নতুন দুই লাখ ক্যানসার রোগী শনাক্ত হচ্ছেন। ক্যানসারে প্রতিবছর মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। বাংলাদেশে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা দিনে দিনে এত বৃদ্ধি পাচ্ছে কেন?

সাকিফ শামীম: বাংলাদেশে এত বেশি মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পেছনে প্রথম কারণ হয়তো পরিবেশগত বিপর্যয়। বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাসও ক্যানসারের জন্য অনেকটা দায়ী। বর্তমানে মানুষ ফাস্টফুড, কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার স্যাচুরেটেড ফ্যাট জাতীয় খাবার বেশি পরিভোগ করছেন। এ ছাড়া খাদ্যে ভেজালের পরিমাণও অনেক বেশি। খাদ্যে ব্যবহৃত রং এবং অন্যান্য অনেক বিষাক্ত উপাদান নিয়মিত মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। পাশাপাশি অ্যালকোহল গ্রহণ এবং ধূমপানের কারণে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া মানুষের শারীরিক পরিশ্রম অনেকটা কমে গেছে বলা যায়, কেননা যখন মানুষের শারীরিক পরিশ্রম কমে যায় তখন ক্যানসার বা এ জাতীয় রোগগুলো অনেক বেশি দেখা যায়। ক্যানসারের জন্য লাইফস্টাইল অনেকাংশে দায়ী। বলা যায় বাংলাদেশে ক্যানসার রোগীদের মধ্যে ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। এর প্রধান কারণ ঢাকার বাতাসে দূষণের পরিমাণ অনেক বেশি। মূলত লাইফস্টাইল, ভেজাল খাবার, খাদ্যাভ্যাস এবং পরিবেশ—সবগুলো উপাদানই ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ার পেছনে ভূমিকা রাখছে।

কালবেলা: প্রতিবছর ১৩ হাজার শিশু ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে। শিশুদের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বাড়ছে কেন?

সাকিফ শামীম: এ বিষয়ে ভালো তথ্য দিতে পারবেন বিশেষজ্ঞ বা গবেষকরা তবে শিশু ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির বড় একটি কারণ জেনেটিক মিউটেশন এবং মডিফিকেশন বলে আমার ধারণা। বাবা-মায়ের লাইফস্টাইল, খাদ্যাভ্যাসের কারণেও অনেক সময় সন্তান শারীরিক নানা ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে থাকে। ক্যানসার, ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক বা এ জাতীয় অনেক রোগ রয়েছে, যেগুলো বাবা-মায়ের লাইফস্টাইলের সঙ্গে সম্পর্কিত। শুধু বাবা বা মা নয়, পূর্বপুরুষদের থেকেও জিনগত কারণে ক্যানসারের জীবাণু শরীরে থাকতে পারে। অর্থাৎ এখানে জেনেটিক মডিফিকেশনের দায় রয়েছে। পরে প্রজন্মের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারছি কি না এটা নিয়ে এখনই ভাবার সময়।

কালবেলা: ল্যাবএইড বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ক্যানসার হাসপাতাল চালু করেছে। এর মধ্য দিয়ে ক্যানসার চিকিৎসায় বাংলাদেশ কতটুকু এগিয়ে গেল বলে মনে করেন?

সাকিফ শামীম: ক্যানসার চিকিৎসায় এগিয়ে যাওয়ার জন্য অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সমন্বয় করে একটি উপযুক্ত চিকিৎসাক্ষেত্র তৈরি করেছি আমরা। দেশি-বিদেশি উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে ভালো ক্লিনিশিয়ান ও নার্স তৈরি করে চলেছি প্রতিনিয়ত। গত তিন বছরে প্রায় ১ লাখ মানুষকে ক্যানসারের চিকিৎসাসেবা দিয়েছি। ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারে চিকিৎসা নেওয়া ক্যানসার রোগীর সারভাইভাল রেট আমেরিকা, ইংল্যান্ডের মতো উন্নত দেশের সমপরিমাণ। আমাদের নিজস্ব মেডিকেল রেকর্ডের তথ্যমতে প্রায় ৮০ শতাংশ রোগী সুস্থ হয়েছেন। এ ছাড়া আমাদের হাসপাতালে অপারেশনের পর ইনফেকশনের হার এক শতাংশ যা সিঙ্গাপুর ও অন্যান্য দেশের চেয়ে কম। বাংলাদেশে রেডিওথেরাপির মেশিন রয়েছে ৩৫টির কাছাকাছি অথচ যে পরিমাণ জনগোষ্ঠী, তাতে রেডিওথেরাপির মেশিন দরকার ১৫০টি।। রোগীর তুলনায় ডাক্তার এবং নার্সের রেশিও এখনো অনেক কম। ১০ হাজার রোগীর বিপরীতে মাত্র একজন ডাক্তার রয়েছেন দেশে। নার্স রয়েছেন আরও কম। ক্যানসারের চিকিৎসা খুব জটিল একটি প্রক্রিয়া। সাধারণত ক্যানসারের প্রাথমিক স্টেজে কোনো রোগী ক্যানসার চিকিৎসা নিতে আসেন না। শরীরে কোথাও গোটা বা এমন কিছু হলে যেটা ক্যানসারের সঙ্গে সম্পর্কিত কিন্তু মানুষ সেটা বুঝতে না পেরে মেডিসিন ডাক্তার অথবা সার্জেনের কাছে গিয়ে সার্জারি করে ফেলেন। গ্রামে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের কাছে যান। এসব কারণে ক্যানসার শনাক্ত হতে অনেক দেরি হয়ে যায়। অথচ ক্যানসারের ক্ষেত্রে দ্রুত শনাক্তকরণ সবচেয়ে বেশি জরুরি। আমাদের হাসপাতালে ক্যানসার শনাক্তকরণের জন্য যাবতীয় সুবিধা রয়েছে। ক্যানসার হাসপাতালে প্রোপার মডিউল রয়েছে। ল্যাব এইড ক্যানসার হাসপাতালে টিউমার বোর্ড রয়েছে, যেখানে ক্যানসার চিকিৎসার জন্য একজন সার্জেন্ট, একজন মেডিকেল অনকোলজিস্ট, রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট এমনকি সাইকিয়াট্রিস্টও থাকেন। এভাবে আমরা সমন্বিত চিকিৎসাসেবার মাধ্যমে ক্যানসারের আন্তর্জাতিকমানের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করছি। প্রকৃতপক্ষে ক্যানসার চিকিৎসা একটি সমন্বিত চিকিৎসা প্রক্রিয়া। যেটা অনেক ব্যয়বহুল এবং সময় সাপেক্ষ। আমাদের মতো এমন আরও অনেকে যদি উদ্যোগ গ্রহণ করে এগিয়ে আসেন, এরকম আরও ১৫টি ক্যানসার হাসপাতাল তৈরি হয়, তাহলে আশা করি ক্যানসার চিকিৎসায় বিদেশের ওপর নির্ভরতা অনেকাংশে কমে আসবে। একটু পিছনে ফিরে তাকালে কার্ডিয়াক চিকিৎসায় ১০ বছর আগেও বিদেশে যেতে হতো বাংলাদেশের মানুষের। এখন আর বিদেশে যেতে হয় না। আশা করি আগামী ১০ বছর পরে ক্যানসার চিকিৎসায়ও বাংলাদেশের মানুষের আর বিদেশমুখী হতে হবে না।

কালবেলা: বাংলাদেশ ক্যানসার চিকিৎসায় ডাক্তার সংকটের কথা বলছিলেন আপনি। এই সংকট কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যেতে পারে?

সাকিফ শামীম: কিছুদিন আগেও দেশে মাত্র একটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করানো হতো। এখন আরও দু-এক জায়গায় পোস্ট গ্রাজুয়েশন করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সরকার ধীরে ধীরে মেডিকেল শিক্ষাকে বিকেন্দ্রীয়করণ করছে। বাংলাদেশে অনেক বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। সেগুলোতেও যদি পোস্ট গ্রাজুয়েশন করার ব্যবস্থা করা যায় বা সমন্বিতভাবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় যদি পোস্ট গ্রাজুয়েশন করানোর উদ্যোগ নেওয়া হয় তাহলে হয়তো আরও ক্যানসারের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি হবেন। বিদেশি অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের সঙ্গে চিকিৎসাসেবায় কাজ করতে আগ্রহী। তাদের বাংলাদেশের হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজ ও ইউনিভার্সিটিগুলোর সঙ্গে কাজ করার ব্যবস্থা করে দেওয়াটা জরুরি বলে মনে করি। চিকিৎসাসেবায় মানের দিকে দৃষ্টি দেওয়া এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। পূর্বে একটি গদবাধা ধারণা ছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো পড়াশোনা হয় এবং প্রাইভেটে ভালো পড়াশোনা হয় না। কিন্তু সেই ধারণাটি এখন অনেকাংশে বদলে যাচ্ছে। মেডিকেল কলেজের ক্ষেত্রেও মানুষের একই ধারণা, সরকারি মেডিকেল কলেজের ডাক্তাররাই ভালো হয়। এই ধারণা বদলাতে হবে। আর ধারণা বদলানোর জন্য প্রাইভেট মেডিকেল কলেজগুলোয় পড়াশোনার মান ভালো করতে হবে। মেডিকেল সায়েন্সের জন্য গবেষণা অনেক জরুরি। তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের ক্যানসার হাসপাতালে ছোট ছোট কিছু গবেষণা করার ব্যবস্থা করেছি আমরা। ছোট ছোট ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ব্যবস্থাও রয়েছে। রিসার্চের জন্য অনেকে সহযোগিতা করতে চায় তাদের জন্য নিয়ম-কানুনগুলো সহজ করা গেলে ক্যানসার চিকিৎসায় অনেক সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব বলে আশা করি।

কালবেলা: বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১৩ হাজার শিশু ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে এবং এর বেশিরভাগই নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তান। ক্যানসার চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল সেখানে দরিদ্র মানুষের জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়?

সাকিফ শামীম: রোগ ধনী বা গরিব বাচ-বিচার করে আসে না, সচেতনতাই মুখ্য একটি বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় নিম্ন মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র শ্রেণির মানুষের মধ্যে তুলনামূলকভাবে বেশি সচেতনতার অভাব রয়েছে। ৪০ বা ৫০ বছর বয়সের বেশি হয়ে গেলে পুরুষের ক্ষেত্রে প্রোস্টেট ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। প্রতিবছর যদি এই বয়সের মানুষ পিএসএ-নামের একটি ছোট টেস্ট করান তাহলে প্রাথমিক স্টেজে প্রোস্টেট ক্যানসার শনাক্ত করা সম্ভব। এই টেস্টের মূল্য মাত্র ৪০০ টাকার মতো। ৪০ বছর পর মানুষের উচিত একটি কোলনোস্কপি করা। এই সচেতনতাগুলো অনেকের মধ্যে নেই। এদিকে সারভাইক্যাল ক্যানসার দরিদ্র শ্রেণির মানুষের মধ্যে বেশি দেখা যায়। কারণ এটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ওপর অনেকটা নির্ভর করে। যদি হাইজিন মেনটেইন করা হয় তাহলে এই প্রবণতা অনেকাংশে কমে যায়। প্রথমে সবার উচিত সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মাইন্ড সেটআপ ডেভেলপ করা। এ ছাড়া একটি বড় সমস্যা হলো চিকিৎসার জন্য কোনো বাজেট না থাকা। যতদিন মানুষ চিকিৎসার জন্য আলাদা বাজেট না রাখতে পারবেন ততদিন সমস্যাও পিছু ছাড়বে না। প্রত্যেক পরিবারের জন্য একটি হেলথ কেয়ার বাজেট থাকা জরুরি। দরিদ্র শ্রেণির মানুষের জন্য আমাদের একটি বড় উদ্যোগ রয়েছে। অপরাজয়ী আবাসন নামে আমাদের একটি ব্যবস্থা রয়েছে যেখানে আমরা একেবারে সর্বনিম্ন খরচে প্যালিটিভ রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছি। সেখানে ক্যানসার রোগীদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। রেডিওথেরাপি থেকে শুরু করে সার্জারি সবকিছুতেই দরিদ্র রোগীদের জন্য একটি আলাদা প্যাকেজের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতালে। এই প্যাকেজের অধীনে প্রায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ শতাংশ চিকিৎসা খরচ মওকুফ পেয়ে থাকেন তারা। এ ছাড়া আমাদের ল্যাবএইড ফাউন্ডেশন রয়েছে, আমি নিজে সেখানকার জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্বে রয়েছি। এই ফাউন্ডেশনের আওতায় বছরে প্রায় এক থেকে দেড় হাজার ক্যানসার রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকি।

কালবেলা: সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ক্যানসারের চিকিৎসা ব্যয় কমাতে সরকার কি কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে?

সাকিফ শামীম: ক্যানসারের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। এটা একটি জেনোমিক ডিসঅর্ডার। ক্যানসার চিকিৎসায় আমেরিকা বা সিঙ্গাপুর যে পদ্ধতিতে চিকিৎসা করে, তাদের মতো আমরাও একই গাইডলাইন অনুসরণ করে চিকিৎসা দিয়ে থাকি। ক্যানসার চিকিৎসায় খরচ কমানোর একটাই উপায় সেটি হলো হেলথ ইন্স্যুরেন্স। হেলথ ইন্স্যুরেন্সের জন্য সরকার থেকে একটি উদ্যোগ থাকতে পারে। বিশেষ করে স্পেশালাইজড হাসপাতালগুলোকে যদি ট্যাক্স মওকুফ সুবিধা দেওয়া হয় তাহলে ক্যানসার চিকিৎসার খরচ আমরা ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কমিয়ে ফেলতে পারব।

কালবেলা: আপনাদের ক্যানসার হাসপাতাল করার অনুপ্রেরণা কী ছিল?

সাকিফ শামীম: ল্যাবএইড গ্রুপ বাংলাদেশে বিশেষায়িত হাসপাতালের পথপ্রদর্শক। কার্ডিয়াক হাসপাতাল, মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতাল করেছি আমরা। আমাদের মাস্টার প্ল্যানের অংশ হিসেবে ক্যানসার হাসপাতালও তৈরি করেছি। এই সবই আমাদের চেয়ারম্যানের একটি টপ ডাউন স্ট্রাটেজি। মাস্টারপ্ল্যানে ক্যানসার হাসপাতাল তৈরি করা ছিল টপ প্রায়োরিটি। আমরা বাংলাদেশের ক্যানসার রোগীদের প্রায় ২০ শতাংশকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের ক্যানসার হাসপাতাল যেসব সুবিধা ও ফাংশন রয়েছে তাতে করে বছরে প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ মানুষের ক্যানসার চিকিৎসাসেবা দিতে সক্ষম আমরা। এখন পর্যন্ত আমাদের সুযোগের ৫০ শতাংশ ব্যবহার করতে পারছি। প্রয়োজনে এই পরিমাণ আরও বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া আগামীতে মা ও শিশু হাসপাতাল, নেফ্রলজি হাসপাতাল, নিউরো ফেসিলিটিসযুক্ত আর্থপেডিক্স এবং ট্রমা হাসপাতাল করার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।

কালবেলা: ক্যানসার চিকিৎসায় বাংলাদেশ থেকে অনেক মানুষ বিদেশে চিকিৎসাসেবা নিতে যান। এতে প্রচুর ডলার ব্যয় হয়। ল্যাবএইড বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার সেই প্রবণতা কমাতে কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে?

সাকিফ শামীম: ক্যানসার চিকিৎসায় যারা বিদেশে যান তারা যাতে দেশে চিকিৎসা নেন তার জন্য আমাদের আস্থার জায়গা তৈরি করতে হবে। শুধু ল্যাবএইড দিয়ে সারা বাংলাদেশের চিকিৎসা খাতের চিত্র তুলে ধরা যাবে না। তবে মনে করি ল্যাবএইড যে প্ল্যাটফর্মে সেবা দিচ্ছে তাতে সিঙ্গাপুর বা বিদেশের যে কোনো হাসপাতালের সঙ্গে আমরা প্রতিযোগিতা করতে পারি। ভারত কিংবা সিঙ্গাপুরের বড় বড় হাসপাতালের সঙ্গে আমাদের পার্টনারশিপও রয়েছে। তাদের রোগীদের আমাদের কাছে তারা রেফার করছেন। মানুষ চিকিৎসা নিতে বিদেশে যান কারণ তারা দেশে চিকিৎসা নিতে আস্থা পান না। আস্থার সংকটের পেছনে নানা কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ হলো ব্যবহার আর মানসম্মত চিকিৎসার আস্থা। বাংলাদেশে হেলথ কেয়ারের প্রফেশনালস ব্যবহার আরও অনেক ভালো করতে হবে। যদি একজন রোগীর সঙ্গে প্রথমেই সুন্দর ব্যবহার দিয়ে শুরু করা যায় তাহলে রোগীর মধ্যে একটি আস্থার জায়গা তৈরি হয়। আমাদের চিকিৎসকরা অনেক পরিশ্রম করেন, রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের অনেক পড়াশোনাও করতে হয়। রোগীর তুলনায় দেশে চিকিৎসকের সংখ্যা যেহেতু অনেক কম তাই তাদের অনেক বেশি চাপ নিতে হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে চিকিৎসকরা একজন রোগীকে সময় দিচ্ছেন এক মিনিটের থেকেও কম। অথচ রোগীরা চান চিকিৎসক তাদের সমস্যা শুনবেন এবং সময় দেবেন। রোগীকে সময় দেওয়ার ক্ষেত্রে এখানে একটি বড় সংকট রয়েছে আমাদের দেশে। আমি বিদেশে যখন বিভিন্ন হাসপাতালে কাজ করেছি তখন দেখেছি সেখানে একজন ডাক্তার একজন রোগীকে এক ঘণ্টারও বেশি সময় দেন। আমাদের ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতালে একজন নতুন রোগীকে এক ঘণ্টার মতো সময় দেন আমাদের চিকিৎসকরা। ক্যানসার যেহেতু একটি জটিল রোগ তাই ক্যানসার হয়েছে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই একটি বড় স্টেপ। অনেক রোগী যখন টেস্ট রিপোর্টে দেখেন তিনি ক্যানসার আক্রান্ত হয়েছেন তখন তারা সেই রিপোর্টটি বিশ্বাস করেন না। তারা মনে করেন রিপোর্টটি হয়তো ভুল এসেছে। তখন তারা বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান। বিদেশে গিয়ে তারা আবার এই রিপোর্ট ক্রস চেক করেন। সেখানে যখন তারা দেখেন ক্যানসার শনাক্ত হয়েছে তখন সেখানেই চিকিৎসা নিতে পছন্দ করেন। তবে এখন অনেক ক্ষেত্রে দেখছি বিদেশে গিয়েও অনেকে আবার দেশে ফিরে এসে আমাদের কাছে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

কালবেলা: ল্যাবএইডের ওপর মানুষের আস্থা বৃদ্ধির কারণ কী?

সাকিফ শামীম: প্রথমত ইফেকটিভ কমিউনিকেশন দরকার। আমাদের সামনে বাধা অনেক বেশি এগুলো কমিয়ে আনতে হবে। রোগীকে সময় দিতে হবে, রোগীকে সন্তুষ্ট করতে হবে। অবকাঠামোগত আরও উন্নতি দরকার। সরকার পদক্ষেপ নিতে পারে অথবা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপেও এগিয়ে যাওয়া যেতে পারে। হাসপাতাল হিসেবে মানুষের আস্থা অর্জনের জন্য আমরা যেটা করতে পারি তাহলো সেবার মান উন্নত করা। কিন্তু এখানেও একটি বাধা রয়েছে। যখন মান উন্নত করতে যাওয়া হয় তখন খরচ অনেক বেড়ে যায়। এখানে সরকারের অনেক কিছু করার রয়েছে। সরকার দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে ফেলতে পারে। একটি টার্শিয়ারি কেয়ার হাসপাতালের আইসিইউর জন্য ন্যূনতম কী কী উপাদান দরকার সেটা যেন সব জায়গায় থাকে, সেটা সরকার নিয়মিত তদারকি করতে পারে। সরকারের তদারকি যত বাড়বে সেবার মান ততই বাড়বে বলে মনে করি।

কালবেলা: ক্যানসার চিকিৎসার মেডিসিনের দাম অনেক বেশি। এটা রোগীদের হাতের নাগালে নিয়ে আসার কোনো উপায় আছে কী?

সাকিফ শামীম: ক্যানসার চিকিৎসার ওষুধের দাম হাতের নাগালে নিয়ে আসতে প্রথমে আমাদের কাঁচামাল নিয়ে কাজ করতে হবে। কাঁচামালের জোগান বাড়াতে হবে, কারখানা তৈরি করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি প্রাইভেট সেক্টরকেও এই জায়গায় কাজ করতে হবে। এভাবে সম্মিলিতভাবে এগোলে হয়তো ওষুধের দাম অনেকটা কমে আসবে। এ ছাড়া ওষুধের অপব্যবহারও কমাতে হবে। যতটুকু প্রয়োজন তার থেকে বেশি ওষুধ রাখেন অনেকে। বাড়িতে এসব ওষুধ মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে নষ্ট হয়ে যায়। এই অপচয়গুলো কমাতে হবে। ওষুধ বিক্রয়ের জন্য একটি যথাযথ নীতিমালা থাকাও জরুরি।

কালবেলা: ক্যানসার চিকিৎসা মানেই আমাদের সামনে কেমো থেরাপির বিষয়টি চলে আসে। ক্যানসার চিকিৎসা মানেই কী থেরাপি না কি এর কোনো বিকল্প রয়েছে?

সাকিফ শামীম: ক্যানসার চিকিৎসানির্ভর করে রোগী কোনো স্টেজে রয়েছেন তার ওপর। যদি প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার ধরা পড়ে তাহলে সার্জারির মাধ্যমে সারিয়ে তোলা সম্ভব। কিন্তু যখন টিউমারটি বড় হয়ে যায় বা ছড়িয়ে যায় তখন কেমো থেরাপি বা বিভিন্ন টার্গেটেড হরমোন থেরাপি দেওয়া হয়। থেরাপির মাধ্যমে ক্যানসারের সেলগুলোর অস্বাভাবিক বিভাজন কমানো হয়। যখন ক্যানসারের জায়গাটি আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যায় তখন সার্জারির দিকে যাওয়া হয়। অনেক সময় রেডিও থেরাপিও দেওয়া হয়। থেরাপিটা এখন একটি স্টান্ডার্ড চিকিৎসা প্রটোকল। ক্যানসারের একমাত্র চিকিৎসা থেরাপি নয় তবে থেরাপি ক্যানসার চিকিৎসার অনেক বড় একটি পার্ট। থেরাপির পাশাপাশি ডায়াগনেসিস এবং সার্জারি ক্যানসার চিকিৎসার জন্য বড় দুটি পার্ট।

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আম কুড়াতে গিয়ে বজ্রপাতে শিশুর মৃত্যু

গরমে অস্বস্তি, বৃষ্টি হতে পারে ঢাকায়

আজকের নামাজের সময়সূচি

ইতিহাসের এই দিনে আলোচিত যত ঘটনা

আজ যেসব অঞ্চলে বজ্রসহ বৃষ্টির সম্ভাবনা

প্রভাবশালী প্রার্থীর পছন্দের প্রিসাইডিং অফিসার নিয়োগের অভিযোগ

শুক্রবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

জুমার দিন যেসব আমল করবেন

নির্বাচনী শোডাউনে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় যুবকের মৃত্যু 

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আজ

১০

১ মণ ধানের দামেও মিলছে না দিনমজুর 

১১

বাংলাদেশে আসছেন কুরুলুস উসমানের নায়ক বুরাক

১২

সিলেটে ফের বিরতি ফিলিং স্টেশনে আগুন

১৩

এক হাজার সফল সার্জারি সম্পন্ন করেছে ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল

১৪

আলুর হিমাগারে মিলল লাখ লাখ ডিম

১৫

শিক্ষার্থীদের বাস নিয়ে প্রোগ্রামে তিতুমীর কলেজ ছাত্রলীগ

১৬

মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত

১৭

যুদ্ধ শেষে গাজায় যে পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্র

১৮

দেড় শতাধিক লোকসহ টুঙ্গিপাড়ায় যাচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুছ

১৯

স্ত্রীর স্বীকৃতির দাবিতে নাদিমের বাড়ি ৪৩ বছরের নারীর অনশন

২০
X