পৃথিবীতে দৈনিক গড়ে ১৪০০-এর ওপর ভূমিকম্প সংগঠিত হয়। তার ভেতর ১০০০ বা ততধিকের মাত্রা কম হওয়ার দরুন তা আলোচনায় আসে না। নানা সূত্র বলছে, রিখটার স্কেল ৪ বা তার বেশি মাত্রার ভূকম্পন ঢাকা ও তার ৩০০ কিলোমিটার এলাকার মাঝে সংগঠিত হয়েছে গত ১০ বছরে ৯৭টি, গড়ে প্রতি বছরে প্রায় ১০টি। গত এক যুগ ধরে শুনছি বাংলাদেশ একটি সম্ভাব্য শক্তিশালী ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে। আসলে তা কতখানি সঠিক?
তার জন্য একটু ইতিহাস ঘুরে আসা যাক। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন সংঘটিত হয় উপমহাদেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ ভূমিকম্প, যা ‘গ্রেট আসাম ভূমিকম্প’ নামে পরিচিত। ৮ দশমিক ১ মাত্রার এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের শিলং প্লেটোতে, তবে এর ধ্বংসাত্মক প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও বৃহত্তর মেঘনা অববাহিকায়। প্রায় ৩ মিনিট স্থায়ী এই কম্পনে শুধু ভবন ও অবকাঠামোরই ক্ষতি হয়নি, বরং প্রকৃতির চেহারাও বদলে যায়।
ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর গতিপথ আংশিক পরিবর্তিত হয়, অনেক স্থানে মাটি নিচে ধসে পড়ে আবার কোথাও উঁচু হয়ে উঠে যায়। নদীপাড় ভেঙে নতুন খাল ও স্রোতের জন্ম হয়। ভূকম্পনের ফলে বহু এলাকায় মাটিতে ফাটল ধরে, পানি ও বালি উদিগরণ ঘটে, এবং ভূমি স্থায়ীভাবে বিকৃত হয়ে পড়ে। ঢাকায় বহু ভবন ধসে পড়ে, আর প্রাণহানির সংখ্যা ছিল আনুমানিক ১,৫০০ থেকে ২,০০০ জন। এই ভূমিকম্প দেখিয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার ভূগঠনের নিচে জমে থাকা শক্তি এক মুহূর্তেই ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
নেচার জিওসায়েন্সসহ বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকার নিচে ৮ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টির মতো বিপুল টেকটোনিক চাপ জমে আছে। মধুপুর ও ডাউকি ফল্ট থেকে যে কোনো সময় ভয়াবহ ভূমিকম্প ঘটতে পারে, যা ঢাকার এক-তৃতীয়াংশ ভবন ধ্বংস এবং লাখো প্রাণহানি ঘটাতে সক্ষম। যদিও এ হিসাব কাগজে কলমে, প্রকৃতির হিসাব সবসময় অঙ্কের মতো মেলে না, তাই এ নিয়ে চিন্তা করে ঘুম হারাম করবার চেয়ে ভাবা উচিত বাঁচব কী করে?
ভূমিকম্পের সময়, মাত্রা বা অবস্থান শতভাগ নির্ভুলভাবে নির্ধারণে আধুনিক বিজ্ঞান এখনো পুরোপুরি সক্ষম নয়। তবে একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত ভূমিকম্প সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণ, ভূকম্পনের প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতি কমানো এবং ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলকে নিরাপদ করতে পরিকল্পিত নগরায়ণ ও ভূমি ব্যবস্থাপনার বাস্তবভিত্তিক কৌশল নির্ধারণ করতে পারার মতো সক্ষমতা আধুনিক বিজ্ঞানের রয়েছে।
তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভূমিকম্প সহনশীল ব্যবস্থা, প্রস্তুতি, সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে অভিযোজন ও প্রশমন সম্পর্কিত আইন ও নীতিমালা কতটুকু যুগোপযোগী এবং কার্যকর তা নিয়ে বহু বছর ধরে প্রশ্ন উঠছে এবং ব্যাপক আলোচনা চলছেই। এ আলোচনা পৃথিবীর কোথাও বড় ভূমিকম্প হলে বা ক্ষয়ক্ষতি হলে কিছুদিন সামাজিক যোগাযোগ ও সংবাদমাধ্যমে চাউর থাকে। তারপর আবার সবাই ভুলে যায়।
ঢাকা শহর বিশ্বের অন্যতম ভূমিকম্প-ঝুঁকিপূর্ণ মহানগরী, অথচ এখানকার অবকাঠামোগত বাস্তবতা উদ্বেগজনকভাবে দুর্বল।
রাজউক-এর আওতাভুক্ত এলাকায় করা জরিপে দেখা যায়, মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও পল্লবীতে প্রায় ৯৫ শতাংশ ভবন, রামপুরা-মতিঝিল-খিলগাঁওয়ে ৯৩ শতাংশ এবং ধানমন্ডিতে প্রায় ৯০ শতাংশ ভবন যে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (BNBC) অনুসরণ করে নির্মিত, তার কোনো প্রমাণ নেই।
ওয়ার্ডভিত্তিক এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৭নং ওয়ার্ডের, ১২ শতাংশ ভবন উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ, ২৫ দশমিক ৭ শতাংশ মাঝারি এবং ৩৫ শতাংশ মাঝারি কম ঝুঁকিতে রয়েছে।
দুই সিটির অন্যান্য ওয়ার্ডের ওপর জরিপ ফলের থেকে খুব একটা আশানুরূপ মাত্রায় ভালো হবে বলে আশা করাটা সমীচীন নয়। অন্যান্য আরও গবেষণায় জানা যায়, মাটির কম্পন ও গঠন অনুযায়ী রাজউকের এখতিয়ারভুক্ত এলাকায় সিসমিক ভালনারেবিলিটি ইনডেক্সের (Kg) মান শূন্য দশমিক ১৬ থেকে ৭ দশমিক ২৮ পর্যন্ত, যা দুর্বল মাটি ও তীব্র কম্পনের আশঙ্কা বাড়ায়। এ মাত্রা ৫-এর উপরে যাওয়া চরম ঝুঁকিপূর্ণতা নির্দেশ করে এবং নির্দেশ করে মাটির গঠন এমনভাবে তৈরি, যা কম্পনকে প্রবল করে ও অবকাঠামো ধ্বংসের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। সহজ ভাষায় বললে, মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পও এ শহরকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে পারে।
নগরায়ণের নামে ঢাকায় যেভাবে জলাভূমি ও নিচু জমি বালু ফেলে ভরাট করে গড়ে তোলা হচ্ছে একের পর এক আবাসিক প্রকল্প, তাতে গড়ে উঠছে বহুতল ভবন, আর সেই ভবনগুলোর ব্যবহার হচ্ছে আবাসনের পাশাপাশি স্কুল, রেস্তোরাঁ ও অফিসসহ বহুমুখী বাণিজ্যিক প্রয়োজনে। মাইলস্টোন দুর্ঘটনার পর সমাজকে নাড়িয়ে দিয়ে তা আজ অন্যান্য সম্ভাব্য ভয়াবহ বিপর্যয়ের বার্তাও দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব অঞ্চলের নরম মাটিতে ভূমিকম্পের সময় কম্পন বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে, মাটি দেবে যেতে পারে, যাকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় বলা হয় লিকুইফ্যাকশন। ফলে এসব আকাশছোঁয়া ভবন মুহূর্তে ধসে পড়তে পারে। অন্যদিকে রাজউক কর্তৃক বিভিন্ন এলাকায় ফার বা ভবনের উচ্চতা নির্ধারণের অনুপাত যেভাবে ঢালাওভাবে বাড়ানো হয়েছে, অথচ রাস্তাঘাট তার তুলনায় সংকীর্ণই থেকে গেছে, যা ইতোমধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানের অগ্নিকাণ্ডসহ অন্যান্য বিপদে উদ্ধারকাজকে ব্যাপকভাবে ব্যাহত করে বলে প্রমাণিত ও ভবিষ্যতেও বড় কোনো দুর্যোগে উদ্ধারকাজকে করে তুলবে প্রায় দুঃসাধ্য। সংকীর্ণ গলি, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, আর যথাযথ নির্মাণ তদারকি না থাকার ফলে শহরের এক বড় অংশই আজ ভূমিকম্পে মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা স্পষ্ট। ভূমিকম্প হলে শুধু ভবনই নয়, ঢাকা শহরের পরিকল্পনার দুর্বলতাই হাজার হাজার প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) এক গবেষণায় দেখা যায়, সংকীর্ণ গলি, ঘনবসতিপূর্ণ অপরিকল্পিত এলাকা যেমন পুরান ঢাকা, যাত্রাবাড়ী, শাজাহানপুর, খিলগাঁও, রামপুরা, বাড্ডা, উত্তরখান, দক্ষিণখান, ঝিগাতলাসহ অন্যান্য বেশ কিছু জায়গায় বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে জরুরি উদ্ধার বাহিনী প্রবেশ করতে পারা তুলনামূলক দুঃসাধ্য, যা প্রাণহানি ২০-৩০% পর্যন্ত বাড়তে পারে।
এখন করণীয় কি? চাইলেই তো এ বহু শতবর্ষী শহরকে চোখের পলকে বদলে ফেলা যাবে না। ঢাকার ভূমিকম্প ঝুঁকি নিয়ে গবেষণায় আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্রেও বিশেষ সতর্কবার্তা বারবার উঠে এসেছে। গবেষণাপত্র আর্থকুয়েক স্পেকট্রায় প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকার নরম মাটি ও উচ্চ জনসংখ্যার কারণে এখানে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে ব্যাপক ধ্বংসের সম্ভাবনা অনেক বেশি।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) গবেষণা পরামর্শ দিচ্ছে, নগর পরিকল্পনায় ভূমিকম্প সহনশীল নকশা ও শক্তিশালী ভিত তৈরি ছাড়া বৃহৎ মানবিক বিপর্যয় এড়ানো অসম্ভব। তার সঙ্গে প্রয়োজন বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে প্রয়োগ, অপরিকল্পিত নগরায়ন নিয়ন্ত্রণ এবং সড়ক প্রশস্তকরণ। তারা আরও জোর দিচ্ছেন পুরান ঢাকাসহ অন্যান্য এলাকার মান্ধাতার আমলের অবকাঠামোর সংস্কারে রেট্রোফিটিংয়ের মতো প্রযুক্তির ব্যবহারের পাশাপাশি জলাভূমি ও নিচু জমি ভরাট করে যেসব এলাকাকে বসবাস উপযোগী করা হয়েছে সেসবসহ অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বেজ আইসোলেশন সিস্টেম, সিসেমিক ডাম্পার, শিয়ার ওয়াল ও ক্রস ব্রেসিংয়ের মতো আধুনিক প্রযুক্তিমুখী প্রকৌশল ও স্থাপত্য চর্চার।
শুধু ঢাকা যে ঝুঁকিতে তা ভেবে বসে থাকবার অবকাশ নেই। ঢাকার বাইরে দেশের বহু শহর ও উপজেলা ভূমিকম্পের সম্ভাব্যতা ও প্রস্তুতির দিক থেকে প্রায় একই রকম ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে সিলেট, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা, কক্সবাজার ও বান্দরবানসহ পাহাড়ি অঞ্চলগুলো প্রধান ভূ-গাঠনিক ফল্ট লাইনের নিকটবর্তী হওয়ায় এখানে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের সম্ভাবনা বেশি। অথচ এসব এলাকার ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড মানা হয়নি, উদ্ধারপথ সংকীর্ণ ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাও অপ্রতুল।
২০২৩ সালে ইউএনডিআরআরের এক প্রতিবেদন বলছে, দেশের উপজেলা পর্যায়ের ৭০ শতাংশ ভবন সিসমিক স্ট্যান্ডার্ড না মেনে নির্মিত। বড় ভূমিকম্প হলে এসব অঞ্চলেও ঘটতে পারে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়।
ঢাকাসহ সারা দেশের এ পরিস্থিতির দায় যতখানি কর্তৃপক্ষের ঠিক ততখানি তার নাগরিকদের। আমরা সব কিছু অর্থ দিয়ে মেপেছি, যার খেসারত দেবে হয়তো কয়েক প্রজন্ম।
লেখক : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)
মন্তব্য করুন