’২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৩ মাসে রাঙ্গুনিয়ায় ১৪টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এসব খুনের অধিকাংশই ঘটেছে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এবং কোনোটি পূর্ব বিরোধের জেরে, আবার কোনোটি পারিবারিক কারণে। দুএকটা ছাড়া অধিকাংশ খুনই হয়েছে প্রকাশ্যে।
এভাবে নিয়মিত বিরতিতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এলাকাজুড়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। তবে পুলিশ বলছে, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে এবং হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।
জানা যায়, গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাত ৯টার দিকে উপজেলার লালানগর ইউনিয়নের ঘাগড়া খিল মোগল তালুকদার পাড়া মসজিদের পাশে মো. খোরশেদ আলম (২৮) নামে এক যুবককে গলা কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। বাড়ি থেকে মাত্র ৭০ ফুট দূরে এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা মেনে নিতে পারছেন না পরিবারের স্বজনরা। এই ঘটনায় মামলা হলেও গ্রেপ্তার হয়নি কেউ। তবে রহস্য উদঘাটনে চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ। স্বজনদের অভিযোগ, পারিবারিক এক স্বজনের ইন্ধনেই এই খুন হয়েছে।
এই খুনের একদিন আগে ২২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় উপজেলার সরফভাটা ইউনিয়নের সিকদারপাড়া এলাকায় প্রতিবেশীর হাতে ছুরিকাঘাতে খুন হন রহমত উল্লাহ (৪৮) নামে এক দিনমজুর। ইটভাঙানোর মাত্র দুইশ টাকা মজুরিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিরোধে এমন খুনের ঘটনা ঘটেছে। দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানায় ৫ জনের মামলা হলে প্রধান অভিযুক্ত আসামি আশরাফ আলীকে (২৮) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর সকালে উপজেলার পারুয়া ইউনিয়ন থেকে রুমা আক্তার (২৬) নামে এক গৃহবধূর লাশ উদ্ধার হয়েছে। তার জেল ফেরত স্বামী পোমরা ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড এলাকার মো. নেজাম তাকে যৌতুকের দাবিতে খুন করেছে বলে অভিযোগ নিহতের স্বজনদের। রুমা আক্তার উপজেলার চন্দ্রঘোনা কদমতলী ইউনিয়নের বনগ্রাম লালপাহাড় এলাকার মীর আহম্মদের মেয়ে।
তার এক মাস আগে গত ২৭ আগস্ট রাঙ্গুনিয়ার শীর্ষ সন্ত্রাসী রুবেলকে (৩৫) গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। উপজেলার পদুয়া ইউনিয়ন ৫ নম্বর ওয়ার্ডস্থ হারুয়ালছড়ি ইকোপার্ক সংলগ্ন একটি বসতঘরে এ ঘটনা ঘটে। আধিপত্য বিস্তার ও মাদক সংক্রান্ত বিরোধে এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে বলে জানা গেছে।
গত ১০ জুলাই উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নের মোবারক আলী টিলা এলাকায় মোহাম্মদ রাসেল (৩৫) নামের এক যুবককে প্রকাশ্য দুপুরে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে পাশের ধানক্ষেতে ফেলে যায় দুর্বৃত্তরা। সে ওই এলাকার মোহাম্মদ আলীর ছেলে। তিনি দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন এবং এক বছর আগে দেশে ফেরেন। তবে কী কারণে এবং কারা এই হত্যাকাণ্ড করেছে তা এখনো রহস্য উদঘাটন হয়নি।
এর আগে ২০ জুন উপজেলার সরফভাটা ইউনিয়নের কাইন্দারকুল এলাকায় শ্বশুরবাড়ি থেকে ফেরার পথে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন শিবুউ মারমা (৩০) নামের এক যুবক। তিনি সরফভাটা মারমাপাড়ার বাসিন্দা চিংচালা মারমার ছেলে। পাহাড় থেকে লেবু এনে বিক্রি করতেন শিবু। মাদকসংক্রান্ত বিরোধে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেলেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার কিংবা রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি।
চলতি বছরের ৬ জুন দুপুরে গোডাউন গরুর বাজারে শ্বশুর ওসমান গনিকে (৫০) প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করেন জামাতা মোহাম্মদ হোসেন। এ সময় উপস্থিত জনতা এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে। ঘটনার পরপরই হোসেনকে স্থানীয়রা ধাওয়া করে ধরে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে। তিনি হত্যার দায় স্বীকার করেছেন। নিহত ওসমানের বাড়ি শিলক ইউনিয়নের রাজাপাড়া গ্রামে। পারিবারিক কারণে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে।
গত ১০ এপ্রিল ভোরে রাঙ্গুনিয়ার সীমান্তবর্তী সরফভাটা বোয়ালখালী সীমান্তে লেমুছড়া এলাকায় লেবু বাগান পাহারা দিতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে খুন হয়েছেন আওয়াইমং মারমা (৩৩) নামে এক উপজাতি ব্যক্তি। তিনি উপজেলার সরফভাটা বড়খোলাপাড়া এলাকার অংসিপ্রু মারমার ছেলে। এই ঘটনায় আরও তিনজন আহত হয়েছেন। আধিপত্য বিস্তার এবং মাদক সংক্রান্ত বিরোধে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা স্থানীয়দের। তবে কাউকে গ্রেপ্তার কিংবা ঘটনার রহস্য এখনো উদঘাটন হয়নি।
এ ছাড়া ২৬ মার্চ সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল ইসলাম তালুকদার (৭০)। এর আগের দিন ২৫ মার্চ সরফভাটার মীরের খিল বাজারে নিজের দোকানে কুপিয়ে আহত করা হয় তাকে। পরদিন হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। নিহত নুরুল ইসলাম সরফভাটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড সভাপতি ছিলেন। তাকে কারা কেন হত্যা করেছে সে রহস্য এখনো উদঘাটন হয়নি, এই ঘটনায় মামলাও হয়নি এবং পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তারও করেনি।
গত ১৫ জানুয়ারি ভোরে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার রাজানগর ইউনিয়নের ঠান্ডাছড়ি নতুন পাড়া এলাকায় ভাড়া ঘরে খুন হয়েছিলেন জরিনা বেগম (২৪) নামে এক গৃহবধূ। আগেরদিন রাতে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়ার রেশ ধরে গভীর রাতে স্ত্রীকে বালিশ চাপা দিয়ে খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে স্বামীর বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে থানায় হত্যা মামলা দিলে পুলিশ স্বামী শাহ আলম ওরফে হাসানকে (৩০) গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠায়।
২০২৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর দিবাগত রাত একটার পর উপজেলার লালানগর ইউনিয়নের ইসলামিয়া পাড়া এলাকায় গাড়িতে গ্যাস নিয়ে ফেরার পথে রবিউল হোসেন রুবেল (২৬) নামে এক যুবককে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তিনি চন্দ্রঘোনা বনগ্রাম এলাকার মোহাম্মদ আলীর ছেলে। তবে তিনি দীর্ঘদিন ধরে লালানগর ৫ নম্বর ওয়ার্ডে তার শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। এ ঘটনায় পরেরদিন নিহতের স্ত্রী কাজলী আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞতানামা আসামিদের বিরুদ্ধে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় এখন পর্যন্ত ইউপি সদস্যসহ বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছে।
একইবছর ২ ডিসেম্বর রাতে উপজেলার সরফভাটা এলাকায় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে প্রবাসী সেকান্দর চৌধুরী মামুন (৪২) খুন হয়েছেন। এই ঘটনায় তার ভাই বাদী হয়ে মামলা দিলে এখন পর্যন্ত পুলিশ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
গত বছরের ১৮ আগস্ট সকালে রাঙ্গুনিয়ায় ইমরান নবী ওরফে জুয়েল (১৬) নামে এক মাদ্রাসাছাত্রের লাশ নিখোঁজের ২৪ ঘণ্টা পর উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় নিহতের পিতা মো. নবীর হোসেন বাদী হয়ে দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানায় হত্যা মামলা দায়ের করলে পুলিশ মো. মারুফ (১৭) নামে তার এক সহপাঠিকে গ্রেপ্তার করে৷ গ্রেপ্তার মারুফ উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নের সুখবিলাস গ্রামের মাওলানা মুহাম্মদ ফারুক আজমের ছেলে। নিহত জুয়েল উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নের সুখবিলাস ইসলামিক মিশনারী সেন্টারের কিতাব বিভাগের ১০ম শ্রেণির ছাত্র ছিল।
৭ আগস্ট প্রতিপক্ষের হামলায় উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নের সুখবিলাস গ্রামে আবদুল মজিদ (২৮) নামে এক যুবক আহত হন, পরে হাসপাতালে ৮ আগস্ট দুপুরে তার মৃত্যু হয়। জমিসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আবদুল মজিদের সঙ্গে প্রতিপক্ষ আব্দুল আজিমের কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে আজিমদের লাঠির আঘাতে আহত হয়ে পরে হাসপাতালে মারা যান তিনি।
এসব ঘটনার ব্যাপারে জানতে চাইলে রাঙ্গুনিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এটিএম শিফাতুল মাজদার বলেন, আমরা যেখানে ঘটনা হচ্ছে সেখানে উপস্থিত হয়ে মামলা নিয়ে প্রকৃত ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আটক করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে সবাইকে মনে রাখতে হবে আইন হাতে তুলে নেওয়া যাবে না। আমরা খুনের সঙ্গে জড়িতদের ধরতে অভিযান পরিচালনা অব্যাহত রেখেছি।
দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানার ওসি সাব্বির মোহাম্মদ সেলিম বলেন, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডে তদন্ত চলছে। খুব শিগগিরই দায়ীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
চট্টগ্রাম পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার চন্দ্রঘোনা-কদমতলি ইউনিয়নের গীতাভবন পূজা মণ্ডপ পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বলেন, পুলিশ আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। রাঙ্গুনিয়ার সন্ত্রাস ও অপরাধ দমনে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।
মন্তব্য করুন