ডা. রুবায়ুল মোরশেদ
প্রকাশ : ০৩ নভেম্বর ২০২৩, ১১:৪৬ এএম
অনলাইন সংস্করণ
জ্ঞানের ঝর্ণাতলায়

খারাপ অভ্যাস পরিবর্তনে গভীরভাবে ভাবুন

সবুজে ঘেরা সড়ক। ছবি: সংগৃহীত
সবুজে ঘেরা সড়ক। ছবি: সংগৃহীত

সাধারণের ধারণা যে অধিকাংশ ধনীই নির্দয় প্রকৃতির। অর্থের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে তারা অনেক সময় নির্মম হয়ে থাকেন। কিন্তু প্রকৃতি প্রতিটি নিয়মেরই ব্যতিক্রম প্রদান করে। ধনী হয়েও যখন একজন ব্যবসায়ী দয়ালু আর বিনয়ী হন, তখন সেটা হয়ে ওঠে সমাজের জন্য এক সোনালি আশীর্বাদ। তেমনই একজন, যিনি পথে একবার ঝুম বৃষ্টিতে চারজনের এক ছোট পরিবার-কে ভিজতে দেখে আবেগে বিমর্ষ হয়ে যান। সিদ্ধান্ত নেন যে মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য স্বল্প মূল্যে মটর-যান (নেনো – ‘জনগণের গাড়ী’) বানাতে হবে। ধনীদের জগতে উনি-তো একটু আলাদাই হবেন। তিনি বলে থাকেন যে‘কেউ লোহা-কে ধ্বংস করতে পারে না, যদি না তার নিজের মরিচাই তাকে ধ্বংস করে !’ আজ চারপাশ যখন লোভী লোকে ভরা, তখন পার্শ্ববর্তী দেশের তেমনই একজন সফল কিন্তু দানশীল ব্যবসায়ী হচ্ছেন ‘রতন টাটা’। সহজ জীবন-যাপন কাটাতে তার বিশাল ঐশ্বর্য তার বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি কখনো। তিনি অভ্যস্ত নন অন্যান্য অনেক বন্ধুদের মতন রাত জেগে পার্টিতে আনন্দ ফুর্তি করতে। কেউ এই মৃদুভাষীকে কখনো তার অধস্তন সাহায্য-কর্মীদের সাথে খারাপ আচরণ করতে দেখেননি। উনি সবসময় পছন্দ করেন তার গাড়ি চালকের ঠিক পাশে বসতে। শোনা যাক তার জীবনের ছোট্ট একটা গল্প।

একবার রতন টাটা হাম্বুরগ যাবেন তার সহকর্মীদেরকে নিয়ে। হাম্বুরগ জার্মানির একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য শহর। ব্যবসায়ীদের জন্য-তো বটেই। এখানেই নিভিয়া, হ্যানসাপ্লাস্ট, মনব্ল্যাঙ্ক (Montblanc) আর এয়ারবাসের মতন বড় বড় সব অফিস। অসংখ্য পণ্য নিয়ে হ্যামবুর্গ মানচিত্রে আইকনিক স্ট্যাটাস উপভোগ করে। যেতে যেতে একটু বিলম্বই হয়ে গেল। বাইরে বেশ শীত পড়তে শুরু করেছে। তিনি কিছুটা ক্লান্তও। রাতের খাবারের সময় হয়ে গেছে আগেই।এখানে সবাই তাড়াতাড়ি খেয়ে নেয় রাতের আহার। তার সহকর্মীরা তাকে নিয়ে এক নিরিবিলি খাবারের দোকানে ঢুকল। রতন টাটার প্রধান সহকারী এই রেস্তোরাঁটা পছন্দ করেছেন। রেস্তোরাঁটা সেবায় আধুনিক হলেও অনেক পুরোনো স্থাপত্যকলায় গড়া। হালকা হলুদ আলোয় দেখা গেলো, তখন বেশিরভাগ টেবিলই খালি হয়ে গেছে। শুধু পাশের দুটো টেবিলে কাস্টমাররা বশে আছেন। আর নির্জন এক কোনায় নিঃসঙ্গ বসে আছেন এক বৃদ্ধ । মনে হয় গরম গরম সূ্প খাচ্ছেন। ঠিক বাম পাশের টেবিলে এক উচ্ছল তরুণ জুটি। তাদের খাবারে মাত্র দুটি পদ এবং সাথে দুটি ড্রিঙ্ক। রতন টাটার সহকারী দেখে অবাক হলেন যে এমন সাদামাটা খাবার কীভাবে অভিজাত এই রোমান্টিক জুটির হতে পারে ! অন্য পাশে আরেকটি টেবিলে কিছু বয়স্ক নারী খাবারের অপেক্ষায়; নিম্নসরে কথা বলছিলেন আর হাসছিলেন। মাঝখানে আকর্ষণীয় একটা কেক, ‘হেপি-বারথডে’ সুরে কিছু গাইছে ওরা। মনে হয় আজ তাদের কারো জন্মদিন। ভালোই লাগছে দেখতে। রেস্তোরাঁর পরিচারক তাদেরকে মাত্র দুটি পদ খাবার দিয়ে গেলো এবং তারা সেটা ভাগ করে ধীরে ধীরে খাওয়া শুরু করলেন। রতন টাটার দলও শ্রান্ত, সবাই ক্ষুধার্ত। তাদের স্থানীয় সহকর্মী খাবারের নির্দেশ দিতে দেরি করলেন না। বেশ দ্রুতই গরম গরম রকমারি খাবার এসে গেল। পাশের মহিলারা আনন্দের সাথে তাদের প্লেটের সব খাবারই প্রায় শেষ করে ফেলল। রতনের দলের পরিশ্রান্ত সবাই আর খেতে চাইছেন না। ক্রেডিট কার্ডে বিল পরিশোধ করা হোল। যখন তারা সবাই চলে যাচ্ছেন, তখনো টেবিলে প্রায় এক-তৃতীয়াংশের বেশী খাবার উচ্ছিষ্ট রয়ে গেছে। যাওয়ার সময় পাশে উপবিষ্ট বয়স্ক নারীরা ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলতে চাইল তাদের সাথে। তারা বুঝতে পেরেছে যে তাদের খাবার নষ্ট করা দেখে এই মহিলারা অত্যন্ত বিরক্ত। রতনের তরুণ প্রধান সহকর্মী বয়স্ক সেই নারীদের বলল, 'আমরা আমাদের খাবারের দাম পরিশোধ করেছি। কতটুকু খাবার আমরা রেখে গেলাম, তা আপনাদের মাথাব্যথার কারণ নয়।' প্রবীণ নারীরা আরো বিরক্ত এবং ক্ষেপেই গেল। তাদের একজন তৎক্ষণাৎ তার মুঠোফোন হাতে নিয়ে কোনো একজনকে ফোন করল। কিছুক্ষণ পরেই 'সামাজিক নিরাপত্তা' নামক সংগঠনের দুজন ইউনিফর্ম পরা লোক এসে হাজির। বিবাদের কারণ শুনে তারা তাদেরকে ৫০ ইউরো জরিমানা করল। সবাই চুপ করে ছিল। রতন টাটা কিন্তু মনে মনে বেজায় খুশি। ছোটবেলা থেকে শিখে এসেছেন যে অপচয় এক ভয়ানক রোগ। এটা মানুষকে শুধু নিঃস্ব করে না, অমানবিকও করে তোলে। কঠিন স্বরে কর্মকর্তাটি তাদেরকে বলল, 'যতটুকু খেতে পারবেন, ততটুকুই নেবার চেষ্টা করবেন। টাকা আপনার, কিন্তু সম্পদ সমাজের। সম্পদ অপচয় করার কোনো অধিকার আপনাদের নেই।‘ এটা তো রতন টাটারই জীবনের শিক্ষা। একটা উন্নত ধনী দেশের এই মানসিকতায় সহকর্মীরা সবাই লজ্জা পেলেও উনি আবারো খুশি হলেন। উনি নিম্নস্বরে সহকর্মীদের বললেন, ‘আমাদের দেশের সম্পদ অনেক কম, কিন্তু মুখ রক্ষায় আমরা বেশি বেশি পরিমাণে খাবার দিতে নির্দেশ দিই , অন্যকে খাওয়াতে গিয়েও আমরা খাবার নষ্ট করি। আমাদের খারাপ অভ্যাসগুলো পরিবর্তনের ব্যাপারে আমাদের আরো আন্তরিক হওয়া উচিত।

নির্যাস: খারাপ অভ্যাসগুলো পরিবর্তনের ব্যাপারে গভীরভাবে ভাবুন।

ডা. রুবায়ুল মোরশেদ : চিকিৎসক, গবেষক, কাইন্ডনেস এবং হ্যাপিনেস

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাতেই ৬০ কিমি বেগে ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা

‘প্রচণ্ড গরমে’ ক্লাসেই অজ্ঞান হলো শিক্ষার্থী

চট্টগ্রামে গণপরিবহন ধর্মঘট স্থগিত

ক্লাস চলাকালে খুলে পড়ল সিলিং ফ্যান, আহত শিক্ষার্থী

থাইল্যান্ড সফর শেষে সোমবার দেশে ফিরবেন প্রধানমন্ত্রী 

কাপ্তাইয়ে বৃষ্টির জন্য নামাজ আদায়

হাকালুকি হাওরে ধান কাটার ধুম

একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রণব বড়ুয়া আর নেই

রানা প্লাজার ধসে ১১৩৬ মৃত্যু / আরও ছয়জনের সাক্ষ্যগ্রহণ 

যুদ্ধের মধ্যেই বিক্ষোভে উত্তাল ইসরায়েল, চরম বিপাকে নেতানিয়াহু

১০

মানুষের মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন সরদার ফজলুল করিম

১১

বিরোধীদল নিধনে বেপরোয়া কর্মকাণ্ড চলছে : মির্জা ফখরুল

১২

নিউইয়র্কে গুলিতে ২ বাংলাদেশি নিহত, বাড়িতে শোকের মাতম

১৩

প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগে তৃতীয় ধাপে উত্তীর্ণদের বিশেষ নির্দেশনা

১৪

চলতি বছর ডেঙ্গুতে ৪০ হাজার মৃত্যুর শঙ্কা

১৫

যে কারণে ভোট শেষ হওয়ার আগেই নির্বাচন স্থগিত 

১৬

‘নিরাপত্তায় জাতীয় নির্বাচনকেও ছাড়িয়ে যাবে উপজেলা ভোট’

১৭

কালবৈশাখী ঝড়ে লন্ডভন্ড শ্রীমঙ্গল

১৮

মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়েছে মানবাধিকার কমিশন

১৯

ইউএস-বাংলা গ্রুপে ম্যানেজার পদে নিয়োগ, কর্মস্থল ঢাকা

২০
*/ ?>
X