বাংলাদেশের ছোটোখাটো ইস্যুতেও পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতরা, নির্দিষ্ট কিছু মিডিয়া, কতিপয় রাজনীতিবিদ এবং তথাকথিত মানবাধিকার সংস্থাগুলো যে হারে বিবৃতি বাণিজ্য শুরু করেছে, তা রীতিমতো অবাক করার মত। তাদের নিজেদের দেশের বড় বড় ইস্যুতেও এতো তৎপর দেখা যায় না।
আরেকটা লক্ষণীয় ব্যাপার হলো মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের কিংবা হোয়াইট হাউসের প্রায় প্রতিটি ব্রিফিংয়ের সময় বাংলাদেশকে নিয়ে নিয়মিত ভাবে অন্তত একটি করে প্রশ্ন করে থাকেন সাংবাদিকের বেশধারী একজন এপয়েন্টেড প্রোপাগান্ডাবাজ ব্যক্তি।
সেগুলো আসলে খুব বড় কোনো ব্যাপার না হলেও, বাংলাদেশের কতিপয় মিডিয়া হাউজ সেগুলোকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে উপস্থাপন করতে কলম আর কি-বোর্ড ভেঙ্গে ফেলার উপক্রম করে থাকে অদ্ভুত কোনো কারণে!
পক্ষান্তরে, বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বন্দুকের নল ব্যাবহার করে উৎখাত করা বিষয়ে কথা বলাকে পশ্চিমারা বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা হিসেবে বিবেচনা করে সম্প্রতি বিবৃতি দিয়েছে।
অথচ ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার অপরাধে ১৯৭১ সালে যখন নির্বিচারে বাঙালি নিধন চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ভালোবাসা পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, তখন ওনাদের নির্বাচন আর গণতন্ত্রের প্রতি ভালোবাসা ছুটিতে ছিল বলে প্রতীয়মান হয়।
উল্টা পাকিস্তানের পেয়ারে দিওয়ানা হয়ে বাঙালি নিধন অব্যাহত রাখতে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে এই স্বঘোষিত গণতন্ত্রের গ্লোবাল ফেরিওয়ালা দেশটি! তখন বোধকরি গণতন্ত্রের সংজ্ঞা ভিন্ন ছিল এদের ডিকশনারিতে!
এমতাবস্থায়, একটা প্রশ্ন যে প্রায় প্রত্যেক বাংলাদেশির মনে আসছেই সে ব্যাপারে আমি সন্দেহাতীত। বাংলাদেশের প্রতি পশ্চিমাদের বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পোষ্যমিত্রদের এইরকম ‘মায়ের চেয়ে মাসীর (তাও আবার দু:সম্পর্কের) দরদ বেশী’ টাইপ ভালবাসার কারণ কি হতে পারে?
১. হতে পারে, তারা বাংলাদেশকে নিজের দেশের চেয়ে বেশি ভালোবাসে! বাস্তবে, নিজের দেশের চেয়ে অন্য দেশের প্রতি বেশী দুর্বলতা প্রদর্শনের এই চারিত্রিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে পৃথিবীর বেশীরভাগ দেশের থেকে আমাদের এগিয়ে থাকার সম্ভাবনাই বেশী বলে আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়!
২. হতে পারে, রাজনীতি বা মানবাধিকারের মুখোশ পরে বিবৃতি বাণিজ্য করে পেট চালানো পশ্চিমা প্রজাতির কারও কারও ব্যক্তিগত বা ব্যাবসায়িক বা দলীয় ফান্ডে বড় অংকের ডোনেশন দিয়ে বিবৃতি কেনা-বেচা করা হচ্ছে, যা পশ্চিমা দেশগুলোতে আইনসিদ্ধভাবে অহরহই হয়ে থাকে। আর এই জাতীয় কর্মকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমাদের পোষা বেড়ালদের, কিংবা মূকাভিনেতা হয়ে শ্রেষ্ঠ গায়কের পুরস্কার পাওয়ার মতো গোবেল-নোবেল পুরষ্কার পাওয়া কারও কারও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কন্ট্রিবিউশনই যে বড় ভূমিকা রেখে চলেছে, এতে দ্বিমত করার খুব বেশী লোক পাওয়া যাবে বলে আমার মনে হয় না।
৩. অথবা, বাংলাদেশের ক্ষতি করে নিজেদের সরকারের বড় ধরনের স্বার্থ উদ্ধারের ধান্দা আছে এই বিবৃতিবাজদের, যা বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সময় আদায় করা যাচ্ছে না।
সাম্প্রতিককালে এসব অবশ্যম্ভাবী বহিরাগত ধান্দাবাজদের নিয়োগকরা প্রোপাগান্ডাবাজ এজেন্টদের প্রোপাগান্ডা তৈরির অপচেষ্টার মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, সেদিন কোনো এক অনলাইন পত্রিকার ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ে প্রকাশ করা একটি প্রতিবেদনে লক্ষ্য করলাম কতিপয় একই ধাঁচে তৈরি একাউন্ট থেকে মোটামুটি একই ধাঁচের বাক্য ব্যাবহার করে ‘গরু’ রচনার গরুকে কোনরকমে ঠেলে নদীতে নামিয়েই নদী নিয়ে রচনা লেখার অপচেষ্টা করা হচ্ছে মনপ্রাণ দিয়ে।
এদের মন্তব্য পড়লে মনে হতে পারে যেন ডেঙ্গু লার্ভা সরকারি দলের লোকেরা বাসায় বাসায় গিয়ে ডিম পেড়ে জন্ম দিয়ে আসে, আমাদের সাধারণ জনগণের অসাবধানতার কোনই ভূমিকা নেই এতে?! এরা জোর করে প্রমাণ করতে চাইছিল যে - বর্তমান সরকারের পতন হলে যেন ডেঙ্গু সমস্যারও পতন হয়ে যাবে জনগণ যেভাবে চলছে সেভাবে চলতে থাকলেও?!
ভাবা যায়, কি সহজ মনে করে এরা বাংলাদেশের জনগণকে বোকা বানানো! ভুলভাল, মিথ্যা অপপ্রচার করে খেটে খাওয়া সাধারন মানুষকে তাদের প্রচলিত বা কমন কয়েক ধরনের দুর্বলতাকে ব্যাবহার করে দলীয় কর্মী বানিয়ে খেলার মাঠের সহজলভ্য ফুটবল হিসেবে মধ্যমাঠে নামিয়ে দিয়ে আশা করে যে ফুটবলগুলো লাথি খেয়েই যাবে, আর ‘গোল গোল’ চিৎকার করে লম্ফজম্ফ করে কাপ মাথায় তুলে নাচবে এদের লাথিবাজ মুরুব্বিরা!
জনসাধারণকে জরুরী ভিত্তিতে অনুধাবন করতে হবে যে, সব কিছুতে রাজনীতি ঢুকানোর অসুস্থতা থেকে আগে নিজেদেরকে মুক্ত করে সমাজ ও পরিবেশের প্রতি নিজ দায়িত্বটুকু পালন করতে হবে সবার আগে! আমার কাজটা আমি না করে বসে থাকবো আর অন্য কেউ এসে আমার ঘরে ঢুকে আমার মনের মতো করে তা করে দিয়ে যাবে, এ চিন্তা বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে ভ্রান্ত দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই না।
দু:খজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশের রাজনীতির অপেক্ষাকৃত নিম্নমান, রাজনৈতিকদের ক্রমবর্ধমান প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও নৈতিক দৈন্যতার কারণে কাটতি বাড়ছে এসব পশ্চিমা অপশক্তির এজেন্টদের, আবির্ভাব হচ্ছে হিরো, নুরা, রেজা টাইপ ধূর্ত ধান্দাবাজদের!
সর্বোপরি, সারা পৃথিবীর শান্তি বিনষ্টকারী আমেরিকার মতো দুষ্ট রাষ্ট্রযন্ত্র ও তার দোসররা নিজেদের ধান্দামাখা ষড়যন্ত্র আর এজেন্ট মারফত সাজানো নাটকের মাধ্যমে বার বার বাংলাদেশের জনগণের বোধবুদ্ধি বা বৃহত্তর ইচ্ছা কে অপমান করার এইরকম ধৃষ্টতা দেখানোর সাহস পায় মূলত গায়ের জোরে, আর আমাদের দেশের ভিতরে বা বাইরে বসে নিজেদের স্বার্থ গুনতে থাকা কতোগুলো দেশদ্রোহী বেঈমানের কারণে!
ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের জনগণ একনায়কতন্ত্র বা অসহনীয় অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা নিজেরাই পরিবর্তন করেছে যখনই সময় হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশী আবেগী হতে পারে, ক্ষেত্র বিশেষে কারণে অকারণে নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করায় চ্যাম্পিয়ন হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশ কাদের হাতে আছে, কাদের কাছে থাকলে কোন পথে এগুতে পারে, দেশের এগিয়ে যাওয়াকে কারা উদযাপন করেন আর কাদের গাত্রদাহ হয়, এই ব্যাপারে যা বোঝার তারা ঠিকই বোঝেন! স্রোতের বিপরীতে পথ চলে, আমরাই যে আমাদের ভাগ্য পজিটিভলি বদলাতে পারি, সেই দৃষ্টান্ত গত দেড় দশকে একের পর এক বৈশ্বিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও বারবার দেখেছে বাংলাদেশের সাধারন মানুষ!
এই দেশটা যেমন কেউ আমাদেরকে থালায় সাজিয়ে দিয়ে যায় নাই, এই দেশের সমস্যাগুলোও বাইরে থেকে এসে কোন ধান্দাবাজ গোষ্ঠী বা দেশ কোনো ধরনের যন্তর-মন্তর দিয়ে ঠিক করে দেবে না, দিতে পারে না। লড়াই করে নিজের অধিকার, নিজের জায়গা খুঁজে নেয়া যে জাতির সংস্কৃতির অংশ, তার বৃহত্তর অংশকে পাশে নিয়ে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্ব অবশ্যই সব বহিরাগত ও অভ্যন্তরীণ সুযোগ সন্ধানী ধান্দাবাজদেরকে তাদের দোসর ও ধান্দা সমেত নিষ্ক্রিয় করে বাংলাদেশের দুরন্ত গতিতে এগিয়ে যাওয়ার চলমান প্রক্রিয়াটি অব্যাহত রাখতে পারবে, এই ব্যাপারে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে অন্তত আমার কোনো সন্দেহ নেই।
বাংলার খেটে খাওয়া মানুষের ভাগ্য নিয়ে বাইরের কাউকে এক্কা-দোক্কা খেলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আমাদের পূর্বজরা জীবন যৌবন বিলিয়ে দিয়ে দেশ স্বাধীন করেন নাই, এটা নতুন প্রজন্ম জানে। অতএব, মিয়াভাই সাবধান, আপনাদের ধান্দা আর যাই হোক বাংলার মানুষের হিতের জন্য নয়, এটা বুঝতে আইনস্টাইন হওয়ার প্রয়োজন নাই! বাংলার জমিনে বহু ধান্দাবাজ মিয়াভাই দাফন আছে, ইতিহাস থেকে জেনে নেবেন প্লিজ!
লেখক: তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার বিশেষজ্ঞ, সদস্য, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাডভাইজারি প্যানেল, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
মন্তব্য করুন