উপরে ওঠার ইচ্ছা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিরই অংশ। তাই কেউ বিমান চালিয়ে উঁচুতে ওঠে, কেউ গাছ বেয়ে উঁচু বা মগ ডালে ওঠে, কেউ পর্বত আরোহন করে তার চূড়ায় ওঠে, কেউ ক্যারিয়ারের শীর্ষে ওঠে, কেউ কোনো প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত হয়, আবার কেউ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। এগুলো কেউ না পারলে সে অন্তত পরিবারের শীর্ষ পদে আসীন হয় অর্থাৎ পরিবার প্রধান হন।
কিন্তু স্ব স্ব অবস্থান থেকে সঠিক সময়ে নিরাপদে নামার জন্য বা সরে দাঁড়ানোর জন্য প্রত্যেককেই কৌশল রপ্ত করতে হয়। কেননা এসব অবস্থানে চিরস্থায়ী হওয়ার সুযোগ নেই। দুদিন আগে হোক বা দুদিন পরে হোক তাকে নামতেই হয় বা সরে দাঁড়াতে হয়। আর নামার বা সরে দাঁড়ানোর কৌশল জানা না থাকলে মান-সম্মান নিয়ে নিরাপদে নামার বা সরে দাঁড়ানোর সুযোগ হাত ছাড়া হয়।
তাই বুদ্ধিমান ব্যক্তি মাত্রই উপরে ওঠার শিক্ষা আয়াত্বের পাশাপাশি অধিক গুরুত্বের সাঙ্গে নিচে নামার বা সরে দাঁড়ানোর কৌশলও রপ্ত করে। যেমন একজন পাইলটকে যতটা গুরুত্বের সাথে বিমান উড্ডয়ন শিখতে হয় তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বের সাথে বিমান অবতরণ শিখতে হয়। একজন বোধবুদ্ধি সম্পন্ন খেলোয়াড়রা ভালো পারফর্মেন্স থাকতেই সহখেলোয়াড়দের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে খেলাকে বিদায় জানিয়ে ভক্তদের মণিকোঠায় নিজেদের ঠাঁই করে নেয়। একজন দক্ষ গাছুড়ের নিরাপদে গাছ থেকে নামতে কোনো বিপত্তির সম্মুখীন হয় না। একজন প্রশিক্ষিত পর্বত আরোহীরও পর্বত শৃঙ্গ জয়ের পর নিরাপদে নামার ক্ষেত্রে তেমন বিপত্তির মুখোমুখি হয় না।
একজন সৎ, দক্ষ এবং নির্লোভ শীর্ষ কর্মকর্তা চাকরির নির্ধারিত মেয়াদ শেষে অতিরিক্ত মেয়াদে থাকার জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে আগ্রহী হয় না। একজন বুদ্ধিমান পরিবার প্রধান সময়মতো পরিবারের দায়িত্ব ছেলে বা পুত্র-বধূর উপর ন্যাস্ত করেন। তেমনি একজন বিচক্ষণ এবং জনসমর্থিত রাষ্ট্রনায়ক তার প্রতি জনগণের সমর্থন তলানিতে যাওয়ার আগেই রাষ্ট্র ক্ষমতা ছেড়ে দেয় বা ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার লিপ্সা থেকে বিরত থাকে।
কিন্তু বিপত্তি বাঁধে চালাক এবং নির্বোধদের ক্ষেত্রে। তারা মনে করে কোনো ভাবে শীর্ষে উঠতে পারলেই হলো। তাই তারা শট-কাট উপায় অবলম্বন করে- সেটা বিমান উড্ডয়নের ক্ষেত্রে হোক, গাছ ওঠার ক্ষেত্রে হোক, পর্বতে আহরণের ক্ষেত্রে হোক, শীর্ষ পদ কিংবা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষে আসীনের ক্ষেত্রে হোক। নামার বা সরে দাঁড়ানোর কথা তারা ভাবে না কিংবা নামার বা সরে দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। কিন্তু তারা যা-ই ভাবুক, প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী তাদের একসময় নামতে হয় বা সরে দাঁড়াতে হয়।
প্রমাণ ঘাটলে দেখা যায়, বিমান উড্ডয়ন, গাছে ওঠা এবং পর্বত আরোহনের ক্ষেত্রে নিচে নামার প্রশিক্ষণ উপরে ওঠার প্রশিক্ষণের সাথে ইনবিল্ট থাকে। এসব ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের অংশ হিসাবে কিছুটা ওঠার পর নেমে যায় যা বারবার করতে হয়। ফলে সচরাচর এমন কাউকে দেখা যায় না, সে বিমান উড্ডয়ন করতে পারে, গাছে উঠতে পারে কিংবা পর্বত আরোহন করতে পারে কিন্তু বিরূপ পরিস্তিতি ছাড়া নিচে নামতে পারে না কিংবা নামতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়।
কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীনের ক্ষেত্রে পৃথিবীব্যাপী ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে যে তারা ক্ষমতা থেকে নিরাপদে নামার বা সরে দাঁড়ানোর কৌশল রপ্ত করেনি। বিশেষ করে যেখানে গণতন্ত্র সুসংহত নয়। দেশে এবং দলের ভিতর সঠিক গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ রাজীনীতিবিদের ক্ষমতা আরোহনের এবং ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর শিক্ষা দেয়। দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র চর্চার অভাবে বিমানের পাইলট, গাছুড়ে বা পর্বত আরোহীর মতো তারা নামার বা সরে দাঁড়ানোর প্রশিক্ষণ পায়নি বা নেয়নি। এর মূল কারণ কেউ পারিবারিক সূত্রে, কেউ উর্দির বলে আবার কেউ বা অর্থের জোরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হন। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার রাজিনীতে যোগদানের সাথে সাথেই দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে এমনকি দলীয় প্রধানের দায়িত্ব পেয়ে যায়। ফলে তারা দলের একচ্ছত্র ক্ষমতার মালিক হয়ে যায়।
স্বার্থান্বেষী, তোষামোদি চক্র এবং চাটুকারদের প্রভাবে এক পর্যায়ে তারা দলের নেতাকর্মীদের নিকট দেবতা হিসাবে বিবেচিত হয়। আর দেবতারা তো স্বর্গে থাকতে পছন্দ করে। মর্তে তো তারা নামতে চায়না। তাই বিমানের পাইলট, গাছুড়ে বা পর্বত আরোহীর মতো প্রতিবার একটু একটু করে উপরে ওঠে নেমে আসার প্রশিক্ষণ না থাকার কারণে তারা ক্ষমতা থেকে নামতে বা সরে দাঁড়াতে প্রচন্ড ভয় পায়। আর পরিস্থিতি বিরূপ হলে রাষ্ট্রের সকল বল প্রয়োগ করে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মরিয়া হয়।
তবে, এ কৌশল যে সব সময় কাজে লাগেনা তারও ভুরি ভুরি প্রমান আছে। কেননা জনগণের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেলে সকলে মিলে গাছের গোড়া ধরে ঝাঁকানোর মতো যখন দেশটিকে ঝাকুনি দেয় তখন আর শেষ রক্ষা হয়না। কিন্তু ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয়না বলেই বারংবার ইতিহাসের পুনরাবিত্তি ঘটে।
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক
মন্তব্য করুন