গত বছরের ৫ আগস্ট বাংলাদেশ যে অভূতপূর্ব পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছে, সেই পরিবর্তনের সম্মুখ সারিতে ছিল এদেশের শিক্ষার্থীরা। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেই আন্দোলন পাল্টে দিয়েছে দেশের গতিপথ।
ক্ষমতার অপব্যবহার, নিয়োগে অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি অনেক কিছুই গত এক দশকে শিঙ্গাঙ্গনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। যার প্রভাবও পড়েছে উচ্চশিক্ষায়। এই শিক্ষার্থীরাই দাঁড়িয়েছে অনিয়মের বিরুদ্ধে। অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা থেকে বেরিয়ে শিক্ষার নতুন পরিবেশের প্রত্যাশা শিক্ষার্থী-শিক্ষকসহ দেশের সবারই।
সে পথের দিকে এগিয়ে যাওয়াটা দরকার। কারণ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও শিক্ষাঙ্গনে দেখা দিচ্ছে অস্থিরতা। মব জাস্টিসের শিকার হয়ে খুন হয়েছেন প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থী। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) ঘটেছে সংঘর্ষের ঘটনা। ছয় দফা দাবিতে দেশের প্রায় সব পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে চলছে ‘কমপ্লিট শাটডাউন।’ একাডেমিক কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ আছে। এর আগে দাবি নিয়ে রাজধানীর সড়ক অবরোধের মতো ঘটনাও ঘটেছে।
গত এপ্রিলে মানুষ বিস্মিত হয়ে দেখল রাজধানীর ব্যস্ততম রাস্তায় ঢাকা কলেজ ও ঢাকা সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মারামারি ও ভাঙচুর। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সম্প্রতি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতেও বিভিন্ন ইস্যুতে বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা। যার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রেখেছেন।
সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ৯ মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্তত ১৯টি সংঘর্ষ, ৯টি আন্দোলন এবং ৩টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব আন্দোলন ও সংঘর্ষের পেছনে কারও ইন্ধন রয়েছে, নাকি পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের প্রভাবে এগুলো কেবলই ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’, তা নিয়ে তদন্ত করা প্রয়োজন। তবে যাই হয়ে থাকুক না কেন, শিক্ষাঙ্গনে এই সার্বিক অস্থিতিশীলতার যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, তার দীর্ঘমেয়াদি কুফল যে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরই ভোগ করতে হবে, তা নিয়ে সন্দেহের সুযোগ নেই।
একটু পেছনে ফিরে যদি তাকাই, তবে আমরা দেখতে পাই গত দেড় দশকে দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধীরে ধীরে রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রলোভনের বলয়ে চলে গিয়েছে। বর্তমানে দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৫টি, এর মধ্যে ২৫ টিই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বিগত সরকারের আমলে। অভিযোগ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক নিয়োগে অনেক ক্ষেত্রেই নীতিমালার যথাযথ অনুসরণ হয়নি, বরং ক্ষমতার অপব্যবহার ও স্বজনপ্রীতি নিয়োগ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করেছে।
এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির পাশাপাশি শিক্ষকদের দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোতে একটি সাংগঠনিক সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য- জ্ঞানচর্চা ও গবেষণাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। এমনকি যেসব শিক্ষক একাডেমিক দিক থেকে যোগ্য, তাদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
এমন পরিস্থিতিতে, তথা রাজনৈতিক বলয়ে আবিষ্ট থাকার কারণে সরকার পরিবর্তনের পর দেশের বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপউপাচার্য, কোষাধ্যক্ষসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা দায়িত্ব ছেড়ে দেন বা আত্মগোপনে চলে যান। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কার্যত দিশাহারা হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগেও পড়ে। অনেক জায়গায় শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে কিছু শিক্ষককে পদত্যাগ করতে হয়। সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একদিকে শিক্ষক সংকট, অন্যদিকে প্রশাসনিক অচলাবস্থা তৈরি হয়। এতে করে দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয় এবং শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা থেকে ছিটকে পড়ে।
নয় মাস পেরিয়ে গেলেও শিক্ষাঙ্গনে স্থিতিশীলতা ফিরছে না। যার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের মননে, জীবনযাত্রায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘রিভার্স ব্রেইন ড্রেইন’ হ্যাশট্যাগে একটি ট্রেন্ড চালু হয়েছিল। এর মাধ্যমে দেশের বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক ছাত্ররাই দেশে ফিরে স্ব স্ব ক্ষেত্রে কাজ করে দেশসেবা করবেন বলে মনস্থির করেছিলেন। ‘রিভার্স ব্রেইন ড্রেইন’ তো দূরের কথা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ বিবেচনা করে ব্যক্তিজীবনে অনেক শিক্ষার্থীই বর্তমানে দেশ ছাড়ার কথা ভাবছেন, উচ্চশিক্ষা ও জীবন গড়ার জন্য বেছে নিচ্ছেন ইউরোপ-আমেরিকার কোনো দেশ।
এমনিতেও বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় উচ্চশিক্ষায় পিছিয়েই আছে বাংলাদেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ব্যবস্থার মান পর্যালোচনা করে প্রতি বছর নানা রকম র্যাংকিং প্রকাশ করা হয়। এ র্যাংকিংগুলোর দিকে তাকালে আমরা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা পাই। যেমন- যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী টাইমস হায়ার এডুকেশন (টিএইচই) কর্তৃক প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাঙ্কিং ২০২৫’-এ বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম তালিকাভুক্ত থাকলেও শীর্ষ ৮০০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটিও স্থান করতে পারেনি। এছাড়া ‘কান্ট্রিজ উইথ বেস্ট পার্ফর্মিং এডুকেশন সিস্টেম’ শীর্ষক সিইও ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনের সর্বশেষ সংস্করণের ৯৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও নেই বাংলাদেশের নাম।
এই র্যাংকিংগুলো তৈরিতে শিক্ষার মান, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত, গবেষণার গুণগত মান, প্রকাশনার সাইটেশন সংখ্যা ও আন্তর্জাতিকীকরণসহ একাধিক সূচক বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ পর্যালোচনা করলে- গবেষণার দুর্বলতা, অপ্রাসঙ্গিক পাঠ্যক্রম ও সর্বোপরি দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে কার্যকর দিকনির্দেশনার অভাবই মোটাদাগে পরিলক্ষিত হয়। আর নিঃসন্দেহে এ বিষয়গুলোর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে ‘শিক্ষাঙ্গন রাজনৈতিকরণ’।
যেখানে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা দীর্ঘদিন ধরেই নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে, তার মধ্যে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সার্বিক অস্থিতিশীলতা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় আরও পিছিয়ে দেবে বলেই শঙ্কা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি শিক্ষার্থীদের অনাস্থা, প্রশাসনিক দুর্বলতা, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাব এবং অস্বচ্ছ নীতিমালা শিক্ষাঙ্গনের সংকটকে আরও গভীর করছে। দ্রুত এ পরিস্থিতির সমাধান করতে না পারলে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পূর্ববর্তী অবস্থাতেই ফিরে যেতে হবে ক্যাম্পাসগুলোকে। আর বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনের মঙ্গল চাইলে তা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
সার্বিক অস্থিতিশীলতা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় আরও পিছিয়ে দেবে বলেই শঙ্কা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি শিক্ষার্থীদের অনাস্থা, প্রশাসনিক দুর্বলতা, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাব এবং অস্বচ্ছ নীতিমালা শিক্ষাঙ্গনের সংকটকে আরও গভীর করছে। দ্রুত এ পরিস্থিতির সমাধান করতে না পারলে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পূর্ববর্তী অবস্থাতেই ফিরে যেতে হবে ক্যাম্পাসগুলোকে। আর বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনের মঙ্গল চাইলে তা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
চলমান এ সংকট নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সবারই উচিত প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে অবিলম্বে একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা। যার মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আস্থার সম্পর্ক পুনর্গঠন এবং শিক্ষাঙ্গনে সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত হবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন