এক সময় আফগানিস্তানের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল কাবুল। তবে আজ এক মহাবিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে এ শহরটি। ছয় মিলিয়নেরও বেশি মানুষের এই শহরটি এখন মারাত্মক পানির সংকটে ভুগছে। এমনকি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সতর্ক করে বলছে- যদি বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকে, তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যেই কাবুল হতে পারে পৃথিবীর প্রথম বড় শহর যেখানে একফোঁটা পানিও থাকবে না। প্রায় ৩০ লাখ মানুষের স্থানচ্যুতি ঘটতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
২০২৫ সালের একটি প্রতিবেদনে বেসরকারি সংস্থা মার্সি কর্পস জানিয়েছে, কাবুলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২৫ থেকে ৩০ মিটার পর্যন্ত নেমে গেছে গত দশকে। শহরে যত পানি উত্তোলন হচ্ছে, তার চেয়ে প্রাকৃতিকভাবে মাটির নিচে ফিরে যাচ্ছে অনেক কম পরিমাণ পানি। প্রতি বছর প্রায় ৪৪ মিলিয়ন কিউবিক মিটার কম পানি জমছে কাবুলে।
এই হারে পানি উত্তোলন চলতে থাকলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই পানির স্তর পুরোপুরি শুকিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলে জানাচ্ছে গবেষণা। ইউনিসেফ-এর হিসাব অনুযায়ী, শহরের অর্ধেকেরও বেশি কূপ ইতোমধ্যেই শুকিয়ে গেছে এবং বাকি পানির ৮০ শতাংশ দূষিত। এতে রয়েছে বিষাক্ত উপাদান যেমন- আর্সেনিক, লবণ এবং বর্জ্য।
পানি ছাড়া জীবন কল্পনাও করা যায় না। অথচ কাবুল শহরটি দ্রুত এক ভয়াবহ বাস্তবতার দিকে এগোচ্ছে- সম্পূর্ণ পানিশূন্যতার।
কেন এমন সংকট?
বিশেষজ্ঞরা কাবুলের পানি সংকটের প্রধান তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছেন :
জলবায়ু পরিবর্তন : তুষারপাত কমে যাওয়া, তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া ও পাহাড়ি নদীগুলোর পানি হ্রাস- সব মিলিয়ে পানির প্রাকৃতিক পুনরায় ভরাট প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
অব্যবস্থাপনা ও দুর্বল প্রশাসন : দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ এবং তালেবান শাসনের পর উন্নয়ন কার্যক্রম স্থগিত হয়েছে। পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
অতি জনসংখ্যা বৃদ্ধি : ২০০১ সালে কাবুলের জনসংখ্যা ছিল এক মিলিয়নেরও কম, এখন তা ছয় মিলিয়নের বেশি। যুদ্ধে বাস্তুচ্যুত বহু মানুষ শহরে আশ্রয় নেওয়ায় চাপে ভেঙে পড়েছে পানির অবকাঠামো।
ধনী ও গরিবের পানির ব্যবধান
কাবুলে ধনীরা নিজেদের জন্য গভীর কূপ খনন করে পানি সংগ্রহ করতে পারে। কিন্তু গরিব মানুষ, বিশেষ করে বস্তি এলাকায় বসবাসকারীরা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পানির ক্যান নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো যেন তাদের জীবনচক্রের স্বাভাবিক অংশ।
বাণিজ্যিক অপচয় ও কৃষিতে অতিরিক্ত ব্যবহার
শহরে ৫০০-রও বেশি পানীয় কোম্পানি ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে, যাদের অনেকেই নিয়ন্ত্রণহীনভাবে এই জলসম্পদ ব্যবহার করছে। একাই অলোকজাই নামে একটি কোম্পানি প্রতিদিন ২৫ লাখ লিটার পানি তুলে নিচ্ছে।
এছাড়াও, ৪০০ হেক্টর জমিতে সবজি উৎপাদনের জন্য নির্মিত গ্রিন হাউসগুলো বছরে প্রায় ৪০০ কোটি লিটার পানি ব্যবহার করে। অথচ এই পানি সঞ্চয় করে মানুষের প্রয়োজন মেটানোও সম্ভব ছিল।
প্রকৃতি ও যুদ্ধ
হিন্দুকুশ পাহাড় থেকে নেমে আসা কাবুল, পাঘমান ও লোগার নদীর পানিপ্রবাহ কমে গেছে। ২০২৩-২৪ সালের শীতেও শহরে স্বাভাবিকের তুলনায় মাত্র ৪৫-৬০ শতাংশ বৃষ্টি ও তুষারপাত হয়েছে।
একইসঙ্গে, যুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে এখানে। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার পর আন্তর্জাতিক অনুদান, প্রকল্প এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা বন্ধ হয়ে গেছে।
একটি সম্ভাব্য সমাধান ছিল- লোগার নদী থেকে কাবুলে পানি সরবরাহের প্রকল্প। এ নদীটি বছরে ৪৪০ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করতে পারত। কিন্তু সেটিও আন্তর্জাতিক অনুদান বন্ধ হওয়ায় থেমে গেছে। এছাড়াও, ভারতের সঙ্গে শাহ-তুত বাঁধ প্রকল্পও এখন অনিশ্চয়তার মুখে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যৎ অনিবার্য হয়ে যাবে। যেমন-
# ভূগর্ভস্থ পানিধারা পুনরায় পূরণ (Artificial Recharge) প্রকল্প চালু করা
# পাহাড়ি নদী ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য বাঁধ, চেক ড্যাম ও রিজার্ভার নির্মাণ
# পানির পাইপলাইন মেরামত ও আধুনিকীকরণ করে অপচয় বন্ধ করা
# জলবায়ু সহনশীল পানি ব্যবস্থাপনা কৌশল গ্রহণ
# আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ফিরিয়ে আনা
তবে এসব উদ্যোগ কার্যকর করতে হলে, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতে হবে এবং আফগানিস্তানকে পুনরায় বৈশ্বিক উন্নয়ন কাঠামোর অংশ হতে হবে।
কাবুলের পানি সংকট শুধু পরিবেশগত নয়। এটি রাজনৈতিক, সামাজিক এবং বৈশ্বিক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। যদি এখনই সুপরিকল্পিত ও সমন্বিত উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে কাবুল হতে পারে সেই প্রথম শহর, যেখানকার মানুষরা সকালে ঘুম থেকে উঠে বুঝবে তাদের শহরে আর একফোঁটাও পানি নেই।
সূত্র : আলজাজিরা
মন্তব্য করুন