অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার
প্রকাশ : ১৩ জুন ২০২৫, ০৫:২৮ পিএম
আপডেট : ১৩ জুন ২০২৫, ০৫:৩০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

জনস্বাস্থ্য শিক্ষাকে উপেক্ষা করে ভেক্টর বাহিত রোগ প্রতিরোধ অসম্ভব

অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার। সৌজন্য ছবি
অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার। সৌজন্য ছবি

বাংলাদেশ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের অত্যন্ত ঘন বসতির একটি দেশ। যেখানে প্রতি বর্গমাইলে ৩,৪৯৬ জন লোকের বাস। আর ঢাকা শহরে এর ঘনত্ব বর্গমাইলে ৫০,০০১ জন। এই বিশাল ঘনবসতি এলাকার মানুষ যদি যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলে তবে কখনই সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ সম্ভব নয়। একদিকে যেমন অধিক সংখ্যক মানুষ তাদের চলাচল ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজে নিয়োজিত। অন্যদিকে পরিবেশ তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের বাহক ও জীবাণুর-আঁতুড় ঘরে। কি শহর? কি গ্রাম? সব স্থানেই আজ ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার দৌরাত্ম্য লাগামহীন হয়ে পড়েছে।

মশার মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্যে বেড়ে ওঠা ডেঙ্গু ভাইরাস তার ভয়াল থাবায় কেড়ে নিচ্ছে অতিমূল্যবান প্রাণ। এর মধ্যে আরেক ভয়ানক এক ভাইরাস করোনাও বেশ ভালোভাবেই উঁকিঝুঁকি মারছে। দেশে কাঙ্ক্ষিত খাদ্য উৎপাদনের জন্য দিশাহারা কৃষককুল যেমন যথেচ্ছা কীটনাশক ও রাসায়নিক সার প্রয়োগের মাধ্যমে সমগ্র পরিবেশকে করে তুলেছে মশা ও অন্যান্যবাহক ও জীবাণুর অভয়ারণ্য। তেমনিভাবে প্রতিনিয়ত উৎপাদিত বর্জ্য ও বৈশ্বিক তাপমাত্রা জীবাণু ও মশার শত্রু বৃদ্ধিতে দিয়েছে ঘি ঢেলে। এমনি এক পরিস্থিতিতে যোগ হয়েছে খাদ্যে পুষ্টির পরিবর্তে বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি। তাই তো যথাযথই এখন আওয়াজ উঠেছে ‘খাদ্যের নিরাপত্তা নয়, চাই বিশুদ্ধ খাদ্যের নিরাপত্তা।’ এই নানামুখী সমস্যার প্রতিফলন পড়েছে জনস্বাস্থ্যের উপর। আজ ঘরে ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, স্ট্রোক, হাট ফেইলার প্রভৃতি নন-কমিউনিক্যাবল রোগগুলোর সঙ্গে ডেঙ্গু, করোনা প্রভৃতিতে নিদারুণভাবে জর্জরিত জাতি। তাই তো একজন উপদেষ্টা যথার্থই বলেছেন, সারা দেশটাকেও যদি একটি হসপিটালে রূপান্তর করা হয় তারপরও সমস্যার সমাধান হবে না। তাহলে সমাধান কি? সমাধান একটাই তা হলো জনস্বাস্থ্য শিক্ষা ও এর যথাযথ বাস্তবায়ন। মানুষ নিজে যদি বুঝতে পারে।

গরুকে যে গ্রোথ রেগুলেটরি হরমোন খাওয়ানো হচ্ছে মোটাতাজাকরণের জন্য তা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। তার বিকল্প কি হতে পারে এখন, তা বিজ্ঞানীরাই ঠিক করবে। সাধারণ মানুষ যদি বুঝতে পারে যথেচ্ছা কীটনাশক প্রয়োগ ক্যানসারসহ অন্যান্য জটিল রোগের কারণ। একইভাবে পরিবেশদূষণই ভেক্টরবাহিত রোগের অন্যতম কারণ। অনিয়ন্ত্রিত জাঙ্ক ফুডই অবিসিটি বা স্থুলকায়নের মূলকারণ, যা ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য জটিল রোগের উৎস।

মহান স্বাধীনতার সময় দেশের জনসংখ্যা ছিল মাত্র সাড়ে সাত কোটি। চাষযোগ্য জমির পরিমাণও এখনকার তুলনায় প্রায় তিনগুণ ছিল। অথচ তারপরও খাদ্য ঘাটতি ছিল। আর এখন লোকসংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। আবার চাষযোগ্য জমি কমে গেছে একই হারে। তারপরও আমরা বলতে পারি, খাদ্যে মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমরা আর এখন বুক চেতিয়ে বলতে পারি মাছ উৎপাদনে আমরা বিশ্বে চতুর্থ। চাল উৎপাদনে আমাদের অবস্থান রয়েছে। রয়েছে কৃষির অন্যান্য উৎপাদনেও। এর পিছনে যে শক্তি কাজ করেছে তা ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। সারা বছর ধরে সবজি, মাছ, মাংস, দুধ, ডিমসহ সব পুষ্টি সরবরাহের সুফল বয়ে এনেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি বিজ্ঞানীদের কর্মতৎপরতা। দেশের মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে। তাই কৃষিপ্রধান দেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন সত্যিই ছিল যুগান্তকারী একটি পদক্ষেপ।

এই পদক্ষেপ গৃহীত না হলে আজকেও হয়তোবা এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে খাদ্যের জন্য অন্যের দরবারে ভিক্ষুকের মতো হাত পাততে হতো। বিলিয়ে দিতে হতো আমাদের জাতি-সত্তাকে। যেমন করে চিকিৎসার জন্য, একটি টেস্টের রিপোর্টের জন্য ভিখারীর মতো চেয়ে থাকতে হয় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের লাল প্যাথ, এসআরএল বা অন্য কোনো ল্যাবের দিকে। প্রকৃত ডায়াগনসিসের অভাবে দেশের হাজার হাজার মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে অকাল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। একইভাবে সর্বস্বান্ত হচ্ছে চিকিৎসা ব্যয় মিটাতে। অকুল পাথারে নিমজ্জিত হচ্ছে হাজার হাজার পরিবার। তছনছ হয়ে যাচ্ছে এই মানব জনম। ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সোনালি ফসল বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচার, বাংলাদেশ ফিশারিজ গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন সফলতার সঙ্গে গবেষণা কর্ম সম্পাদন করে দেশ ও বিদেশে সুনাম অর্জন করেছে, তেমনি মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণে রেখেছে অ্ভুতপূর্ব অবদান। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে কৃষিতে বিশ্বের দরবারে সব মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। ঠিক এমনিভাবে দেশের এই ক্রান্তিকালে আশু প্রয়োজন হয়েছে জনস্বাস্থ্য শিক্ষা ও গবেষণার।

তাই জনস্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা অনস্বীকার্য হয়ে পড়েছে। জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, নিপসস, মহাখালী ঢাকা প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ অবধি জনস্বাস্থ্য শিক্ষায় শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে আসছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত স্বনামধন্য শীর্ষস্থানীয় এই প্রতিষ্ঠানের কাজের পরিধি বৃদ্ধির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর সময়ের প্রচণ্ড দাবিতে পরিণত হয়েছে। দেশে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব রিস্ক ফ্যাকটরগুলোকে গুরুত্ব অনুসারে একটি ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে নিয়ে সিস্টেমিক গবেষণার মাধ্যমে বাস্তবভিত্তিক প্রায়োগিক সমাধান বের করাই হবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান কাজ। এই বিশ্ববিদ্যালয় হতে উচ্চতর ডিগ্রি পাওয়া জনস্বাস্থ্যবিদরা দেশ-বিদেশে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষাবলয় হিসেবে কাজ করবে।

ধরুন ২০১৭ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গুর যে ধারাবাহিক ভয়াবহতা দিন দিন দেশবাসীকে এত নাজুক পরিস্থিতিতে নিয়ে যাচ্ছে তার গতিরোধের জন্য যে মানের ওয়ার্কফোর্স প্রয়োজন, যে মানের গবেষণাগার প্রয়োজন, যে মানের জনবলের প্রয়োজন তা শুধু অপ্রতুলই নয় একেবারেই নগণ্য। তাই এই বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিয়ত মৃত্যুর আশঙ্কা থেকে ফেরাতে চাই এমন মানের একটি জনস্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন গবেষণার মাধ্যমে আধুনিক ও গতিশীল কৌশল প্রযুক্তি ও প্যাটেন্ট উদ্ভাবন হবে।

যার ফলাফল জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বৈজ্ঞানিক বেষ্টনীতে সুদৃঢ়ভাবে ঘিরে রেখে সুরক্ষা প্রদান করে উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা বিধান করবে। যে বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে বিশ্বমানের গবেষণাকেন্দ্র ও এক্রিডেটেড ল্যাবরেটরি- যেখানে তৈরি হবে ইমার্জিং ও রি-ইমার্জিং টিকাসহ প্রতিরোধের সব রোগের টিকাসহ অন্যান্য ঔষধ ও বৈজ্ঞানিক কৌশল। নিশ্চিত হবে জনস্বাস্থ্য। সুরক্ষা পাবে অর্থনীতি। সমৃদ্ধ হবে দেশ।

লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান

কীটতত্ত্ব বিভাগ

জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, নিপসম, মহাখালী ঢাকা।

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

অনলাইনে ইলিশ বিক্রির নিবন্ধন পেলেন ৭ উদ্যোক্তা

ভিক্ষুকের ঘরে ২ বস্তা টাকা, গুনতে লাগল ৫ ঘণ্টা 

১০ অক্টোবর : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

গাজায় যুদ্ধবিরতি আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়েছে 

শুক্রবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

গাজা চুক্তিকে ইরান হামলার সঙ্গে যুক্ত করলেন ট্রাম্প

১০ অক্টোবর : আজকের নামাজের সময়সূচি

নোয়াখালী বিভাগ চেয়ে ইতালিতে প্রবাসীদের স্মারকলিপি

কাবুলে বিস্ফোরণ, ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে যা বললেন জবিউল্লাহ মুজাহিদ

‘ওলামা-মাশায়েখদের ত্যাগ-কোরবানি স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে’

১০

যুদ্ধবিরতিতে গাজার ঘরে ঘরে আনন্দ, রাস্তায় মিছিল

১১

সচেতন হলে ব্রেস্ট ক্যানসার প্রতিরোধ সম্ভব : চসিক মেয়র

১২

২০ মাসে মামলার রায়, স্ত্রী হত্যায় স্বামীর যাবজ্জীবন

১৩

ভোটের অধিকার পুনরুদ্ধারই জাতির একমাত্র লক্ষ্য : গয়েশ্বর

১৪

ঘুষি মেরে বিমানের মনিটর ভেঙে ফেললেন লন্ডন প্রবাসী

১৫

ইসরায়েলের যে কারাগারে বন্দি শহিদুল আলম

১৬

আফগানিস্তানে বিমান হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান, টিটিপি প্রধান নিহতের গুঞ্জন

১৭

বিকট বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল কাবুল

১৮

এককভাবে সরকার গঠন করবে বিএনপি : এমরান চৌধুরী

১৯

‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হলে রংপুর অচল করে দিতে বাধ্য হবো’

২০
X