তারিখ ২৩-০৭-২০২৩, সকাল ৮টায় পরিবার নিয়ে বাংলাদেশ বিমানে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করি। বাংলাদেশ বিমানের আন্তর্জাতিক রুট অনেকটা উন্নত হয়েছে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি সম্প্রতি কেনা নতুন বিমানগুলো অনেকটাই এমিরাটসের মতো দেখতে, সুযোগ সুবিধারও উন্নতি হয়েছে। এটা একটা শুভ লক্ষণই বটে। বিমান সিলেটে ৪৫ মিনিট বিরতি নিল। কারণ লন্ডনের অধিকাংশ বাংলাদেশের মানুষ সিলেটের বাসিন্দা। বিমানের দুই তৃতীয়াংশ যাত্রী ছিল সিলেট বিভাগের। তাই সিলেটকে দ্বিতীয় লন্ডন হিসেবে মনে করাটা অযৌক্তিক মনে করি না।
উল্লেখ্য, ভ্রমণসংক্রান্ত সবধরনের তথ্য উপাত্ত লিখে রাখার জন্য দেশ-বিদেশে কোথায় গেলে সাথে একটি নোট খাতা নিতাম। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। যা হোক বাংলাদেশ বিমান ওই দিন যথা সময় লন্ডনের হিথ্রো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করল। তখন লন্ডনের সময় বিকাল পাঁচটা। প্রায় ১০ ঘণ্টার যাত্রা শেষ হলেও ইমিগ্রেশনে এসে বিপাকে পরলাম। হিথ্রো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে খুব কড়াকড়ি।
আমরাও নিরাপত্তা কর্মীর নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হই। ভিসা পেলেই যে কোনো সমস্যা হবে না, এটা সঠিক নয়। একমাত্র ব্রিটিশ নাগরিক বা ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী ছাড়া কমবেশি সবারই নানা প্রশ্নের সস্মুখীন হতে হয়। যেমন কেন এসেছেন। কোথায় থাকবেন। পেশা কী ইত্যাদি। এটা ব্রিটিশ সরকারের নিয়ম। তাছাড়া প্রথম ব্রিটেন সফরে এলে সবারই কমবেশি এধরনের সমস্যায় পড়তে হয়। আমাদেরও ব্রিটেনে এটা ছিল প্রথম সফর। ২০২২ সালে জুলাই মাসে কানাডার টরেন্টো বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে কোনো ঝামেলা পোয়াতে হয়নি আমাদের। তারা বয়স্ক মানুষকে যথেষ্ট শ্রদ্ধার চোখে দেখে। পাসপোর্টে কানাডার ভিসা থাকলে বর্ধিত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় না। কয়েকটি দেশ ভ্রমণে আমার অবিজ্ঞতার আলোকে যতটুকু জেনেছি তাতে ইলেকট্রনিক ডিভাইস, প্রেসক্রিপসন ছাড়া ওষুধ এবং আন্তর্জাতিক বিমান ভ্রমণে আইন বহির্ভূত সবকিছুই অবৈধ।
যাহোক আমরা ব্রিটেন ভ্রমণের ছয় মাসের ভিসা পেয়েছিলাম। এমন সময় আমার মেয়ের জামাই ‘ওয়াটস আপ’-এ আমাদের সংবাদ জানতে চাইল। সে এয়ার পোর্টে এসেছিল আমাদের নিতে। আমরা সরাসরি ফোন কলটি সিকিউরিটি অফিসারকে দিলাম। সে কথা বলার সাথে সাথেই সিকিউরিটি অফিসার আমাদের যাওয়ার অনুমতি দিল।
পরে জানলাম বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ইমিগ্রেশনে কড়াকড়ি করা হয় হিথ্রো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। একজন মধ্যবয়সী মহিলাকে কাদতে দেখেছি ইমিগ্রেশনে আটকিয়ে দেয়ার জন্য। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, মেডিক্যাল টেস্ট, প্রেসক্রিপসন, প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র এবং পাসপোর্ট হাতের কাছে হ্যান্ডব্যাগে রাখতে হবে। প্রয়োজনে কবিট সার্টিফিকেট সাথে নেবেন। ডলার বা পাউন্ড যেখান থেকে কিনবেন তা বৈধভাবে নিজের নামে এনড্রোস করে নেবেন। স্বাস্থ্য বিমার বিষয়টিও ভাবতে হবে। পবিত্র হজ পালন করতে হলেও এসব বিষয় জানা দরকার।
বিমানবন্দর থেকে মূল সড়কে এসে ট্যাক্সিতে উঠে মেয়ের বাসা গ্রেসের (Grays) উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। দূরত্ব ৬১ মাইল। সময় লেগেছে মাত্র ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট। বাংলাদেশে এতটুক জায়গা যেতে কত সময় লাগত সেটা ঢাকাবাসীর অজানা থাকার কথা নয়।
লন্ডন শহরের শুরুটা দেখে মনে হলো দেশটির সুদক্ষ পরিকল্পনা এবং কাঠামোগত নির্মাণ কৌশল অত্যন্ত মজবুত এবং লেটেস্ট প্রযুক্তির সর্বস্তরে প্রয়োগ, যা বিচক্ষণতা এবং সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। শহরটা দেখতে মনে হবে কোনো বিখ্যাত অঙ্কন শিল্পীর আঁকা ছবির মতো। নেই কোনো কোলোহল ও উচ্চ শব্দ বা গাড়ির হর্ন। বিভিন্ন প্রজাতির মনোমুগ্ধকর গাছগাছালি, নানা রংবেরঙের ফুল আর ফলের বাগান রাস্তার হাইওয়ের দুইপাশে শোভা পাচ্ছে। শোনা যাবে নানা প্রজাতির পাখির কিচিরমিচির ডাক। সড়কের দুইপাশে বহুতল বিশিষ্ট কোনো ইমারত দেখিনি। এ দেশে ২ থেকে ৩ তলার ওপর বাড়ি নির্মাণে প্ল্যান দেওয়া হয় না। শহরকে সবুজ ও দুষণমুক্ত রাখার জন্য ব্রিটেন সরকারের রয়েছে বহুমুখী পরিকল্পনা। প্রথমেই ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনকে বিকেন্দ্রীয়করণ (Decentralization) প্রক্রিয়ায় গড়ে তোলা হয়েছে।
এই নিউজটি আমি বহু আগে থেকেই জানতাম। এখন স্বচক্ষে দেখছি। ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনে জনসংখ্যার চাপ যাতে না বাড়ে সেজন্য শতবছর পূর্বে তাদের পরিকল্পনা ছিল। সেন্ট্রাল লন্ডনে জনসংখ্যার চাপ বাড়ানো যাবে না। সেজন্য ব্রিটেন সরকার লন্ডনের চতুরমুখী ৩০০ থেকে ৪০০ মাইল দূরত্ব পর্যন্ত ৩৭৫টি ভিলেজ টাউন গড়ে তুলেছে। আমার দৃষ্টিতে এগুলো ভিলেজ টাউনের মতো মনে হলো। তাই আমি ইংল্যান্ড নিয়ে লেখায় লন্ডনের চতুরপাশে গড়ে ওঠা নান্দনিক ছোট ছোট শহরগুলোকে ভিলেজ টাউন হিসেবে উল্লেখ করেছি। ইউরোপের ২৬টি দেশের মধ্যে যুক্তরাজ্যের অবস্থান এক নম্বরে। পাশাপাশি ইলেকট্রনিক ট্রেন স্টেসন এবং ডাবল ডেকার বাস স্টেসন লেটেস্ট টেকনোলজি প্রয়োগ করে নির্মাণ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী জানে লন্ডন একটি সবুজ শহর (London is the green city of the world)। সেজন্য লন্ডনের আদলে লন্ডনের চতুর দিকে সবধরনের যাতায়াত ব্যবস্থার সুযোগ সুবিধাসহ প্রায় ৩৭৫টি সবুজায়নে সুসজ্জিত ও মনোমুগ্ধকর নান্দনিক ভিলেজ টাউন গড়ে তোলা হয়েছে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানতে পারলাম ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনের এই পরিকল্পনা ছিল ১৬০০ থেকে ২০২১সাল পযর্ন্ত। মূলত রোমের মানুষ লন্ডন শহর নির্মাণ করেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ধনী লোক লন্ডন সিটিতে বাস করে। তারপর নিউইয়র্ক শহরে। লন্ডনের অর্থনীতির আয়তন প্রায় ৬৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। লন্ডনের অর্থনীতি বিশ্বের ৫ম বৃহত্তম মহানগর অর্থনীতি। লন্ডনে বিশ্বের একশতকেরও বেশি বহুজাতিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর অবস্থিত। এর মধ্যে জন্মসূত্রে মিসরের অাদিবাসী বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী ডডি ফয়েড (Mohammed Al Fayed)-সহ আরও একাধিক বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী আছে। লন্ডন একটি ফ্যাশনাবল শহর। লন্ডনে ১৯শ শতকে আইরীয়, চীনা ও ইহুদি এবং ২০ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতীয় উপমহাদেশীয়, ক্যারিবীয় কৃষাঙ্গ ও পূর্ব আফ্রিকান কৃষাঙ্গ অভিবাসীদের আগমনের সুবাদে লন্ডন বতর্মানে একটি বহুজাতিক, বহুভাষিক ও বহু সাংস্কৃতিক বিশ্ব নগরীতে পরিণত হয়েছে।
২০০০ বছর আগে লন্ডন রোমানের অধীনে ছিল। ১৭শ শতক থেকে আজ পযর্ন্ত লন্ডন ইউরোপের বৃহত্তম শহর। ১৯শ শতকে এটি বিশ্বের বৃহত্তম ও সবচেয়ে প্রভাবশালী নগরী ছিল। সে সময় শহরটি সর্ববৃহৎ ও সমৃদ্ধিশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। জনসংখ্যার বিচারে তারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় শহরগুলোর একটি নয়, তা সত্ত্বেও এটি বিশ্বের প্রধানতম আর্থ-বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক রাজধানীর শহরগুলোর একটি হিসেবে পরিগণিত হয়। পাশ্চাত্য ইতিহাসে রোমের পতনকে প্রাচীন যুগের শেষ ও মধ্যযুগের সূচনা হিসেবে ধরা হয় এবং সেসময় থেকেই ধীরে ধীরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যর উত্তান পর্ব শুরু হয়। বর্তমান লন্ডনের ভৌগোলিক এরিয়া ১৫৭২ বর্গ কিলোমিটার। মোট জনসংখ্যা ৯০,০৬,৩৫২। জিডিপি (পিপিপি) ৫,৬৫,০০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার (Ref : London 2000 years of history part)।
লন্ডনের মুল (Central) সিটিতে ৩৭টি আর্কষণীয় টুরিস্ট স্পট আছে। যা দেখার জন্য ছুটির দিনে ইউরোপ ইউনিয়নসহ সারা বিশ্ব থেকে ভ্রমণপিপাসু মানুষদের উপচেপরা ঢেউ দেখা যায় লন্ডন সিটিতে। মূলত ব্রিটেন সরকার লন্ডন সিটিকে আকর্ষণীয় টুরিস্ট ও বাণিজ্যিক শহর হিসেবে গড়ে তুলেছে। প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করছে পর্যটন খাত থেকে। আবারও বলছি- লন্ডনের প্রতিটি গ্রামই ভিলেজ টাউন। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আমার জামাতা পরিবার নিয়ে যে এলাকায় থাকে সেটাও ভিলেজ টাউন। লন্ডনের এই ভিলেজ টাউন ‘গ্রেস’ শহরে শিশুদের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে আকর্ষণীয় বিনোদন কেন্দ্র যার নাম- ‘The magic forest for play & fun।‘ তাই বলতে হয় ভিলেজ টাউন সিটির মতোই সাজানো গোছানো।
লন্ডন খুব বড় শহর নয়। কিন্ত সাজানো গুছানো এবং নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল দেশটিকে সুশৃঙ্খল করেছে। আমরা যেমন ৫২ বছর ধরে বাংলাদেশটাকে সুশৃঙ্খল না করে শুধু অনিয়মের জন্ম দিয়েছি। তেমনি আমরা নিজেরাও জন্ম থেকে জ্বলছি। লন্ডনের চতুরদিকে প্রতিটি ভিলেজ টাউন শান্ত নিরিবিলি গ্রামীণ পরিবেশে গড়ে উঠেছে। সব ভিলেজ টাউনে ট্রেন ও বাস স্টেসন আছে যাতে কর্মজীবী মানুষ সেন্ট্রাল লন্ডনে কর্মস্থলে গিয়ে কাজ শেষে স্বল্প সময়ে বাসায় ফিরে আসতে পারে। সেজন্য ব্রিটেন সরকার যাতায়াত ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন/সংস্কার করেছে। অবাক হলাম দেখে অধিকাংশ রেলস্টেসনের নামে ভিলেজ টাউনের নাম রাখা হয়েছে। এত সুন্দর সুখকর উপভোগের মনোমুগ্ধকর ব্যবস্থা দেখে জনগনের মনের দুঃখ কষ্ট নিমিষেই লাঘব হয়ে যায়। এর পাশাপাশি নান্দনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা যার কাটামোগত বৈশিষ্ট্য ছিল ইউনাইটেড কিংডমের (ইউকে) প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এক কথায় বলা যায় একেবারে নিখুঁত। যার মধ্যে কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ভিলেজ টাউন উদাহরণস্বরূপ হোয়াইট চ্যাপেল ( White chapel) ব্রিক লেইন (Brik Lane) এবং আপটন পার্ক (Upton park) বাঙালি পাড়ায় বসবাসকারী সিলেটের লোকজনই বলেছে লন্ডন যাওয়া আসা সব মিলিয়ে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা সময় লাগে। আমার জামাতার সাথে একাধিক বার আমি ভিলেজ টাউন ‘গ্রেস’ (Grays) রেলস্টেশন থেকে সেন্ট্রাল লন্ডনে যাওয়া আসা করেছি। যাওয়া আসা তিন ঘণ্টার চেয়ে কম সময় লেগেছে। সময় কম লাগার প্রধান ২টি কারণ- প্রথম কারণ হলো ব্রিটেনে ঘড়ির কাঁটার মতো গাড়ি ও বাস চলাচল করে। এক সেকেন্ড এদিক সেদিক হতে আমি দেখিনি। দ্বিতীয় কারণ ডিসেন্ট্রেলাইজেসন (Decentralization)। সব ভিলেজ টাউনে স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, খেলার মাঠ, কাউন্সিল অফিস এবং প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক দপ্তর আছে। ব্রিটেনের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ যেমন অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, লন্ডন ইম্পেরিয়াল কলেজ সবগুলোই সেন্ট্রাল লন্ডনের বাইরে স্থাপন করা হয়েছে। রাজধানী জনসংখ্যার চাপমুক্ত রাখার জন্য অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এবং অত্যন্ত শক্তিশালী করেছে ব্রিটিশ সরকার। রাস্তায় কোনো পুলিশ চোখে পড়েনি। শুনেছি পুলিশ এদেশের মানুষের প্রকৃত বন্ধু।
মানুষ যখন বিপদে পড়ে পুলিশ নিজেই অতি দ্রুত ঘটনাস্থলে চলে আসে। কারণ পুরো ব্রিটেন রাষ্ট্র সিসিটিভি মনিটরিং এর আওতাধীন। এ কারণে দেশটিতে অপরাধ কম। জানতে পেরেছি ইংল্যান্ডে চিকিৎসাব্যবস্থা সর্বত্র উন্নতমানের এবং মানসম্মত। আমাদের দেশে সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসাব্যবস্থা একই মানসম্মত নয়। আমাদের দেশে প্রাইভেট বড় হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা ব্যয় বেশি। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয় কম হলেও সেখানে চিকিৎসা ব্যবস্থা নিম্নমানের এবং রোগীরা হন নানা হয়রানির স্বীকার। ব্রিটেনের নাগরিকদের চিকিৎসা ফ্রি অর্থাৎ টাকা লাগে না। এদেশে চিকিৎসাব্যবস্থা দেখার জন্য একদিন মেয়ের সাথে কমিউনিটি হাসপাতালে গিয়েছিলাম। কিছুদিন ধরে তার পায়ে ব্যথা ছিল। এ দেশে ডাক্তারের সাথে আগেই যোগাযোগ করে সময় নির্ধারণ করে নিতে হয়।
কমিউনিটি হাসপাতাল হিসেবে ভেবেছিলাম হাসপাতালটি বেশি বড় হবে না। কিন্তু ছোট নয়। অবাক হলাম দেখে আমার মেয়েসহ রোগী মাত্র তিনজন। বুঝতে পারলাম এদেশে রোগ ব্যাধি খুব কম হয়। লন্ডনে যত্রতত্র কোনো ডায়গোনেস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট ক্লিনিক এবং হাসপাতাল গড়ে ওঠার সুযোগ নাই। এদেশে কোনো ভিক্ষুক নেই। সাহেবি ড্রেসে ভদ্রতা বজায় রেখে কিছু ধর্মপ্রচারক দেখেছি সেন্ট্রাল লন্ডনে। সেন্ট্রাল লন্ডনে একজন মুসলিমকে ইংলিশভার্সনে বিনামূল্যে কোরআন বিতরণ করতে দেখেছি। বুঝতে পারলাম এ দেশে শান্তিপূর্ণ ধর্ম প্রচারে বাধা নেই। জানতে পেরেছি এ দেশে গড় আয়ু ৯০-৯৫ বছর। আমি নিজেই দেখেছি ৮৮ বছর বয়সী একজন মানুষ সেন্ট্রাল লন্ডনে বিশাল একটি শপিংমলে কাজ করছে। দীর্ঘ আয়ুর কারণ হলো আবহাওয়া, পরিবেশ এবং ঘরে ও বাইরে খাবারদাবার পুরোপুরি স্বাস্থ্যসম্মত ও হাইজেনিক (Hyzenic)। ঘুরতে বের হলে আমরা প্রায় সময়ই হালাল রেস্টুরেন্টে খেতাম। কোনো দিনই পেটে সমস্যা হয়নি। মনে হলো ‘খাদ্যে ভেজাল’ এদেশে অচেনা দুটি শব্দ। এ দেশে ঘরে বসেই সব ধরনের বিল পেমেন্ট করা যায়। আরো অবাক হলাম দেখে, ঘরে প্রবেশ করলে প্রতিটি তলায় ধাপে ধাপে আলো জ্বলে ওঠে। ওঠা শেষ হলে আলো আবার নিভে যায়। কিন্তু সুইচ নেই। যে কয় দিন ইংল্যান্ডে ছিলাম একদিনও বিদ্যুৎয়ের লোডশেডিং দেখিনি। মোট কথা বতর্মান বিশ্বে লেটেস্ট প্রযুক্তিবিষয়ক আইনশৃঙ্খলা সর্বস্তরে প্রয়োগ দেখলাম লন্ডনে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র ভিলেজ টাউনের ছোট বড় শপিংমলে পাওয়া যায়। বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানি যেমন মরিশনস (Morrison : Est.1899), টেসকো (Tesco) আলদি, কসটকো এবং আইকিয়া ( Aldi, Costco, Ikea) চতুরমুখী সাইজ দেড় কিলোমিটার। গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য রয়েছে বিশাল চত্বর, কোনো আনডার গ্রাউন্ড নেই। বড় বড় শপিংমলগুলোর অধিকাংশ এক তলা। এ ছাড়া লন্ডনে প্রায় এলাকাই ছোটখাটো লেক আছে। এ কারণে বিশাল আকারে লেক সাইড শপিংমল ভিলেজ টাউনে গড়ে উঠেছে। শপিংমলে ইংরেজিতে লেখা ‘World Foods Available here’। এসব দোকানে একটি পরিবারের নিত্যপ্রয়োজনীয় সবধরনের পণ্যসামগ্রী ন্যায্যমূল্যে পাওয়া যায়। পবিত্র রমজান মাসে ব্রিটেনে খাদ্যপণ্যের দাম কমিয়ে দেওয়া হয়। এ দেশে ফুটপাতে কেনাকাটার দৃশ্য চোখে পড়েনি। তবে সাদাদের (ব্রিটিশ) এলাকা বাঙালি এবং এশিয়ানদের এলাকার চেয়ে পরিষ্কার পরিছন্ন বেশি। আমাদের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যর উত্তরণ ঘটেনি। বিষয়টি অনুধাবন করতে অসুবিধা হয় না যখন বাঙালি এলাকায় ঘুরতে যাই ।
আমি যেখানে ছিলাম (Grays) সেখানে আন্তর্জাতিকমানের একটি বড় শপিংমলের নাম মরিশন (Morrison, Est.1899)। কয়েকবার গিয়ে দেখলাম। পণ্যসামগ্রীর দাম যা ছিল তাই আছে। এ দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দাম আমাদের দেশের মতো বাড়েনা। কমতে দেখেছি। ব্রিটেনে আয় ও ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য আছে। খাদ্য পণ্য নষ্ট হলে বা পচন ধরলে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তা ফেলে দেওয়া হয়। এমন একটি নিয়মতান্ত্রিক সুখকর বাজার ব্যবস্থা আমাদের দেশে কবে হবে সেটাই ভাবনার বিষয়।
একটি স্থিতিশীল বাজার ব্যবস্থা দীর্ঘ ৫২ বছরে বাস্তবায়িত হয়নি। আয় এবং ব্যয়ের সামঞ্জস্যকেই বলা হয় স্থিতিশীল বাজার ব্যবস্থা। আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে একটি ভারসাম্য অবশ্যই থাকতে হবে। পৃথিবীর উন্নয়নশীল এবং উন্নত রাষ্ট্রে আয় ব্যয়ের এই ভারসাম্যটা আছে, এটা বাংলাদেশে নেই। এই সিস্টেম আমি কানাডা, ইংল্যান্ড, সিঙ্গাপুর এবং থাইল্যান্ডে দেখেছি। বাংলাদেশে ধনীরা ট্যাক্স ফাঁকি দেয়। ব্রিটেনে ধনী, মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষ সবাই ট্যাক্স দেয়। ব্রিটেনে ট্যাক্স ফাকি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অর্থ লোপাট করারও সুযোগ নাই। রাষ্ট্রের কাছে সব ব্যাপারই জবাব দিহি করতে হয়। এসব কারনে ইংল্যান্ডের অর্থনীতিকে আমার কাছে সময়োপযোগী স্মার্ট অর্থনীতি হিসেবে মনে হয়েছে।
কানাডা এবং ব্রিটেনে দুই / তিন তলার উপরে বাড়ি নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়না। ইংল্যান্ডে প্রতিটি শহরে প্রতিদিন রাস্তা, বাসাবাড়ি এবং পার্ক পরিষ্কার করা হয়। বাংলাদেশে সেটা হয় না। এজন্য সড়কে ময়লার স্তূপ ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। এর ফলে গণহারে পেঠের পীড়া, শ্বাষ কষ্ট এবং ডেঙ্গুর মতো দুরারোগ্য ব্যাধি বাড়ছে। ইংল্যান্ডে প্রতিটি কমিউনিটিতে রয়েছে একাধিক পার্ক যা সবুজে ঘেরা নানা রংবেরঙের ফুল দ্বাড়া সুসজ্জিত। আমি নিজেই একটি পার্কে ৬/৭ রংয়ের গোলাপ ফুল দেখেছি। এরকম তরতাজা ফুটন্ত ফুল দেখলে খারাপ মনটা আর খারাপ থাকতে পারে না। এ দেশের মানুষ ফল আর ফুলের সাহচর্যে থাকতে পছন্দ করে এবং দেশটাকে তারা সেভাবেই গড়ে তুলেছে। কেউ ফল আর ফুল ছিঁড়ছে না। তারা জানে ছিঁড়ে ফেললে তো আর আনন্দ উপভোগ করা যাবে না। পার্কগুলো অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। শিশুদের বিনোদনের জন্য সবধরনের খেলাধুলার সুব্যবস্থা আছে। মনোরম সাজে সজ্জিত শিশু পার্কগুলোতে শিশুদের প্রশিক্ষণের আছে উচ্চতর প্রশিক্ষক। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের স্বাস্থ্যবিষয়ক বিনোদনের জন্য আছে খেলার মাঠ ও ব্যায়ামগার। শিশু বয়স থেকে জাতি গঠনের এত সিস্টেমেটিক একাধিক ব্যবস্থা উন্নত বিশ্ব ছাড়া আর কোথায় আছে বলে মনে হয় না। বলতে লজ্জা লাগে দীর্ঘ বছরের পুঞ্জীভূত নানা অনিয়মের কারণে ঢাকা মহানগরী আজ বিশ্বের দূষিত এবং অস্বাস্থ্যকর নগরীতে পরিণত হয়েছে। আমার কাছে মনে হয়, আমাদের আত্মা দূষণে আক্রান্ত বলে দেশটা দূষণমুক্ত হতে পারছে না।
ঢাকা শহরে এক জনের একাধিক গাড়ি, যা লন্ডন ও কানাডায় খুব কম সংখ্যক মানুষের আছে। গোটা বিশ্বও বলছে বাংলাদেশে একজনের একাধিক গাড়ি যানজটের মূল কারণ। দেখুন- যানজট কীভাবে সময় নষ্ট করে। হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে মেয়ের বাসা লন্ডনের Grays শহরের দূরত্ব ৬১ মাইল। যেতে সময় লেগেছে মাত্র ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট। বাংলাদেশ হলে তিন ঘণ্টা সময় লাগত। অতিরিক্ত দুই ঘণ্টা সময় যানজটে যে ক্ষতি হলো, এসময় অনেক কাজ করা সম্ভব হতো। এভাবে আমরা প্রতিদিন শত শত কর্ম ঘণ্টা নষ্ট করছি। শত শত কর্ম ঘণ্টাকে অর্থনীতির হিসেবে অঙ্ক কষলে প্রতিদিন কয়েক হাজার কোটি টাকা দাঁড়াবে। এই পুরো টাকাটাই রাষ্ট্রীয় অপচয়। আমরা সময়ের মূল্য দেই না বলেই উন্নত বিশ্ব থেকে বহু পিছিয়ে আছি। ভাবছিলাম কবে আমার প্রিয় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা সিটির প্রতিটি এলাকা সবুজে আবৃত সাজানো গোছানো যানজটমুক্ত ভিলেজ টাউন হিসেবে গড়ে উঠবে।
পরনিন্দা করা, হিংসা বিদ্বেষ, সুদ ঘুস, মানুষের ওপর অমানবিক জুলুমবাজ, দখলদারিত্ব, অবৈধভাবে মূল্যবৃদ্ধি , সিন্ডিকেট ব্যবসা, লুটপাট, মানুষের অধিকার হরণ, খুন রাহাজানি, প্রকাশ্যে অশ্লীললতা, ধর্মীয় বিরোধ, কথিত হিজড়াদের রাস্তাঘাটে, বাসে, রিকশায় দৃষ্টিকটু উৎপাত- এ সমস্ত কাজ সংখ্যাগরিষ্ঠ খ্রিস্টান দেশ ইংল্যান্ডে দেখিনি ও শুনিনি। ইউকের বাসিন্দাদের একটি অভ্যাস প্রসংশনীয়-অপরিচিত কাউকে দেখলে তারা মুচকি হেসে বলে Hai, Thank you। আবার অনিচ্ছাকৃত ভুল হয়ে গেলে বলে- Sorry। এ দেশে পোশাকের স্বাধীনতা আছে। হিজাব নিষিদ্ধ নয়। বহু হিজাব পরিহিত মুসলিম মহিলা দেখেছি। ব্রিটেনে ইসলাম দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্ম।
গ্রেট ব্রিটেন সবকিছুই সরকারের নিয়ন্ত্রণে। প্রাইভেট বলতে এখানে কিছুই নেই। যার ফলে সাধারণ মানুষই উপকৃত হচ্ছে বেশি। নাগরিকদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বাসস্থান, বেকার ভাতা, বয়স্ক ভাতা, অবসর ভাতা, বাসস্থান সবকিছুই সরকার বহন করে। ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী সবার টাকা ইংল্যান্ড রেভিনিউতে জমা হয়। ট্যাক্সের টাকা কেটে তারপর কর্মজীবী মানুষদের বেতন তাদের একাউন্টে জমা দেওয়া হয়। সত্যবাদিতা, নিষ্ঠা ও দেশপ্রেম তাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছে বলে আমি মনে করি।
হারুন-আর-রশিদ : লেখক ও সাংবাদিক
মন্তব্য করুন