স্টিফেন ব্রায়েন
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭:০৫ পিএম
আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:২৫ এএম
অনলাইন সংস্করণ
এশিয়া টাইমস থেকে

ইউক্রেনের সরকার পতন হতে যাচ্ছে!

ইউক্রেনের সরকার পতন হতে যাচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেনের সরকার পতন হতে যাচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

ওয়াশিংটন এবং এর মিত্ররা আশা করেছিল তারা ক্রেমলিন থেকে পুতিনকে সরিয়ে দিতে পারবে। সরকার পরিবর্তনের সেই সম্ভাবনা এখন আরও স্পষ্ট হয়েছে তবে তা রাশিয়ায় নয় বরং কিয়েভে। ইউক্রেনের উত্তরাঞ্চলের শহর আভদিভকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে রুশ সৈন্যরা। আভদিভকার নিয়ন্ত্রণ হারানো কিয়েভের জন্য একটি বড় পরাজয়। সমগ্র পূর্ব ইউক্রেন এখন রাশিয়ার সামনে অনেকটা উন্মুক্ত। রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা বা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া, যে কোনো সিদ্ধান্তের আগেই কিয়েভে সরকার পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে তা স্পষ্ট।

আভদিভকা শহরের খুব কাছাকাছি ডনবাস অঞ্চলের রাজধানী এলাকা। দোনেৎস্কের প্রবেশদ্বারও বলা যায় শহরটিকে। ডোনেটস্ক এবং লুহানস্ক উভয়ই পূর্ব ইউক্রেনের অঞ্চল এবং এখানে বেশিরভাগ রাশিয়ান-ভাষী জনসংখ্যার বসবাস। স্থানীয় বাসিন্দারা রাশিয়ার সঙ্গেই থাকতে পছন্দ করে। ফলে এই সমগ্র অঞ্চলটিতে এখন রাশিয়ার একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলো।

আভদিভকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য চার মাস আগে হামলা শুরু করে রাশিয়া। জানুয়ারি থেকে পিছু হটতে শুরু করে ইউক্রেন সেনারা। শহরে অবস্থিত কোক প্ল্যান্টের দখল নিতে মরিয়া হয়ে উঠে রুশ কমান্ড। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে রুশ সৈন্যরা শহরটির দুই দিক থেকে ব্যাপক গোলা নিক্ষেপ করতে শুরু করে। রাশিয়া যখন শহরটির নিয়ন্ত্রণ নেয় তখন শহরটি প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।

আভদিভকা শহরটি অত্যন্ত সুরক্ষিত করে রেখেছিল ইউক্রেন এবং রাশিয়ান সেনাবাহিনীর জন্য এটি ছিল একটি কঠিন লক্ষ্য। রুশ সেনারা শহরটিকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং অস্ত্র ও খাদ্যের সরবরাহ পথ বন্ধ করে দেয়। রাশিয়ার এই কৌশল কার্যকর হয় এবং চতুর্মুখী আক্রমণে এক সময় শহরে অবস্থান করা ইউক্রেন সৈন্যদের মনোবল ভেঙে পড়ে। এক পর্যায়ে সৈন্যদেরকে শহর থেকে বের করে নেয় কিয়েভ।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির জন্য এই শহরটির ছিল একটি চ্যালেঞ্জ। পূর্বাঞ্চলের যুদ্ধে কিয়েভ টিকে থাকতে পারবে কিনা তা এই শহরটির ওপর নির্ভর করছিল। ফলে যে কোনো মূল্যে জেলেনস্কি শহরটির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। অবদিভকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট না হয়ে জেলেনস্কি তার সেনাপ্রধান জেনারেল ভ্যালেরি জালুঝনিকে বরখাস্ত করেছিলেন। পরিবর্তে তিনি দায়িত্ব দেন জেনারেল সিরস্কি-কে। সিরস্কির যুদ্ধ কৌশলে এর আগে বাখমুতের পতন ঘটেছিল এবং সেখানে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে।

জেনারেল ভ্যালেরি জালুঝনি চেয়েছিলেন ইউক্রেনীয় বাহিনীকে এখনকার অবস্থান থেকে পিছিয়ে এনে সুরক্ষিত জায়গাগুলোতে শক্তি বৃদ্ধি করতে। যাতে কিয়েভ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলিকে রক্ষা করা যায়। কিন্তু জেলেনস্কি আভদিভকা রক্ষায় সেখানে আরও সৈন্য প্রেরণ করেন। আভদিভকা রুশ সৈন্যরা দখল করে নিয়েছে এবং ইউক্রেন বাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

আভদিভকা রাশিয়ার দখলে চলে যাওয়া শুধু ইউক্রেনের জন্যই নয়; পশ্চিমা দাতাদের জন্যও হতাশার। অস্ত্র সরবরাহ আর সৈন্য নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে ইউক্রন সেনাদের মনে। ভবিষ্যতে কিয়েভকে সহায়তা করা নিয়ে দেখা দিতে পারে অনিশ্চয়তা।

মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সে যাওয়ার জন্য অভিবাদন গ্রহণ করেছিলেন জেলেনস্কি। ইউক্রেনীয়রা আশা করেছিল কনফারেন্স থেকে তারা বড় ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস পাবেন। কিয়েভ ত্যাগ করার আগে জেলেনস্কি জেনারেল সিরস্কিকে নির্দেশ দিয়ে যান যাতে যে কোনো মূল্যে আভদিভকা শহরকে রক্ষা করা হয়।

শহর রক্ষায় ইউক্রেন সামরিক বাহিনীর ৩নং ব্রিগেডকে পাঠান জেনারেল সিরস্কি। প্রকৃতপক্ষে আজভ ব্রিগেডকে নতুন করে সাজিয়ে গঠিত হয়েছে এই ৩নং ব্রিগেড। এই ব্রিগেড ইউক্রেনে জেলেনস্কির অতি-জাতীয়তাবাদী সমর্থনের মেরুদণ্ড। আর জেলেনস্কির রাজনৈতিক ক্ষমতা নির্ভর করে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী এবং বিশেষ করে অতি-জাতীয়তাবাদীদের ওপর।

রুশ বাহিনীর সঙ্গে যদি ইউক্রেনের কোনো সৈন্যদল সমানে সমানে লড়াই করতে পারে তবে সেটি ৩নং ব্রিগেড অর্থাৎ আজভ ব্রিগেড। আজভ ব্রিগেডের সৈন্যরা যখন উত্তর দিক থেকে আভিদিভকায় প্রবেশ করে তখন তারা শহরের পরিস্থিতি ভয়ানক দেখতে পায়। সে সময় শহরের উত্তরাঞ্চলে প্রায় ৪৫০০ ইউক্রেনীয় সৈন্য অবস্থান করছিল এবং তাদের বেশিরভাগই কোক প্ল্যান্টে আটকা পড়ে ছিল। ৩৫০০ ইউক্রেনীয় সৈন্য শহরের কেন্দ্র এবং অন্যান্য জায়গায় বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল।

এসব সৈন্যরা আজভ ব্রিগেডের আদেশ অমান্য করে এবং সিরস্কি ও জেলেনস্কির সুস্পষ্ট আদেশকে পিঠ দেখিয়ে শহরের বাইরে পালিয়ে যায়। মিউনিখ সম্মেলনে থাকার সময় কোনোভাবেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে চাননি জেলেনস্কি। তিনি আরও আর্থিক সাহায্য ও গোলাবারুদ পাওয়ার চেষ্টা করছেন।

আজভ ব্রিগেডের বেশকিছু সৈন্য রুশ সেনাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ফলে জেনারেল সিরস্কি ভীত হয়ে পড়েন এবং আভদিভকা শহর ছেড়ে দিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হন। সেই পিছু হটাই ছিল জেলেনস্কির প্রতিপত্তির জন্য একটি বিরাট ধাক্কা। আভদিভকা শহরের নিয়ন্ত্রণ হারানো এবং আজভ ব্রিগেডের পিছু হটা জেলেনস্কির সরকারের জন্য পদত্যাগ ছাড়া আর কোনো বিকল্প রাখেনি। জেলেনস্কি সেনাবাহিনীতে তার সবচেয়ে উৎসাহী সমর্থকদেরকে হারিয়েছেন। এখন মার্কিন এবং ইউরোপীয় মিত্ররাও হয়তো কিয়েভকে সহায়তা করা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগবে।

ওয়াশিংটন কোনোভাবেই চায়না ইউক্রেন রাশিয়ার সঙ্গে কোনো চুক্তিতে যাক। ওয়াশিংটন এবং এর মিত্ররা আশা করেছিল তারা ক্রেমলিন থেকে পুতিনকে সরিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু বাইডেনের সেই প্রচেষ্টা সফল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাশিয়ান অর্থনীতিকে ভেঙে দেওয়ার যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল তাও স্পষ্টত ব্যর্থ হয়েছে। মার্কিন প্রযুক্তি বা পশ্চিমা সাহায্যও ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়নি। সবমিলে এই যুদ্ধ ইউক্রেনের জন্য পরাজয় ছাড়া আর কিছু বয়ে আনেনি।

রাশিয়ার সঙ্গে কথা না বলে ন্যাটোতে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত ইউক্রেনের জন্য ছিল মস্ত বড় ভুল। আর এই ভুলের খেসারত হল ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা। ন্যাটো সম্প্রসারণ নিয়ে বছরের পর বছর ধরে ইউক্রেনকে মিথ্যা বলা হয়েছিল। এখন সকলেই চাচ্ছে এই যুদ্ধ বন্ধ হোক। যুদ্ধ বন্ধ হলেও ইউক্রেনজুড়ে যে ধ্বংসযজ্ঞ ঘটেছে তার দায় কে নেবে? ইউক্রেন পুনর্গঠনে যে শত শত বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে সেই অর্থ কে দেবে?

যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে জেলেনস্কির শাসন এখন বিপর্যস্ত। জেলেনস্কির সামরিক আইন বলবৎ থাকার কারণে কোনো নির্বাচন হবে না। কোনো উন্মুক্ত রাজনৈতিক প্রক্রিয়াও হবে না। কিন্তু সেনাবাহিনীতে ক্ষোভ বাড়ছে এবং শীঘ্রই বা কয়েক সপ্তাহ পরে সামরিক বাহিনী অন্য কোনো একজন নেতাকে বেছে নেবে। কিয়েভের শাসন পরিবর্তন হতে যাচ্ছে এবং তা খুব শীঘ্রই।

স্টিফেন ব্রায়েন: প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ। ভাষান্তর: মুজাহিদুল ইসলাম

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সাতক্ষীরা-৪ আসনে কালীগঞ্জ ও শ্যামনগর রাখার দাবিতে বিএনপির স্মারকলিপি

জকসুর দাবিতে জবিতে শিক্ষার্থীদের অবস্থান কর্মসূচি

স্ত্রীকে নোরা ফাতেহির মতো বানাতে না খাইয়ে রেখে ব্যায়াম করান স্বামী

‘ভুল’ আংটি দিয়ে প্রেমিকাকে ‘প্রপোজ’ করেন রোনালদো!

ঢাকা ও সিটি কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ফের সংঘর্ষ, স্থায়ী সমাধান চান রমনার ডিসি

বসুন্ধরা শপিংমলে ক্লাব হাউসের ফেস্টিভ কালেকশন উন্মোচন

কালো তালিকাভুক্ত হলেন ৭১ শিক্ষক

দায়িত্ব নিয়েই হুঁশিয়ারি দিলেন সারোয়ার আলম

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আইআরআইর প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক

পাকিস্তানের সঙ্গে ভিসা অব্যাহতি চুক্তি অনুমোদন

১০

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ইসির রোডম্যাপ এ সপ্তাহে আর ঘোষণা হচ্ছে না

১১

ভরা মৌসুমেও ইলিশ নেই, হতাশ জেলেরা

১২

গাজীপুরে শ্রমিকদের বিক্ষোভ, মহাসড়ক অবরোধ

১৩

জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করলেন তামিম

১৪

পেছনের পকেটে মানিব্যাগ রাখেন? অজান্তেই ডেকে আনছেন যে অসুখ

১৫

দিনাজপুরে পরিবেশবান্ধব উদ্ভাবন নিয়ে কর্মশালা

১৬

মাকে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে ধরা পড়লেন চীনা গুপ্তচর

১৭

নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত ও ৬ বিভাগে ভারী বৃষ্টির শঙ্কা

১৮

সাদাপাথর লুট, এবার তদন্তে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ

১৯

মালয়েশিয়া যাচ্ছেন নাহিদ ইসলাম

২০
X