ওয়াগনারপ্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের অধ্যায় সম্ভবত শেষ হয়েছে। তবে দেখানো এই ঐক্য সত্ত্বেও, প্রিগোজিনের প্রকাশ্য বিদ্রোহে রাশিয়ান নেতৃত্বের মধ্যে দেখা গভীর দুর্বলতা চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং হয়ত ভুলবেন না। যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ এবং রাশিয়ার ক্ষয়ক্ষতি বাড়তে থাকায়, পুতিনের সঙ্গে শি জিনপিংয়ের ‘সীমাহীন’ অংশীদারিত্ব দ্রুত চীনের জন্য সামরিক দায়বদ্ধতায় পরিণত হচ্ছে।
অবশ্য, চীন জোর দিয়ে বলেছে, ওয়াগনারের বিদ্রোহ ক্রেমলিনের সঙ্গে চীনের সহযোগিতার সম্পর্ককে কোন ধরনের হুমকিতে ফেলেনি। প্রিগোজিন মস্কোতে তার পদযাত্রা থামানোর কয়েক ঘণ্টা পরই চীনের কমিউনিস্ট পার্টি একটি বিবৃতি জারি করে। সেখানে তারা এই বিদ্রোহকে রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে ইস্যুটিকে খারিজ করে দেয়।
চীনের অভ্যন্তরে, প্রিগোজিনের বিদ্রোহের খবর ছিল বিরল। কারণ সরকার চীনা সোশ্যাল মিডিয়াকে সেন্সরের মধ্যে রেখেছে যাতে পুতিন বিরোধী কোনো কথা সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে না পড়ে। চীনের রাষ্ট্রীয় মিডিয়া রাশিয়ার প্রতি চীন সরকারের সমর্থনকে যথাযথভাবে প্রকাশ করেছে এবং পশ্চিমা প্রতিক্রিয়াকে অতিরঞ্জিত হিসেবে বর্ণনা করেছে। একই সঙ্গে তারা পুতিনের অবস্থানকে নিরাপদ বলে ঘোষণা করেছে।
রাশিয়ার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক এবং পুতিনের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়ে কতবার ঢাক পিটিয়েছেন শি জিনপিং তা বিবেচনা করে চীনা প্রেসিডেন্ট এই মুখোশ বজায় রাখবেন তা বোধগম্য।
গত এক দশকে প্রায় ৪০ বার সাক্ষাৎ করেছেন দুই নেতা। বারবার তারা একতা এবং পশ্চিমা বিরোধী একটি দ্বিতীয় বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন। মার্চ মাসে শি জিনপিংয়ের মস্কো সফরের সময় চীনা প্রেসিডেন্ট তাদের ‘সীমাহীন’ অংশীদারিত্ব এবং হ্যান্ডশেকের ছবি প্রকাশ করেছিলেন। তার পরই পুতিন ইউক্রেনে তার আক্রমণ শুরু করেছিলেন।
চীন যে বহুমুখী বিশ্ব দাবি করে সেখানে মূল চাবিকাঠি রয়েছে রাশিয়ার হাতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদেরকে সীমাবদ্ধ করতে চীন রাশিয়ার একত্রে চলার বিকল্প নেই।
গত মার্চ মাসে শি জিনপিং এবং পুতিন যে ‘বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদারিত্ব’ ঘোষণা করেছিলেন সেখানে ‘ডি-ডলারাইজেশন’ থেকে শুরু করে ইরান, সিরিয়া এবং আফ্রিকাতেও চীন-রাশিয়া সমান্তরাল নীতি অনুসরণ করার বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেই অংশীদারিত্বে চীনের বিনিয়োগ এবং ক্রমবর্ধমান প্রোফাইল রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান সামরিক ও রাজনৈতিক উপস্থিতির পরিপূরক।
ইউক্রেনে রাশিয়ান আগ্রাসনের পরিণতি সত্ত্বেও, শি জিনপিং জোর দিয়ে বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক দৃশ্যপট যেভাবেই পরিবর্তিত হোক না কেন- কোনো ঘটনায়ই রাশিয়ার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ও কৌশলের পরিবর্তন হবে না।
শি জিনপিংও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার বিষয়ে সদা সচেতন। চীনের অর্থনীতি ইতোমধ্যেই তীব্র মাথাব্যথার সম্মুখীন। সংকট উত্তরণে রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রয়োজন। ক্রম হ্রাসমান শিল্প উৎপাদন এবং দুর্বল ভোক্তা চাহিদা কোভিড-পরবর্তী চীনের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারকে বাধাগ্রস্ত করছে।
যদিও চীনের মোট বাণিজ্যের মাত্র তিন শতাংশ হয় রাশিয়ার সঙ্গে, তবে চীন এবং রাশিয়ার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২০২২ সালে ৩০% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত ইতোমধ্যেই আরও ৪১% বৃদ্ধি পেয়েছে। চীন বিশাল ছাড়ে রাশিয়ার তেল ও গ্যাস কিনছে এবং এই রপ্তানি রাশিয়াকে যুদ্ধে টিকিয়ে রাখতে এবং তার অর্থনীতিকে সচল রাখতে সাহায্য করছে।
এ ছাড়াও শি জিনপিং চীন-রাশিয়ার সামরিক সহযোগিতায় বিশাল বিনিয়োগ করেছেন। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়াকে সংযুক্ত করা এবং পরে পূর্ব ইউক্রেনে অনুপ্রবেশ চীন-রাশিয়া প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে ত্বরান্বিত করেছে। রাশিয়ান উন্নত অস্ত্র, সামরিক বিনিময়, যৌথ মহড়া এবং উচ্চ প্রযুক্তির বিমান, নৌ এবং আগাম সতর্কতা ব্যবস্থার অ্যাক্সেস থেকে এখনও উপকৃত হচ্ছে চীন।
এত সব পাওয়ার পর, চীন রাশিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্কের সঙ্গে যুক্ত ক্রমবর্ধমান অস্পষ্ট দায়কে উপেক্ষা করতে পারে না। ১৬ মাসের যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যর্থতার পর রাশিয়ান সশস্ত্র বাহিনী তাদের যুদ্ধের সক্ষমতা প্রায় অর্ধেক হারিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে, গত ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে ১ লাখেরও বেশি রাশিয়ান সৈন্য হতাহত হয়েছে।
এটা ভাবাই যায় যে, চীন সামরিক বাহিনীর জেনারেলরা এই ফলাফলগুলো দেখে হতবাক হওয়ার পাশাপাশি হতাশও। চীন সর্বশেষ কোন যুদ্ধে লড়েছে প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে, ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে। ইউক্রেনে রাশিয়ার বিজয় দেখে নিজেদের স্বপ্ন আঁকার যে আশা তারা করেছিল এখন তা প্রায় ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।
পুতিনের ব্যর্থতার পেছনের কারণগুলো শি জিনপিংকে ব্যক্তিগতভাবে কষ্ট দিতে পারে। রাশিয়ার প্রতিযোগী চেইন অফ কমান্ডের দিকে তাকালে তা চীনকে হতাশ করছে। ভবিষ্যতে পূর্ব এশিয়ার যে কোনো সংঘাতে চীনের সামরিক বাহিনী যদি রাশিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করতে চায় তাহলে কি আশা করবে চীন!
এমনকি ক্রেমলিনের অযোগ্যতা এবং বিভ্রান্তির কথা নাও ধরা হয়, মার্কিন সরকারের অর্থায়িত সেন্টার ফর নেভাল অ্যানালাইসিস উপসংহারে পৌঁছেছে যে, রাশিয়া এবং চীন একটি কার্যকর সামরিক অংশীদারিত্ব থেকে এখনও অনেক দূরে।
শি জিনপিংয়ের জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, রাশিয়ার গোলযোগপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রিগোজিনের ক্ষণিকের সেই বিদ্রোহের প্রতি রুশ সামরিক বাহিনীর ক্ষীণ প্রতিক্রিয়া রুশ সামরিক বাহিনীর আনুগত্যে প্রশ্ন তোলে। শি জিনপিং এই সমস্যার সঙ্গে অনেক আগে থেকেই পরিচিত। ২০১০-এর দশকে চীনের মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে, শি জিনপিং তার প্রতিযোগী এবং সমালোচকদের নির্মূল করার জন্য চীনা সামরিক বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। তাই ওয়াগনার গ্রুপ মস্কোর দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় রুশ সামরিক বাহিনীর নীরব ভূমিকা নিশ্চয়ই অবাক করেছে চীনা প্রেসিডেন্টকে।
নিঃসন্দেহে প্রিগোজিন এবং অন্যান্য রাশিয়ান সামরিক নেতা যেমন- প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু এবং জেনারেল স্টাফ চিফ ভ্যালেরি গেরাসিমভ... তাদের সম্পর্কে চীনের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। কিন্তু অবস্থান ও সুযোগ-সুবিধার জন্য ক্রেমলিনের আন্তঃসম্পর্কের লড়াইয়ে অনেক খেলোয়াড়ের মধ্যে এরা কয়েকজন মাত্র।
অন্যদের মধ্যে শোইগু এবং গেরাসিমভের নিজ নিজ পূর্বসূরি, আনাতোলি সার্ডিউকভ এবং নিকোলাই মাকারভে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এক দশক আগে রুশ সামরিক বাহিনীতে একটি শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল। যেখানে ৮০% কর্নেল এবং প্রায় ৭০% মেজর র্যাংঙ্কের অফিসারকে সেনাবাহিনী থেকে ছাঁটাই করা হয়। এই শুদ্ধি অভিযান নতুন অফিসারদের জন্য ভাগ্যের দরজা খুলে দিয়েছিল যারা আজকের দিনে রুশ সামরিক বাহিনীকে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
এই খেলোয়াড়রা রাশিয়ার ১১টি টাইম জোন এবং এর চেইন অফ কমান্ডজুড়ে অবস্থান করছে এবং তাদের আনুগত্য শেষ পর্যন্ত কোথায় রয়েছে তা যে কারও জন্য অনুমেয়।
একইভাবে, রাশিয়ার চেইন অফ কমান্ডের প্রশ্নবিদ্ধ অখণ্ডতা শি জিনপিংয়ের কৌশলগত ক্যালকুলাস বা বৈশ্বিক নকশায় মৌলিক পরিবর্তন আনবে কিনা তা দেখার বিষয়। প্রিগোজিনের বিদ্রোহের পর রাশিয়ান নিরাপত্তা পরিষেবাগুলো কমপক্ষে ১৩ জন সিনিয়র সামরিক অফিসারকে আটক করেছে এবং ১৫ জনকে বরখাস্ত করেছে। যা বেইজিংয়ের জন্য কেবল বিরক্তিকরই হতে পারে।
তবে এটা নিশ্চিত যে, শি জিনপিং এর উচ্চভিলাষী পরিকল্পনা পুতিনকে ছাড়া এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। হোক সেটা দুর্বল বা শক্তিশালী একজন পুতিন।
মূল : কেন্ট হ্যারিংটন (KENT HARRINGTON), সিআইএয়ের একজন সাবেক বিশ্লেষক
ভাষান্তর : মুজাহিদুল ইসলাম
মন্তব্য করুন