

বিশ্বজুড়েই শিশু-কিশোরদের জীবনের বড় অংশ দখল করে নিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। অস্ট্রেলিয়াও এর বাইরে ছিল না। পার্ক, স্কুল, রাস্তাঘাট— যেখানেই চোখ যায়, দেখা যেত কিশোরদের নিরন্তর মোবাইল স্ক্রলে ডুবে থাকা দৃশ্য। তবে ২০২৫ সালের শেষদিকে দেশটিতে আচমকাই পাল্টে যাচ্ছে এ চিত্র। সরকার ঘোষণা দিয়েছে, এখন থেকে অস্ট্রেলিয়ার ১৬ বছরের নিচে কেউ আর সোশ্যাল মিডিয়ায় অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে না।
ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, স্ন্যাপচ্যাট—যেসব প্ল্যাটফর্ম ছিল লাখ লাখ অস্ট্রেলিয়ান কিশোরের প্রতিদিনের সঙ্গী, সেগুলো হঠাৎ করেই তাদের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সী ব্যবহারকারীদের মধ্যে স্ন্যাপচ্যাটেই রয়েছে ৪ লাখ ৪০ হাজার জন। ইনস্টাগ্রামে ৩ লাখ ৫০ হাজার এবং টিকটকে আছে ২ লাখ। নতুন আইন চালু হলে মুহূর্তেই বদলে যাবে কিশোরদের ডিজিটাল মানচিত্র।
এই সিদ্ধান্ত ঘিরে বিশ্বজুড়ে চলছে তুমুল আলোচনা। কেউ বলছেন এটি সাহসী উদ্যোগ, কেউ বলছেন অযথা হস্তক্ষেপ। কেউ দেখছেন কিশোরদের জন্য নতুন সুযোগ; আবার অনেকেই সংশয় প্রকাশ করছেন, ‘এতে কি সত্যিই তারা সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়বে?’
কোন কোন অ্যাপ নিষিদ্ধ হচ্ছে?
নতুন আইনের আওতায় পড়েছে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, স্ন্যাপচ্যাট ও ইউটিউবসহ সব বড় প্ল্যাটফর্ম। তবে, শিশুরা চাইলে ইউটিউব কিডস বা হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করতে পারবে। কারণ, এগুলো মূলত মেসেজিং বা শিশুকেন্দ্রিক অ্যাপ বলে মনে করা হয়।
তবে সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা স্পষ্ট করে দিয়েছে, যদি কোনো প্ল্যাটফর্মকে তারা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে, তালিকায় নতুন নাম যে কোনো সময় যোগ করা হবে।
কেন এমন আইন?
এই আইন করার ক্ষেত্রে সামাজিক বাস্তবতা বড় ভূমিকা রেখেছে। অস্ট্রেলিয়ায় বেশ কিছু পরিবার সন্তান হারানোর বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা সবার সঙ্গে শেয়ার করেছেন। যেমন অনলাইন বুলিং, উদ্বেগ, আত্মহত্যাপ্রবণতা, এসবে সোশ্যাল মিডিয়া বড় ভূমিকা রেখেছিল বলেই তাদের ধারণা।
নীতিনির্ধারকরা বারবার বলছেন, এটি নিষেধাজ্ঞা নয়, বরং বয়সসীমা সামান্য পিছিয়ে দেওয়া। ঠিক যেমন গাড়ি চালানোর লাইসেন্সের ক্ষেত্রে দেখা যায়।
কিশোরেরা কী ভাবছে?
সংবাদমাধ্যম এবিসির বড় আকারে করা এক জরিপে দেখা গেছে, অস্ট্রেলিয়ার বেশিভাগ কিশোর এই আইনকে বিশ্বাসই করে না। তারা মনে করে, এই আইন কাজ করবে না। এটি ভালো কোনো সিদ্ধান্তও নয়। ৭৫ শতাংশ কিশোর জানিয়েছে, তারা যেভাবেই হোক সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার চালিয়ে যাবে।
আইন কার্যকর হওয়ার আগের সপ্তাহগুলোতে দেখা গেছে, টিকটক বা ইনস্টাগ্রামের বিকল্প ছবি শেয়ারিং অ্যাপ বা চ্যাট অ্যাপগুলো অস্ট্রেলিয়ার অ্যাপ স্টোরে ডাউনলোডের তালিকার শীর্ষে উঠে গেছে। এর মধ্যেই অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসে দুজন ১৫ বছর বয়সী কিশোর আইনটির বিরুদ্ধে আদালতে চ্যালেঞ্জ করেছে। তাদের যুক্তি, এই আইন তাদের মতপ্রকাশ এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অধিকার ক্ষুণ্ন করছে।
কিশোরদের বয়স কীভাবে বের করা হবে?
এই প্রশ্নটি নিয়ে অনেকের আগ্রহ আছে। টেক কোম্পানিগুলো কীভাবে জানবে কে ১৫ আর কে ১৬ বছরের? সেই দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে কোম্পানিগুলোকে। তারা অ্যাকাউন্টের ব্যবহারকারীর পুরোনো আচরণ যাচাই করবে। কখন অ্যাপ ব্যবহার করা হয়, তা-ও যাচাই করা হবে। কার সঙ্গে যোগাযোগ হয়, এমনকি কণ্ঠ কেমন, চেহারা বা ছবির বিশ্লেষণ করবে। তবে শর্ত হলো, কোনো ব্যবহারকারীর সরকারি পরিচয়পত্র চাইতে পারবে না প্ল্যাটফর্মগুলো।
অ্যাকাউন্ট ছাড়া কি সোশ্যাল মিডিয়া দেখা যাবে?
ওপেন কনটেন্ট দেখা যাবে আগের মতোই। তবে সরকারের যুক্তি হলো, অ্যাকাউন্ট না থাকলে শিশু-কিশোরেরা আসক্তি সৃষ্টি করে এমন অ্যালগরিদম, পুশ নোটিফিকেশন বা অবিরাম স্ক্রলিংয়ের ফাঁদে পড়বে না। দায়িত্বশীলদের মতে, এটাই সবচেয়ে ক্ষতিকর। এ থেকেই শিশু-কিশোরদের রক্ষা করতে চান তারা।
টেক কোম্পানিগুলো কী বলছে?
টেক জায়ান্টদের বক্তব্য হলো, আইনটি হঠাৎ করে প্রয়োগ করা হয়েছে। যথেষ্ট গবেষণা করা হয়নি। তারা বলছে, কিশোরদের নিরাপদ রাখতে যে কাস্টম ফিচারগুলো তৈরি করা হয়েছিল, সেগুলো এখন আর কোনো কাজে লাগবে না। তবু প্রায় সব প্ল্যাটফর্ম জানিয়ে দিয়েছে, তারা আইন মানবে এবং লক্ষাধিক কিশোরের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেবে।
বড় অঙ্কের জরিমানা থাকছে
কোনো কোম্পানি যদি ১৬ বছরের নিচের ব্যবহারকারীদের বাদ দিতে ব্যর্থ হয়, তবে জরিমানা হিসেবে গুনতে হতে পারে ৫০ মিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার। তবে কখন এই জরিমানা আরোপ করা হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি।
সূত্র : নিউইয়র্ক টাইমস
মন্তব্য করুন