গত ২৩ জুন বিদ্রোহ ঘোষণা করে ওয়াগনার যোদ্ধারা মস্কো অভিমুখে যাত্রা করেন। আর ঠিক ওই সময়ই রাশিয়ার ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের (এফএসবি) সদস্যরা সেন্ট পিটার্সবার্গে বাহিনীটির প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের প্রধান কার্যালয়ে ঢুকে সবকিছু তছনছ করেন।
অভিযানের সময় মুখোশ পরা ব্যক্তিরা প্রিগোজিনের প্রতিষ্ঠান প্যাট্রিয়ট গ্রুপের প্রধান কার্যালয় থেকে কম্পিউটার ও নথিপত্র জব্দ করে নিয়ে যায়। এটা প্রিগোজিনের নিয়ন্ত্রণাধীন তথ্য সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিত।
প্যাট্রিয়ট গ্রুপের অনলাইন আউটলেট রিয়া ফানের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘ওরা (নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য) সদর দরজা ভেঙে কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশ করে। মনে হচ্ছিল, এটা দেশপ্রেমিক সাংবাদিকের কর্মস্থল নয়, বরং ওরা অবৈধ কোনো পতিতালয় ধ্বংস করতে এসেছে।’
গত ২৩ জুন রাশিয়ার সামরিক নেতাদের উৎখাত করতে বিদ্রোহের ঘোষণা দেন ওয়াগনারপ্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিন। ঘোষণার পর পর দেশটির রাজধানী মস্কো অভিমুখে যাত্রাও করে ওয়াগনার বাহিনী। তবে ওইদিন রাতে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট অ্যালেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় বিদ্রোহ থেকে সরে আসেন প্রিগোজিন। এ বিদ্রোহের ফলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ২৩ বছরের শাসনামলে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন।
বিদ্রোহের পরের দিনের এই ঘটনা ‘গার্ডিয়ান’-এর কাছে বর্ণনা করেছেন প্যাট্রিয়টের বেশ কয়েকজন সদস্য। এই ঘটনা থেকে স্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে প্রিগোজিনের বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য দমন করার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছে ক্রেমলিন।
৩০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রিগোজিন বিশ্বের অন্যতম রহস্যময় ও জটিল করপোরেট কাঠামো তৈরি করেছেন। ভাড়াটে সেনা সরবরাহ থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যম, খনি, লজিস্টিক, চলচ্চিত্র, ক্যাটারিংসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছেন তিনি।
কে এই প্রিগোজিন
তার জন্ম ১৯৬১ সালে। ঘটনাচক্রে, পুতিন ও প্রিগোজিনের জন্ম একই শহরে, রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর সেন্ট পিটার্সবার্গে। প্রিগোজিন একাধিকবার সাজা খাটা আসামিও। ১৯৭৯ সালে, ১৮ বছর বয়সে চুরির অভিযোগে আড়াই বছর কারাগারে ছিলেন তিনি। জেল থেকে বের হওয়ার দুবছর পর আবারও চুরি-ডাকাতির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। এরপর ফের ১৩ বছরের জেল হয় তার।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে কারাগার থেকে বের হওয়ার পর মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবার্গে হটডগ এবং অন্যান্য ফাস্টফুড বিক্রির দোকান খোলেন প্রিগোজিন। সে সময়ে পুতিনের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। ওই সময় সদ্য ভেঙে যাওয়া সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি থেকে পুতিন রুশ প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ক্রেমলিনে বদলি হয়ে আসেন। পুতিনের সঙ্গে পরিচয়ে সূত্র ধরে তৎকালীন ক্রেমলিনের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে প্রিগোজিনের। ক্রমেই তিনি রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ক্রেমলিনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকায় বিভিন্ন লোভনীয় সরকারি ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নিতে সক্ষম হন প্রিগোজিন।
তবে পুতিনের ক্ষমতা চ্যালেঞ্জ করে এখন চক্ষুশূল হয়েছেন প্রিগোজিন। তার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের লাগাম টানতে রুশ রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
বিদ্রোহের পর প্রিগোজিনের করপোরেট সাম্রাজ্যের অর্থের উৎস তদন্ত করে দেখা হবে বলেও ইঙ্গিত দেন পুতিন। তিনি জানান, ওয়াগনারে অর্থায়ন ছাড়াও প্রিগোশিনের ক্যাটারিং কোম্পানি কনকর্ড সামরিক চুক্তির আওতায় গত এক বছরে প্রায় ২০০ কোটি ডলার পেয়েছে। কেউ চুরি করেনি বা বেশি চুরি করেনি। তবে এসব খতিয়ে দেখা হবে।
এ ছাড়া প্রিগোজিনের সংবাদমাধ্যম দমনেও নেমেছে রুশ কর্তৃপক্ষ। গত মাসের শেষ দিন রুশ নিয়ন্ত্রক সংস্থা রসকোমনাদজোর প্রিগোশিনের সংশ্লিষ্ট বেশির ভাগ মিডিয়া আউটলেট বন্ধ করে দেয়। এর পরপরই প্যাট্রিয়টের পরিচালক অবিলম্বে মিডিয়া কার্যক্রম গুটিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেন।
রিয়া ফানের মস্কোভিত্তিক প্রযোজক আন্দ্রে কারপোভ বলেন জানান, গত ৩০ জুন তাদের সবার চাকরি চলে গেছে। এই ঘটনায় তার সব সহকর্মী খুবই ক্ষুব্ধ। কারণ, হঠাৎ করে সবার চাকরি চলে গেছে। এখন কী করবে, কেউ জানে না।
আফ্রিকায় প্রিগোজিন
আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে প্রিগোজিনের বিশাল ব্যবসা রয়েছে। তাকে দমন করতে হলে এসব করপোরেট চুক্তি, ও ব্যবসায় ধস নামানো কার্যকর কৌশল হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে প্রিগোজিনের খনির ব্যবসা রয়েছে। এ ব্যবসায় করা লাভজনক চুক্তির নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে রাশিয়া।
ব্যবসার পাশাপাশি আফ্রিকা থেকে হাজার হাজার ভাড়াটে সেনা সংগ্রহ করেছে ওয়াগনার। এরপর তাদের বিভিন্ন বিরোধপূর্ণ এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে। যদিও আফ্রিকায় মোতায়েন করা ওয়াগনার যোদ্ধাদের প্রত্যাহার না করার কথা জানিয়েছেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ।
তবে আফ্রিকায় পরিস্থিতি আপাতত নিয়ন্ত্রণে থাকলেও রাশিয়ায় দেশে চরম চাপে পড়েছেন প্রিগোজিন। বিদ্রোহের পর থেকে তার ক্যাটারিং প্রতিষ্ঠান একের পর এক খাবার সরবরাহের চুক্তি হারাতে শুরু করেছে।
এ ছাড়া রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সঙ্গেও বিশাল অঙ্কের ব্যবসা রয়েছে প্রিগোজিনের কোম্পানির। প্রিগোজিন মূলত রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে, সেনাঘাঁটিতে রসদ সরবরাহ করেন। রাশিয়ার পাশাপাশি আর্মেনিয়া ও কিরগিজস্তানের রুশ সেনাঘাঁটিতে রসদ দিয়ে থাকে প্রিগোজিনের কোম্পানি। এমন পরিস্থিতিতে হঠাৎ করে প্রিগোজিনের কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করতে পারবে না রাশিয়া।
ওয়াগনারবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ডেনিস কোরোতকভ জানান, বিদ্রোহ পরবর্তী সময়ে সামরিক ঘাঁটির কাজকে ব্যাহত না করেই প্রিগোজিনের সরবরাহ চেইনে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই রাশিয়ার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
মন্তব্য করুন