আব্দুল্লাহ আল মাছুম
প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২৫, ০৫:২৭ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
বিশ্লেষণ

পাকিস্তানের নিরাপত্তা সংকট এবং এর আঞ্চলিক অভিঘাত

ইসলামাবাদে হামলার স্থানে সতর্ক পাহারা। ছবি : সংগৃহীত
ইসলামাবাদে হামলার স্থানে সতর্ক পাহারা। ছবি : সংগৃহীত

পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে আত্মঘাতী হামলা বিশ্বের নজর কেড়েছে। বিশেষ করে দিল্লিতে বিস্ফোরণের পর হামলাটি হওয়ায় তা আঞ্চলিক বৈরিতায় ঘি ঢেলে দেয়। ভারত দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র প্রমাণে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তদবির করছে। নতুন করে বিশ্বের সামনে পাকিস্তানের নিরাপত্তা সংকট স্পষ্ট হওয়ায় ‘আঞ্চলিক অনিশ্চয়তার প্রতিফলন’ প্রসঙ্গ এখন আলোচনায়।

রাজধানী ইসলামাবাদের জেলা আদালতের প্রবেশপথে আত্মঘাতী বোমা হামলায় অন্তত ১২ জন নিহত এবং ২৭ জন আহত হয়েছেন। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে ছয়জন পুলিশ সদস্য এবং চারজন সাধারণ নাগরিক রয়েছেন। আহতদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

পুলিশের বর্ণনা অনুযায়ী, মঙ্গলবার সকালে এক ব্যক্তি আদালত প্রাঙ্গণে প্রবেশের চেষ্টা করলে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাকে আটকে দেন। এর পরই তিনি নিজের শরীরে বেঁধে রাখা বোমার বিস্ফোরণ ঘটান। আশপাশের ভবনের জানালাগুলো ভেঙে যায়, ভস্মীভূত হয় ৩টি গাড়ি।

আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, চরমপন্থি সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) হামলার দায় স্বীকার করেছে। বলা হচ্ছে, ঘটনাটি তারা উপগোষ্ঠী জামাত-উল-আহরার-কে দিয়ে করিয়েছে।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবেশী উত্তেজনা

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এটি শুধু পাকিস্তানের নয়, সমগ্র অঞ্চলের নিরাপত্তার ওপর হামলা। আমাদের বিশ্বাস, এই হামলার পরিকল্পনা সীমান্তের বাইরে থেকে করা হয়েছে।’

পরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি ভারতের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘বহিঃশক্তি পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করতে সক্রিয়।’

তবে ভারত সরকার এ অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। দ্য ইকোনমিক টাইমসের প্রতিবেদনে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিটি ছাপা হয়। তাতে বলা হয়, এই ধরনের অভিযোগ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যর্থতা আড়াল করার প্রচেষ্টা।

সন্ত্রাসের নতুন উত্থান

ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড পিসের সর্বশেষ বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদী ইনডেক্স ২০২৫ অনুযায়ী, পাকিস্তান বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক সন্ত্রাসপ্রবণ দেশ। ২০২৪ সালে দেশটিতে সন্ত্রাসী হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ। সিকিউরিটি থিংকট্যাঙ্ক পাকিস্তান ইনস্টিটিউট ফর কনফ্লিক্ট অ্যান্ড সিকিউরিটি স্ট্যাডিজ (পিআইসিএসএস) জানিয়েছে, ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলার সংখ্যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮১ % বৃদ্ধি পেয়েছে।

এই পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে, ইসলামাবাদের হামলাটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং একটি বৃহত্তর পুনরুত্থানের অংশ।

সীমান্ত ও গোয়েন্দা দুর্বলতা

নিরাপত্তা বিশ্লেষক রহিমউল্লাহ ইউসুফজাই পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম ডনকে বলেছেন, আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর পাকিস্তানের সীমান্তাঞ্চলগুলো সন্ত্রাসীদের জন্য নতুন করে আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। সীমান্ত পর্যবেক্ষণ দুর্বল হওয়ায় জঙ্গিরা সহজে প্রবেশ করছে।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষণ বলছে, পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এবং বেলুচিস্তান এখন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা, যেখানে টিটিপি ও বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো সমান্তরালভাবে সক্রিয়।

অর্থনীতি ও সমাজে অভিঘাত

ক্রমবর্ধমান সহিংসতা পাকিস্তানের বিনিয়োগ পরিবেশ ও সামাজিক স্থিতিশীলতায় গভীর প্রভাব ফেলছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা অনিশ্চয়তা দেশটির অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে ধীর করছে।

বিশ্লেষকদের মতে, বারবারের হামলা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতাকে আরও জটিল করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর জনগণের আস্থা নষ্ট হচ্ছে, যা সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে সমন্বয়হীনতা তৈরি করছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও করণীয়

চীন, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবসহ বেশ কয়েকটি দেশ হামলার নিন্দা জানিয়েছে এবং পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে।

ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্ট্যাডিজ ইসলামাবাদ (আইএসএসআই)–এর পরিচালক আহমেদ কুরেশি বলেন, সন্ত্রাস মোকাবিলায় শুধু সামরিক অভিযান যথেষ্ট নয়। পাকিস্তানকে স্থানীয় সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করে, গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় ও শিক্ষা-অর্থনৈতিক সুযোগের দিকে সমান মনোযোগ দিতে হবে।

ইসলামাবাদের আদালত প্রাঙ্গণের হামলা পাকিস্তানের নিরাপত্তা নীতির দুর্বলতা ও আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার প্রতিচ্ছবি। বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, যদি সীমান্ত নিরাপত্তা, গোয়েন্দা সক্ষমতা ও সামাজিক অংশগ্রহণ বাড়ানো না হয়, তাহলে এমন হামলার পুনরাবৃত্তি ঠেকানো সম্ভব হবে না। পাকিস্তানের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ শুধু জঙ্গিদের মোকাবিলা নয়, বরং রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে আস্থা ও স্থিতিশীলতা পুনর্গঠনের।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে দেশ বিপর্যায়ের মধ্যে পড়বে : নুর

অস্ত্র মামলা / মামুন হত্যাকাণ্ডের দুই শুটারসহ ৫ জন রিমান্ডে 

সাবেক এমপিদের জন্য আমদানিকৃত ৩১ বিলাসবহুল গাড়ি সরকারের মালিকানায়

২০২৬ বিশ্বকাপ / এখনও বাকি ২০টি টিকিটের লড়াই

জনপ্রিয় কনটেন্ট ক্রিয়েটর দীপ মারা গেছেন 

রেললাইনের স্লিপার ফেলে ট্রেন দুর্ঘটনার চেষ্টা 

বিএনপির প্রতিটি সিদ্ধান্ত দেশের স্বার্থকে সামনে রেখে নেওয়া হয় : আইয়ুব খান

মিসরে আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম বাংলাদেশি তরুণী

মেসি বার্সা ছেড়ে যাওয়ায় কোনো অনুশোচনা নেই লাপোর্তার

মানুষের ভালোবাসার দল বিএনপি : নুরুদ্দিন আহাম্মেদ অপু

১০

সন্ত্রাসী হামলা / ভারত-পাকিস্তান উভয়ের সঙ্গে তাল মেলাল ইরান

১১

সাড়ে ৪ হাজার টাকায় ডাকঘরে চাকরি করেন ইমরুল কায়েস!

১২

পদত্যাগ করলেন ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মইনুল খান

১৩

বেটিং কেলেঙ্কারিতে তুর্কি ফুটবলে ভূমিকম্প

১৪

ডেঙ্গুতে আরও ৫ মৃত্যু, হাসপাতালে ১১৩৯

১৫

বাংলাদেশি ১৩ জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে ‘আরাকান আর্মি’

১৬

প্রেমিকাকে সঙ্গে নিয়ে প্রাক্তন স্ত্রীর পাশে দাঁড়ালেন হৃতিক

১৭

ফেসবুকে লাইভ দিয়ে ফেঁসে গেলেন যুবক

১৮

ক্লাসে মোবাইল ব্যবহারে হাতিয়া দ্বীপ সরকারি কলেজের নির্দেশনা

১৯

বরিশালে ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৪৫, নতুন আক্রান্ত ১৭৯

২০
X