পুঁজিবাজারে সরকারি বন্ডের উন্নয়ন দেখতে চায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সেকেন্ডারি মার্কেটে সরকারি বন্ড উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সহায়তা করবে আন্তর্জাতিক এ সংস্থাটি। সরকারি বন্ডের বাজার উন্নয়নে সমীক্ষা করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আইএমএফ প্রতিনিধিদলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে মুখপাত্র বলেন, আইএমএফের এবারের মিশনের মূল উদ্দেশ্য দেশের বন্ড মার্কেট উন্নয়ন। এজন্য স্টাডি পারপাসে এসেছেন তারা। আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে টেকনিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট অন বন্ড মার্কেট। লোকাল কারেন্সি বন্ড মার্কেট ডেভেলপমেন্ট নিয়ে স্টাডি করছে এ কমিটি।
আইএমএফের সাত সদস্যের প্রতিনিধিদলে বন্ড বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের দুজন বিশেষজ্ঞ রয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারি বন্ডের সেকেন্ডারি মার্কেট কীভাবে উন্নয়ন করা যায়, তা নিয়েই আইএমএফ টিম বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করছে। সরকারি বন্ড মার্কেট উন্নত হলে বাংলাদেশের বেসরকারি বন্ড মার্কেটও উন্নত হবে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইএমএফ মনে করছে, বন্ড মার্কেট উন্নয়ন হলে ব্যাংকের বিকল্প অর্থায়নের সুযোগ হবে উদ্যোক্তাদের। এতে ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের চাপ কমে গিয়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণও কমে আসবে। দেশে বন্ড মার্কেট ততটা শক্তিশালী না হওয়ায় উদ্যোক্তারা এখনও ব্যাংকমুখী হয়ে রয়েছেন।
জানা গেছে, সম্প্রতি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সরকারি বন্ড সীমিত পরিসরে লেনদেন শুরু হয়েছে।
পুঁজিবাজারে সরকারি বন্ডের দ্রুত তালিকাভুক্তি ও সহজ লেনদেন বাড়িয়ে বন্ড মার্কেট উন্নয়নের পরিকল্পনা নিয়েছে আইএমএফ। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও বৈঠক করছে আইএমএফ প্রতিনিধিদল।
গতকাল থেকে শুরু হওয়া আইএমএফ প্রতিনিধিদলের বৈঠক চলবে আগামী ১৭ জুলাই পর্যন্ত। এসব বৈঠকের সূচিতে মুদ্রানীতির বাস্তব কার্যকারিতা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কৌশলে যে পরিবর্তন আনা হচ্ছে তার ফ্রেমওয়ার্ক, ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ব্যবস্থাপনা, আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন, অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের মতো বিষয় রাখা হয়েছে।
ঋণ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের হিসাব আইএমএফের মান অনুযায়ী ‘বিপিএম৬’ পদ্ধতিতে চলতি জুলাই মাস থেকে সংরক্ষণ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে তা প্রকাশ করা হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। ঋণ পাওয়ার পর আরও বেশ কিছু পরামর্শ বাস্তবায়ন করে চলছে বাংলাদেশ। মুদ্রানীতির আঙ্গিক বদলে ‘মনিটারি টার্গেটিং’-এর স্থলে ‘ইন্টারেস্ট রেট টার্গেটিং’ করা, ৯ শতাংশে বেঁধে রাখা ঋণ সুদহার সরিয়ে ১১ শতাংশের মধ্যে রাখা, বিনিময় হার বাজারমুখী করতে বাফেদার ওপর ছেড়ে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আইএমএফ প্রতিনিধিদলকে এসব বিষয়ে অগ্রগতি তুলে ধরেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রসঙ্গত, বৈশ্বিক যুদ্ধ ও অভ্যন্তরীণ নানা কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটে পড়ে গত জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের সঙ্গে ঋণ চুক্তিতে যায় বাংলাদেশ। আইএমএফ গত ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। এর তিন দিন পরই প্রথম কিস্তিতে ছাড় করেছে ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার। ২০২৬ সাল পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে মোট সাত কিস্তিতে দেবে ঋণের পুরো অর্থ। সেই হিসাবে বাকি আছে আরও ছয় কিস্তি। এরই মধ্যে আইএমএফের একটি স্টাফ কনসালটেশন মিশন গত ২৫ এপ্রিল থেকে ২ মে পর্যন্ত ঢাকায় সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করে গেছে।
ঋণ সমঝোতা অনুযায়ী, প্রতি কিস্তি ছাড়ের আগের কিস্তিতে দেওয়া অর্থের ব্যবহারের অগ্রগতি পর্যালোচনা করবে আইএমএফ। অবশ্য আন্তর্জাতিক এ সংস্থার সঙ্গে আলোচনা চলমান থাকার মধ্যেই ঋণ পেতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমানোসহ আর্থিক খাতের কাঠামো ও নীতি সংস্কারে বেশ কিছু পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করে চলছে বাংলাদেশ।
দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে ঋণের শর্ত পূরণের বিষয়টি পর্যালোচনা করতে আইএমএফের একটি দল আসবে আগামী সেপ্টেম্বরে। ওই পর্যালোচনার ওপর নির্ভর করবে দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়। তবে এর আগেই কারিগরি মিশনটি ঋণ ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবস্থাপনা, রাজস্ব বাড়ানো, বাজেট ব্যবস্থাপনায় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কর্মকর্তাদের গাইড লাইন প্রস্তুতে সক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করবে।
এর আগে গত মে মাসেও আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে গেছে ঋণ অর্থ বাস্তবায়নের অগ্রগতি দেখতে। ওই সময়ে দেশের আর্থিক খাতের উন্নয়নে নেওয়া পদক্ষেপে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিল সংস্থাটির প্রতিনিধিদল।
মন্তব্য করুন