প্রভাষ আমিন
প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০২৪, ০৩:০৬ এএম
আপডেট : ১৩ মার্চ ২০২৪, ০৮:২০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সংযমের চেতনা সমুজ্জ্বল থাকুক রমজানে

সংযমের চেতনা সমুজ্জ্বল থাকুক রমজানে

সেদিন ফেসবুকে একজন লিখলেন, মধ্যপ্রাচ্যের কোনো একটি দেশে রমজান সামনে রেখে বিশাল মূল্যছাড় দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে একটি ছবিও দেওয়া ছিল। ছবিতে দাম কমানোর তালিকা দেখে আমিও বিস্মিত। রমজানের সব নিত্যপণ্যেই বিশাল মূল্যছাড় দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটি অর্ধেকেরও বেশি। পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম, মধ্যপ্রাচ্যসহ অধিকাংশ ইসলামী রাষ্ট্রেই রমজানে জিনিসপত্রের দাম কমানো হয়। শুধু ইসলাম কেন, সব ধর্মের উৎসবেই বিশাল মূল্যছাড় থাকে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে বড়দিনের সময় অবিশ্বাস্য মূল্যছাড় দেওয়া হয়। লোকজন সারা বছর অপেক্ষায় থাকে খ্রিষ্টমাসে কম দামে পছন্দের জিনিস কেনার জন্য। বিশ্বে সম্ভবত একমাত্র ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে রমজান এলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকার শুল্কছাড় দিলেও দাম বাড়ে। আমি খালি ভাবি, অন্য দেশের ব্যবসায়ীরা এত বোকা কেন। তারা উৎসব এলে তো সারা বছরের ব্যবসা একবারে করে রাখতে পারে। কীভাবে মানুষকে জিম্মি করে লাভ করতে হয়, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অন্য দেশের ব্যবসায়ীরা সেটা শিখে নিতে পারে।

রোজা মুসলমানদের পাঁচ ফরজের একটি। প্রাপ্তবয়স্ক সবার জন্য রোজা রাখা বাধ্যতামূলক। রমজান আসে সংযমের বারতা নিয়ে। ধর্মীয় কারণ তো বটেই, ইদানীং জানা যাচ্ছে স্বাস্থ্য বিবেচনায়ও রোজা সবার জন্য উপকারী। এখন অমুসলিমরাও স্বাস্থ্যগত কারণে দিনের একটা বড় সময় উপবাস করছেন। অথচ ইসলাম ১৪০০ বছর আগেই রোজা বাধ্যতামূলক করেছে। রমজানে মুসলমানরা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকেন। তবে শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকাই রোজা নয়। সব ধরনের রিপু থেকে সংযত থাকাও রোজার অন্যতম ফরজ। যিনি রোজা রাখছেন, তার স্বাস্থ্যের জন্য তো ভালো হচ্ছেই, যারা খাবারের অভাবে খেতে পারছেন না, তাদের কষ্টটাও বুঝবেন আরেক মুসলমান। এটাই রোজার অন্যতম শিক্ষা। ফলে রোজা এমন একটি ফরজ ইবাদত, যার বহুমাত্রিক মাজেজা রয়েছে।

রোজার সবচেয়ে বড় যে শিক্ষা-সংযম, আমাদের দেশে সেটাই উপেক্ষিত হয় সবচেয়ে বেশি। যেহেতু সারা দিন পানাহার থেকে বিরত থাকতে হয়, তাই রমজানে খাবারের পেছনে খরচ কম হওয়ার কথা। কিন্তু ঘটে উল্টো ঘটনা। রমজানে খাদ্যপণ্যের পেছনে আমাদের ব্যয় বেড়ে যায়। রোজায় স্বাস্থ্যের যেটুকু উপকার হওয়ার কথা, অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে ক্ষতি হয় তার চেয়ে বেশি। সারা দিন না খাওয়ার পর আমরা খালি পেটে ইফতারি করি ভাজাপোড়া দিয়ে। রমজানে খাদ্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়ে বাজারে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বেশিরভাগই মুসলমান। কিন্তু রমজান এলেই তারা সংযমের বদলে লোভের কবলে পড়েন। হুহু করে বেড়ে যায় জিনিসপত্রের দাম। এবার তো আগে থেকেই বাজারে আগুনের আঁচ। রমজান এলে অন্যসব নিত্যপণ্যের চাহিদা তো বাড়েই; বাড়ে চিনি, ছোলা, খেজুর, ভোজ্যতেল, মসলা, দুধ, বেগুন, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচের চাহিদাও। আর চাহিদা বাড়লে বেড়ে যায় দামও। শেষ মুহূর্তে এসে ব্যবসায়ীরা বলেন, চাহিদা বাড়লেও সরবরাহ বাড়েনি, তাই দাম বেশি। তার ওপর এবার আছে ডলারের অস্থির বাজারের প্রভাব, যুদ্ধের অজুহাত। এমনিতেই বাজারের যে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা, মধ্যবিত্ত টিকে আছে পুষ্টি স্যাক্রিফাইস করে। রমজান এলে তাদের স্যাক্রিফাইসের তালিকা আরও লম্বা করতে হবে।

রমজানে এমনিতেই সংকট থাকে। আর সেই ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টায় অসৎ ব্যবসায়ীরা মানুষের পকেট কাটতে ব্যস্ত হয়ে যান। ব্যবসায়ীরা লাভ করবেন, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু লাভের জায়গা যখন লোভ দখল করে নেয়, সমস্যা হয় তখনই। রমজানের বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যবসায়ীরা যাতে কারসাজি করে জিনিসপত্রের দাম বাড়াতে না পারে, সেজন্য নজরদারি বাড়াতে হবে। স্বাভাবিক নজরদারির সঙ্গে প্রয়োজনে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে। আমরা সাধারণ মানুষ আনন্দের সঙ্গে সংযমের রমজানটা পালন করতে চাই। আমাদের মাথায় যেন স্রষ্টার সন্তুষ্টির বিষয়টাই থাকে, পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বমূল্য নিয়ে যেন ভাবতে না হয়। বাজারের চেয়ে প্রার্থনায় যেন আমাদের বেশি সময় কাটে।

আগেই যেমনটি বলেছি, রমজান সংযমের মাস। ধারণাটাই হলো, রমজানে মুসলমানরা তাদের সব ইন্দ্রিয়ের সংযম পালন করবেন। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা নিছক সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকাকেই রমজান হিসেবে পালন করি। রমজানে দিনের বেলা আমরা সব ধরনের খাওয়া-দাওয়া থেকে বিরত থাকি। এমনকি গোপনেও কেউ পানিও পান করি না। অথচ এ রমজানেও প্রকাশ্যে ঘুষ খাই, দুর্নীতি করি, ব্যবসায়ীরা ভোক্তাদের পকেট কাটে। রমজান বা ঈদ সামনে রেখে ঘুষে রেট বেড়ে যায়, রাস্তাঘাটে চাঁদাবাজি বেড়ে যায়। রমজানে যারা রোজা রেখেও ঘুষ খায়, চাঁদা নেয়, দুর্নীতি করে, ভোক্তাদের কাছ থেকে বাড়তি দাম আদায় করে; তাদের রোজা আল্লাহ কবুল করবেন কি না, জানি না। দিনের বেলা খাওয়া-দাওয়া না করা বেশি পুণ্যের নাকি দুর্নীতি করা বেশি পাপের; সেটাও আল্লাহ ভালো বলতে পারবেন। তবে একজন ভালো মুসলমানের দায়িত্ব হলো আল্লাহর সব আদেশ পালন করা। ইসলামের পাঁচ ফরজ পালন তো আবশ্যিক। সঙ্গে সত্য কথা বলা, দুর্নীতি না করা, মানুষের কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায় না করা, অন্যের ক্ষতি না করা, অন্যের বিশ্বাসে আঘাত না করা, অন্যের সম্পত্তিতে লোভ না করা, সবাই মিলে ভালো থাকা; একজন ভালো মুসলমানের বৈশিষ্ট্য।

বলছিলাম রমজানে সংযমের কথা। প্রাথমিক সংযমটা হলো খাওয়া-দাওয়ার। কিন্তু রমজান এলে বাংলাদেশের সব আলোচনা কেন্দ্রীভূত হয়ে যায় খাওয়ায়। চারদিকের আলোচনা শুনলে মনে হতে পারে, খাওয়া ছাড়া রমজানে আর কোনো কাজ নেই। দিনের বেলা না খেলেও ইফতারিতে, রাতের খাবার এবং সেহরি মিলে যা খায় মানুষ; তা অন্য স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি। বিশেষ কিছু খাবার আছে, যা শুধু রমজান এলেই খাওয়া হয়।

সংযমের মাস রমজানে অপচয় হয় অনেক বেশি। বড় বড় হোটেলে বা ইফতার পার্টিতে ইফতারের নামে যে অপচয় হয়, তা রমজানের সংযমের ধারণার সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান। ৫০ আইটেমের ইফতারের সঙ্গে কমপ্লিট ডিনার। দুয়েকবার এমন ইফতার পার্টিতে গিয়ে দেখেছি, আমি চার-পাঁচ আইটেম ছুঁয়ে দেখতে পারিনি। ইফতার শেষে বাকি আয়োজন নষ্ট হয়। অথচ প্রতিদিন কত মানুষকে স্রেফ পানি বা একটু ছোলা দিয়ে ইফতার সারতে হয়। ইফতার পার্টির সঙ্গে ইদানীং যুক্ত হয়েছে সেহরি পার্টি। পুরান ঢাকার ও গুলশানের কিছু রেস্টুরেন্টে ভোররাতে আসন পাওয়া যায় না। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.) সংযমের কথা বলেছেন এবং মেনে চলেছেন। আমরা তার অনুসারী। তিনি খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন বলে আমরাও খেজুর খাই। কিন্তু বাস্তবে তার আদর্শ অনুসরণ করি না।

রমজান মাস মানেই মানুষের ভোগান্তির মাস। প্রতিদিন ইফতারের আগে আগে রাস্তাঘাট স্থবির হয়ে যায়। অনেক মানুষকে রাস্তায় ইফতার সারতে হয়। রমজানের শেষদিকে শপিংমল এলাকায় মানুষের ঢল নামবে। একটা নতুন জামা না পেলে ঈদের আনন্দই পুরো হয় না আমাদের। কিন্তু আমার বাসার সহকারী বা তার মেয়েটি নতুন জামা পেল কি না, সেটা দেখার সময় থাকে না আমাদের। ইসলাম কিন্তু বলে, ধনী-গরিবে ভেদাভেদ না রাখতে, সবাই মিলে ভালো থাকতে, সবাইকে ভালো রাখতে।

সব মিলে সংযমের রমজান আর আনন্দের ঈদ আমাদের জন্য বয়ে আনে খরচের বোঝা আর ভোগান্তি। আমরা চাই রমজানটা যেন সত্যি সত্যি সংযমের হয়, ঈদটা যেন আনন্দের হয়।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিষ খেয়ে বেঁচে ফিরলেও গলায় ফাঁসে প্রাণ গেল স্কুলছাত্রের

সন্ধ্যার মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের শঙ্কা

নিজ আয়েই প্রতিস্থাপন খরচ মেটাবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১

বিমান থেকে সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়ার হুমকি যাত্রীর! অতঃপর...

হার দিয়ে ঘরের মাঠকে বিদায় এমবাপ্পের

নীলফামারীতে ‘সংঘবদ্ধ ধর্ষণের’ ঘটনায় গ্রেপ্তার ২

চার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৫২ পরীক্ষার্থী, পাস করেনি কেউ

পরকীয়া প্রেমিকের হাতে লায়লা খুন

ববি শিক্ষার্থীদের বেঁধে পেটাল স্থানীয়রা

রুম দখল নিয়ে ছাত্রলীগের দুপক্ষের সংঘর্ষ, আহত ১৭

১০

আমেরিকা যাওয়ার পথে মেক্সিকোতে প্রাণ গেল বাংলাদেশির

১১

৫৭ বছরে এসএসসি পাস করলেন পুলিশ কনস্টেবল ছামাদ

১২

দাওয়াতে নিয়ে মসজিদের ইমামকে কুপিয়ে জখম

১৩

স্পেনে সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশি নিহত

১৪

দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষ, আহত ১০

১৫

১৩ মে : নামাজের সময়সূচি

১৬

সোমবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

১৭

খেলাধুলাই পারে বাংলাদেশের মানুষকে এক কাতারে আনতে : জাভেদ ওমর

১৮

জরুরি বিভাগে ডাক্তার অনুপস্থিত, রোগীর মৃত্যু

১৯

পাইপলাইনে গ্যাস, ১০ বছরেও আবেদন করেনি কেউ!

২০
X