হাজারীবাগ এলাকার ইনস্টিটিউট অব লেদার টেকনোলজি কলেজ-সংলগ্ন উন্মুক্ত এলাকায় কোরবানির পশুর হাট বসাতে ইজারা দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। তবে বাস্তবে সেখানে কোনো খালি জায়গা নেই। কলেজের বিশাল মাঠ ফাঁকা পড়ে আছে। হাট বসেছে সড়ক ও ফুটপাতজুড়ে। এতে এলাকাবাসীর ভোগান্তির শেষ নেই।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কলেজের প্রবেশ ফটকে ছাগল-ভেড়া ও অন্যপাশ ধরে হাজারীবাগ পর্যন্ত গরুর হাট বসানো হয়েছে। এ ছাড়া আশপাশের সড়কেও গরুর ছড়াছড়ি। বৃষ্টিতে গোবর, গোখাদ্যসহ আবর্জনায় ভরে গেছে চারপাশ। স্থানীয় বাসিন্দা সাহাদাত সাদমান বলেন, সড়কে হাট নিয়ে ভোগান্তির কথা বলে শেষ করা যাবে না। কাগজে-কলমে পাঁচ দিন হাটের কথা বলা হলেও আমাদের কষ্ট পোহাতে হয় অন্তত দুই সপ্তাহ। একপাশে শেড দেওয়া থাকলেও গরু উঠে সড়কের দুই পাশেই। ইজারাদার নিজের স্বার্থে অলিগলিতে পশু রাখেন। অলিগলি গোবর-ময়লায় ভরে যায়। তার দাবি, লেদার টেকনোলজি কলেজ মাঠ হাট হিসেবে ব্যবহার করা হলে ভোগান্তি কমার পাশাপাশি ক্রেতাদের জন্যও সুবিধা হতো। ভোগান্তির বিষয়ে জানতে চাইলে হাট ইজারাদারের প্রতিনিধি মোজাম্মেল মিয়া বলেন, কিছুটা ভোগান্তি তো হবেই। তবে হাট চলাকালে মূল অংশে গাড়ি চলবে না।
শুধু এই হাটই নয়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে যে ১৮টি স্থানে কোরবানির অস্থায়ী পশুর হাট বসেছে তার বেশিরভাগেরই এমন অবস্থা। ইজারাদাররা সিটি করপোরেশনের দেওয়া ইজারার কোনো শর্তই মানছেন না। গতকাল রোববার থেকে হাট শুরুর কথা থাকলেও কার্যত গত বৃহস্পতিবার থেকেই হাট শুরু হয়ে যায়। অথচ ঈদের চার দিন আগে থেকে হাট শুরু করার কথা ইজারাদারদের। তার দুদিন আগ থেকে হাটের অবকাঠামো তৈরির কথা। সে নিয়মও মানেননি কোনো ইজারাদার। যে সীমার মধ্যে পশুগুলো রাখার কথা, সেটা একেবারেই অনুসরণ করা হয় না। সিটি করপোরেশনও এ বিষয়ে বরাবরই নীরব ভূমিকা পালন করে। ফলে প্রতিবছর কোরবানির ঈদের আগের দিনগুলোতে বৈধ-অবৈধ পশুর হাটে ছেয়ে যায় পুরো নগরী। ভোগান্তিতে পড়তে হয় নগরবাসীকে।
ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের খেলার মাঠে প্রতিবছরই পশুর হাট ইজারা দেয় উত্তর সিটি করপোরেশন। তবে এ হাট মাঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। স্থানীয় বাসিন্দা মশিউর রহমান বলেন, মাঠে সর্বোচ্চ পাঁচ শতাধিক পশু রাখা যায়। তবে এ হাটে ১০ থেকে ১৫ হাজার পশু আসে। তখন আশপাশের সব সড়কে হাট বসে যায়। এবারও একই অবস্থা। হাটের ইজারাদার হোসেন খান বলেন, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের মাঠের পাশাপাশি আশপাশের সড়কগুলোতেও পশু বিক্রি করা যাবে বলে জানিয়েছে ডিএনসিসি। তবে নাগরিকদের যাতায়াতে যাতে সমস্যা না হয়, সে ব্যবস্থা রাখা হবে। দক্ষিণ সিটির ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনাল-সংলগ্ন উন্মুক্ত এলাকায় হাট বসাতে ইজারা দেওয়া হয়েছে। তবে সেখানে কোনো খালি জায়গা দেখা যায়নি। ওই এলাকার ধোলাইখাল সড়কের ওপরই বাঁশ পুঁতে পশু বিক্রি করা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা পশু নিয়ে এ হাটে আসছেন। এরই মধ্যে হাটের সীমানা ধোলাইখাল সড়ক ছাড়িয়ে আশপাশের গলিতেও ঢুকতে দেখা গেছে। এ হাট দয়াগঞ্জ মোড় থেকে রায়সাহেব বাজার পর্যন্ত ছাড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন। যাত্রাবাড়ী দনিয়া কলেজ-সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গায় হাট ইজারা দেওয়া হলেও সেখানেও কোনো উন্মুক্ত জায়গা নেই। এ এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দুপাশেই পশুর হাট বসেছে। এতে দূরপাল্লার যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। দক্ষিণ সিটির সম্পত্তি কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান বলেন, যেসব এলাকায় হাট ইজারা দেওয়া আছে, সেখানে উন্মুক্ত জায়গা আছে। তবে ঈদের আগমুর্হূতে হাটগুলোতে চাপ বেড়ে যায়। হাটে শৃঙ্খলা রাখতে মনিটরিং টিম রয়েছে।
নাগরিকদের যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সে বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হবে।
এদিকে জমে উঠেছে রাজধানীর বেশিরভাগ পশুর হাট। বিক্রেতারা বলছেন, এ বছর ছোট ও মাঝারি গরুর বেশি বিক্রি হচ্ছে। ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা দামের গরুর চাহিদা বেশি। আর বড় আকারের গরুর ক্রেতা কম থাকায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বিক্রিতারা।
বনশ্রী থেকে আফতাবনগর গরুর হাটে এসেছেন আব্দুস সালাম নামে একজন ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, মাঝারি সাইজের গরুর দাম বেশি, চাহিদাও বেশি হাটে। গতবার যে গরু ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে এবার সেই গরু বিক্রেতারা শেষ দামই চাচ্ছে দেড় লাখ।
লাখ টাকার নিচে গরু নেই শাহজাহানপুর হাটে। তিন মণের উপরে গরুর দাম পড়ছে ১ লাখ ১০ হাজার থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার। আর পাঁচ থেকে ছয় মণের উপরের গরুর দাম পড়ছে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। বিক্রেতারা বলছেন, পশুখাদ্যের দাম বাড়ার কারণে গত বছরের তুলনায় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা বেশি পড়েছে গরুর দাম। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাড়তি পরিবহন খরচ।
কুষ্টিয়া থেকে ১৫টি দেশি জাতের গরু নিয়ে এসেছেন ব্যাপারী মোহাম্মদ রিফাজ হোসেন। তার আশা সোম ও মঙ্গলবার সব গরু বিক্রি হয়ে যাবে। গত বছর ১০টি গরু নিয়ে এসেছিলেন, যার সব বিক্রি হয়েছিল। এবার তাই পাঁচটি গরু বেশি এনেছেন। তার কাছে থাকা গরুরও সর্বনিম্ন দাম ১ লাখের উপরে।
ঝিনাইদহের কামাল ব্যাপারী এসেছেন নিজের পোষা দুটি গরু নিয়ে। দুটির দাম আড়াই লাখ টাকা। আর আলাদা করে কিনতে চাইলে একটির দাম ১ লাখ ২০ টাকা, যার ওজন হবে তিন মণের কিছু বেশি। আর অন্যটি পাঁচ মণের মতো, দাম ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
গাবতলী হাটের ক্রেতাদের অভিযোগ, অনেক বেশি দাম হাঁকাচ্ছেন বিক্রেতারা। বিক্রেতাদের পাল্টা অভিযোগ, বড় গরুর ক্রেতার চেয়ে দর্শনার্থী বেশি। দামদর করছেন, ঘুরছেন বেশি, কম ক্রেতাই কিনছেন। তাদের আশা মঙ্গলবার থেকে বাড়বে বেচাকেনা।
যশোর থেকে শাহিওয়াল জাতের ক্রস দুটি গরু এনেছেন হাবিব মিয়া। একেকটির আনুমানিক ১২ মণ ওজন দাবি করে তিনি বলেন, ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা দাম চেয়েছি। ১০ লাখ পর্যন্ত দাম উঠেছে। ১১-১২ লাখে ছেড়ে দেব।
১ লাখ ২০ হাজারে গরু কিনে সন্তুষ্ট সুলেমান বলেন, কোরবানি দেব নিয়ত করেছি, বসে থেকে লাভ কী। তাই গরু কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরছি। দেশি জাতের গরু। সাইজে ছোট হলেও দাম ছাড়তে চাচ্ছিল না বিক্রেতা। অনেক দর কষে কিনতে হয়েছে।
বছিলা হাটে উঠেছে ব্রাহামা জাতের একটি, যার ওজন ৯৭৬ কেজি। সেটির দাম চাওয়া হচ্ছে ১০ লাখ টাকা। কিন্তু ক্রেতারা দাম হাঁকাচ্ছেন অর্ধেক। গরুটির মালিক মো. আজম বলেন, ২৮ মাস ধরে তিনি গরুটিকে লালন-পালন করে বড় করছেন। ওজন প্রায় ১ হাজার কেজি। পুরো গায়ে গোশত। তাই তিনি সেটির দাম ১০ লাখ চাইছেন। শেষমেশ এই দাম ভেঙে সাড়ে ৮ লাখ পর্যন্ত আসতে পারে।
১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সংসার সামলানোর পাশাপাশি শখের বসে গরু লালন পালন করেন ময়না ইয়াসমিন। চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার দুই সন্তানের জননী ময়না প্রতিবছর কোরবানির সময় একাধিক গরু ব্যাপারীদের কাছে বিক্রি করেন। কিন্তু দাম নিয়ে তার মনে খটকা লেগে থাকত সবসময়। বছরজুড়ে ইয়াসমিন গরুর যত্ন করলেও লাভের টাকা যায় ব্যাপারীদের পকেটে। তাই এবার ভাই আল-আমিনকে নিয়ে ময়না ইয়াসমিন নিজেই ঢাকার ধোলাইখাল হাটে এসেছেন। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন বিশাল আকৃতির দুটি গরু ‘লালু-কালু’। দাম হাঁকিয়েছেন সাড়ে ৬ লাখ টাকা করে। তবে ৫ লাখ করে পেলেও বিক্রি করে দেওয়ার কথা জানান এ বিক্রেতা। ময়নার দাবি, গরু দুটিতে কমপক্ষে ১৪-১৫ মণ গোশত হবে। সে তুলনায় আহামরি দাম চাওয়া হয়নি।
মন্তব্য করুন