আবেদ খান
প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০২৩, ০২:৩৫ এএম
আপডেট : ০২ আগস্ট ২০২৩, ০৮:২৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সব বিদেশি পর্যবেক্ষক এলে অসুবিধা কোথায়

পুরোনো ছবি
পুরোনো ছবি

বাংলাদেশে যখনই সাধারণ নির্বাচন নিয়ে ভাবনা-চিন্তা হয়, তখন দেখা যায় একটা দেশি মহল এবং তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে কোনো কোনো বিদেশি বিশেষ মহল তৎপর হয়ে উঠছে। বাংলাদেশে কী করলে গণতন্ত্র আনা যাবে, কী করলে মানুষ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবে, কী করলে দেশটা চিরশান্তির দেশে পরিণত হবে, কীভাবে চললে দেশে সরকার পাল্টালেও কেউ টুঁ শব্দটি করবে না—এইসব বাণী নিয়ে পাশ্চাত্য দুনিয়ার তাবৎ মাথাগুলো ঘর্মাক্ত হচ্ছে কিছুদিন ধরেই। লক্ষ করার মতো বিষয় হচ্ছে, পশ্চিমা দুনিয়ার প্রকাশ্য ও নেপথ্যে নেতৃত্ব দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

এবারও আগামী নির্বাচন ঘিরে বেশ আগে থেকেই মাঠে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব। আসন্ন নির্বাচন নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ যত না ভাবছে, তার চেয়ে বেশি মাথাব্যথা যেন পশ্চিমা শক্তিগুলোর। আগামী ডিসেম্বরের শেষের দিকে বা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন আয়োজনের চিন্তা করছে নির্বাচন কমিশন। সেক্ষেত্রে পাঁচ মাসেরও কম সময় হাতে রয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে তপশিল ঘোষণা হওয়ার কথা অক্টোবরের শুরুর দিকেই। সেজন্য চিন্তাভাবনা কিংবা পরিকল্পনা করার কথা তো রাজনৈতিক দলগুলোর। তাহলে বিদেশি শক্তিগুলোর এত দুশ্চিন্তা কেন? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্ব তো বারবার এ কথা বলছেন যে, আওয়ামী লীগ একটা স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচন চায়। একই সঙ্গে ক্ষমতাসীনরা চায়, সংবিধানের ধারাকে সামান্যতম ব্যত্যয় না ঘটিয়ে অনুষ্ঠেয় সেই নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করুক।

এর মধ্যে দেখা যাচ্ছে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন দলগুলো এবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলে পথে নেমেছে নানা ধরনের কর্মসূচি নিয়ে। এমনকি আগস্ট মাসেও তাদের নানাবিধ তৎপরতার সামান্যতম রদবদল ঘটেনি। অবশ্য আমি তাদের কোনো অপারগতা নিয়ে প্রশ্ন তুলব না এবং সেটা এই লেখার সঙ্গে ততখানি দরকারি বলেও মনে হয় না। গত দেড় দশকে তারা জনমানুষের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে পথে নেমেছে বলে আমি মনে করতে পারছি না। হয়তো তাদের কিছু সাংগঠনিক সমস্যা ছিল কিংবা কীভাবে পথ চলবে, তারা তা ঠিক করে উঠতে পারছে না বলে তাদের তৎপরতা চোখে পড়েনি। তবে যা দেখা যাচ্ছে, তা হলো তারা সেই পুরোনো বিষয়টিই আবার নতুন করে তুলে ধরেছে। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই আবার ফিরিয়ে আনতে হবে—শেখ হাসিনার সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। বিএনপি মহাসচিব তো ভদ্রলোকের এককথার মতো বলেই দিলেন তার দলের দাবি একটাই—শেখ হাসিনার পদত্যাগ। আর এই যে রাজপথে বিএনপি ও সমমনাদের হঠাৎ আন্দোলন-কর্মসূচিতে সোচ্চার হওয়ার নেপথ্যেও রয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের প্রকাশ্য ও নেপথ্য মদদ। যদিও অস্তিত্ব ধরে রাখতে মরিয়া দলটি যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় যেতে চাইছে। লাখ লাখ ডলার খরচ করে পশ্চিমা লবিস্ট দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিশ্বমঞ্চে হেয় করছে। এমনকি জাতিসংঘের মাধ্যমে বিশ্বের শান্তি প্রতিষ্ঠায় এক নম্বর অবস্থানে থাকা বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী বাহিনীকেও টার্গেট করছে।

অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রসমেত পশ্চিমা বিশ্বের একাংশ বলছে যে, তারা সুষ্ঠু এবং অবাধ নির্বাচন দেখতে চায় বাংলাদেশে। জাতিসংঘ বলছে শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের কথা। অবশ্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কেউ এখনো নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কোনো কথাই বলেনি। অবশ্য তার মানে এই নয় যে, তারা বলেনি বলে কখনো বলবে না। গত ৯ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ সফর করে পরিস্থিতি দেখে গিয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নির্বাচন বিশেষজ্ঞ হিল্লেরি রিকার্ডোর নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল। তারা শ’খানেক বৈঠক করে যে ধারণা নিয়ে গেল, তার একটা প্রতিবেদন ইইউর পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেলের কাছে জমা দেওয়ার কথা। এর ওপর নির্ভর করবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন নির্বাচনের সময় কোনো পর্যবেক্ষক পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবে কি না। তবে এ পর্যন্ত পরিস্থিতি অবলোকন করে প্রতীয়মান হচ্ছে, তাদের মূল চিন্তা হচ্ছে নির্বাচনটা সংঘাত-সংক্ষুব্ধ হবে কি না। তারা কখনোই সংবিধানের বাইরে কোনো কিছু ভাবতে পারে না। কারণ তাদের স্থায়ী বিশ্বাস হলো, সংবিধান বাইবেলের মতো পবিত্র এবং সেটার অমর্যাদা কখনো শোভনীয় এবং সুফলপ্রদ হয় না।

এদিকে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস গতকাল মঙ্গলবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের জানান, ‘যুক্তরাষ্ট্র অক্টোবরের শুরুতে আগাম নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে।’ এর মানে হচ্ছে, নির্বাচন ইস্যুতে সরকারকে চাপে রাখলেও বিদেশি বন্ধুরা বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের দিকেই তাকিয়ে আছে।

বিভিন্ন দেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন নিজ নিজ দেশের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। নাগরিক সমাজের পর্যবেক্ষক দলে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের যুক্ত করা হয়। আমাদের দেশেও এর প্রচলন রয়েছে। তাদের পর্যবেক্ষণ যদি কোনো দলের পক্ষে যায় তো তারা ভালো। আর বিপক্ষে গেলে তাদের বিরুদ্ধেও চলে বিভিন্ন মহলের বিষোদ্গার। সাম্প্রতিক চার বিদেশি পর্যবেক্ষকের বেলায়ও একই চিত্র দেখা গেছে। অথচ তারা নিজ নিজ দেশের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন দেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতাও তাদের রয়েছে।

সাম্প্রতিক সফরগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিদেশি কূটনীতিক ও প্রতিনিধিরা কেউই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পক্ষে কোনো কথা বলেননি। বরং তারা সংবিধানের আলোকেই সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছেন। অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের কথা বললেও অধিকাংশই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনও উল্লেখ করেননি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়েও কোনো নেতিবাচক মনোভাব পাওয়া যায়নি। গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় বিদেশিরা শান্তিপূর্ণ ভোট গ্রহণে নির্বাচন কমিশনের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন। তারা এমন কোনো কথা বলেননি যে, এই নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠু ভোট গ্রহণ সম্ভব নয়।

আসলে বর্তমান বিশ্বের কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলে কিছু নেই। বিদেশিরা গণতন্ত্র সমুন্নত রেখেই সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছেন। বাংলাদেশের সংবিধান, সার্বভৌমত্ব ও আইন ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে তারা এখানে নির্বাচন দেখতে চান। তারা নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারে আশ্বস্তও হয়েছেন।

তবে এ প্রসঙ্গে একটা সত্যি কথা হলো, বিদেশি শক্তি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এত মাথা ঘামাবেই বা কেন? আমাদের দেশটা তো আমাদেরই দেশ—আমাদের সুদীর্ঘ সংগ্রামের ফসল। এই দেশের মানুষের কল্যাণ তো এই দেশের মানুষই নির্ধারণ করবে। সেখানে কেন বিদেশিদের এত তৎপরতা? আমরা তো কখনো অন্য কোনো দেশের সরকার, নির্বাচন, সরকার পদ্ধতি নিয়ে কথা বলি না! এমনকি যে মিয়ানমার থেকে দশ-বারো লাখ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী প্রাণভয়ে আমাদের দেশের মানুষের ওপর বছরের পর বছর চেপে বসল, আমাদের অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করল, আমাদের ফসলের মাঠ ধ্বংস করল, ধ্বংস করল আমাদের বনজঙ্গল ভূমি ব্যবস্থা, আমরা তো সেজন্য সেদেশের সরকার ব্যবস্থার ওপর কোনোরকম খবরদারি করার ন্যূনতম চেষ্টাও করিনি কিংবা সে ধরনের ইচ্ছাও পোষণ করিনি। যদিও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমারা যত সোচ্চার, তার সিকিভাগও দেখিনি রোহিঙ্গা সংকট সুরাহায়। কাজেই আমাদেরও প্রত্যাশা থাকবে, আমাদের প্রতি কেউ যেন কোনোরকম সৌজন্য প্রকাশে কুণ্ঠিত না হন। আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি বন্ধুরা যেন অযাচিত হস্তক্ষেপ না করেন। আমরা দেশ চালাতে চাই নিজেদেরই শর্তে। তবে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব বিদেশি পর্যবেক্ষক এলে অসুবিধা কোথায়। সবাইকে স্বাগত জানিয়ে রাখলাম।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ফরিদপুরে দুদকের মামলায় খাদ্য কর্মকর্তা কারাগারে

বগুড়ায় স্ত্রীর মামলায় স্বামীর জেল-জরিমানা

‘ক্ষমতায় এলে নারীদের নামে ফ্যামিলি কার্ড দেবে বিএনপি’

হাওরে নির্মিত অলওয়েদার সড়কে পর্যাপ্ত কালভার্ট রাখা হয়নি : উপদেষ্টা ফরিদা আখতার

মুন্সীগঞ্জের গ্রামে ভয়াবহ আগুন

আহত চবি ছাত্রদের খোঁজ নিতে হাসপাতালে জামায়াত নেতারা

পুলিশ দেখে নদীতে ঝাঁপ দেওয়া ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার

ম্যাজিস্ট্রেটের সামনেই কালোবাজারে ট্রেনের টিকিট বিক্রি, কারাগারে রেলকর্মী

মৌচাষ উন্নয়নে বিসিকের কার্যক্রম নিয়ে সেমিনার

নিশাঙ্কার শতকে জিম্বাবুয়েকে হোয়াইটওয়াশ করল লঙ্কানরা

১০

সিটির হারের পর রদ্রির হতাশ স্বীকারোক্তি: ‘আমি মেসি নই’

১১

ঝড়ো ফিফটি করেও দলকে জেতাতে পারলেন না সাকিব

১২

টঙ্গীতে ২ থানার ওসি একযোগে বদলি

১৩

তারেক রহমানের নেতৃত্বে গণআকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব : হুমায়ূন কবির

১৪

সোবোশ্লাইয়ের দুর্দান্ত ফ্রি-কিকে আর্সেনালকে হারাল লিভারপুল

১৫

নেত্রকোনা জেলা বিএনপির সভাপতি আনোয়ার, সম্পাদক হিলালী

১৬

তারেক রহমানকে ঘিরেই রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে চায় বিএনপি

১৭

চীন থেকে ফিরেই নুরকে দেখতে গেলেন নাহিদ-সারজিসরা

১৮

৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ / বিএনপির অবারিত সুযোগ, আছে চ্যালেঞ্জও

১৯

বিএনপির প্রয়োজনীয়তা

২০
X