আমেনা হীরা
প্রকাশ : ২২ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২২ জুন ২০২৫, ০৮:১৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

নতুন পররাষ্ট্র সচিবের সামনে তিন চ্যালেঞ্জ

আজ দায়িত্ব গ্রহণ
আসাদ আলম সিয়াম । ফাইল ছবি
আসাদ আলম সিয়াম । ফাইল ছবি

বাংলাদেশের ২৮তম পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে আজ রোববার দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছেন বিসিএস (পররাষ্ট্র ক্যাডার) ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা আসাদ আলম সিয়াম। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অভিজ্ঞ এ কূটনীতিকের সামনে রয়েছে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি জটিল চ্যালেঞ্জ। তার পূর্বসূরি জসীম উদ্দিনের অপ্রত্যাশিত প্রস্থান, মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এবং বৈদেশিক নীতি বাস্তবায়নে দিকনির্দেশনার ঘাটতির কারণে নতুন সচিবের দায়িত্ব পালন এক কঠিন পরীক্ষা হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র কালবেলাকে জানিয়েছে, মূলত তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে নতুন পররাষ্ট্র সচিবকে তার মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে এবং বিশ্বে বাংলাদেশের কূটনৈতিক উপস্থিতি জোরদার করতে হবে।

মন্ত্রণালয়ের কার্যকারিতা ফিরিয়ে আনা: পররাষ্ট্র সচিবের পদটি বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি বাস্তবায়নের প্রধান নির্বাহী হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে গত বছর দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ভূমিকা ক্ষুণ্ন হয়েছে। সরকারের অভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন নেতিবাচক প্রচার এবং কূটনৈতিক সেবায় শৃঙ্খলার অভাব এ পদের গুরুত্বকে ম্লান করেছে। ফলে আসাদ আলম সিয়ামকে মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করতে হবে। কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে চলমান নেতিবাচক প্রচার বন্ধ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা আনা এবং কূটনীতিকদের মনোবল বৃদ্ধির জন্য তার সাহসী নেতৃত্ব প্রয়োজন হবে।

মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে না আনতে পারলে বৈদেশিক নীতি বাস্তবায়নে স্থবিরতা অব্যাহত থাকবে, যা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আরও দুর্বল করতে পারে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সচিবদের তুলনায় পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব আন্তর্জাতিক নীতি বাস্তবায়নের প্রধান নির্বাহী হিসেবে অনন্য। কিন্তু সম্প্রতি সরকারের কিছু অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া যেমন সরকারপ্রধানের সফরগুলোর ক্ষেত্রে এবং রাখাইন ইস্যুতে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা, কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচার এবং পররাষ্ট্র সেবার মধ্যে ধারাবাহিক নেতৃত্বের অভাবের ফলে এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয়তা এখন আর আগের মতো নেই। তাই নতুন সচিবের জন্য এটি একটি বড় প্রশাসনিক ও পেশাদার চ্যালেঞ্জ হবে, যাতে মন্ত্রণালয়ের মর্যাদা ও কার্যকারিতা আবার ফিরিয়ে আনা যায়।

বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোর সক্ষমতা জোরদার: দেশে গত বছরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলোর কার্যক্রম সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সেখানে নেতৃত্বের ঘাটতি রয়েছে। বহুপক্ষীয়, আঞ্চলিক এবং দ্বিপক্ষীয় কূটনীতিতে জটিল কৌশল প্রয়োগে সক্ষমতার ঘাটতি এরই মধ্যে দৃশ্যমান। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর একযোগে মিশনগুলোর কূটনীতিকদের মধ্যে পরিবর্তন আনা হয়। রাষ্ট্রদূত এবং উপরাষ্ট্রদূতদের রদবদল হয় সবচেয়ে বেশি; কিন্তু পরিবর্তন করে নতুন যাদের পাঠানো হয়েছে, তাদের মধ্যে মনোবলের ঘাটতি রয়েছে। মূলত কূটনীতিকদের মনোবলে এ ঘাটতিই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতাকে সীমিত করছে। নতুন সচিবকে দূতাবাসগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ দেশ ও জাতিসংঘ ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্ক গঠনে স্পষ্ট নীতি প্রণয়ন এবং বৈদেশিক নীতির লক্ষ্য নির্ধারণে তাকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। দূতাবাসগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি না পেলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের প্রভাব ও কার্যকারিতা কমে যাবে।

সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের লন্ডন সফরে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে তার বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও স্টারমার সময় দেননি। ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব জানিয়েছেন, এর দায়ও কূটনৈতিক প্রস্তুতির ওপর বর্তায়।

এ নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা অনেকটাই পাল্টেছে; কিন্তু বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলো এখনো সেই পরিবর্তিত বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি। জটিল কূটনৈতিক কর্মকৌশল বাস্তবায়নে দুর্বলতা, বহুপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় ফোরামে স্পষ্ট নীতির অভাব এবং অনেক কূটনীতিকের মধ্যে মনোবলের ঘাটতি—এসব মিলিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামগ্রিক সক্ষমতা সীমিত হয়ে আছে। নতুন বাস্তবতায় বিদেশি রাষ্ট্র এবং জাতিসংঘসহ গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক কীভাবে গড়ে তোলা উচিত, তা অনেকের কাছেই এখনো পরিষ্কার নয়, কারণ পর্যাপ্ত নির্দেশনা নেই। কর্মপরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে যে কীভাবে দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা যায়। এ ছাড়া রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও এ সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে।

কার্যকর টিম গঠন ও বাইরের হস্তক্ষেপ মোকাবিলা: বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরসহ সরকারের অন্যান্য সংস্থায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবস্থান খাটো হয়েছে এবং দূরত্ব বাড়ছে। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও অনেকটাই বিভাজিত হয়ে পড়েছেন। রাজনৈতিক মতাদর্শসহ সিনিয়র-জুনিয়র—সব মিলিয়েই আলাদা আলাদা বিভাজিত টিম, ফলে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মতবিরোধ দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া বড় প্রতিবন্ধকতা হলো ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক। গত আগস্টের পর নয়াদিল্লির সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে এবং অন্যদিকে চীনের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পর্ক গভীর হচ্ছে। অন্যদিকে, ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর নীতি—সব মিলিয়ে বহির্বিশ্বের হস্তক্ষেপ মোকাবিলা এখন বড় চ্যালেঞ্জ। আসাদ আলম সিয়াম একজন অভিজ্ঞ ও দক্ষ কূটনীতিক হলেও, তার সাফল্য নির্ভর করবে মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরে ও বিদেশে একটি সুসংহত এবং সক্ষম টিম গঠনের ওপর। তার পূর্বসূরি জসীম উদ্দিনের টিম গঠনের প্রচেষ্টা পেশাগত ও ব্যক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং বাইরের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে ব্যর্থ হয়েছিল। তাই নতুন সচিবকে মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা দূর করে একটি ঐক্যবদ্ধ টিম গঠন করতে হবে। বাইরের হস্তক্ষেপ রোধ করা এবং প্রশাসনিক ও কূটনৈতিক কার্যক্রমে সহযোগীদের সমর্থন নিশ্চিত করা তার জন্য একটি কঠিন কাজ।

এ বিষয়ে ওই কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, যদিও নতুন পররাষ্ট্র সচিব একজন অভিজ্ঞ ও দক্ষ কূটনীতিক, তবু তার প্রশাসনিক ও কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড সফলভাবে সম্পাদনের জন্য তাকে একটি বিশ্বস্ত ও নিবেদিতপ্রাণ সহযোগী টিম গড়ে তুলতে হবে—দেশের ভেতরে ও বাইরে উভয় জায়গাতেই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তার পূর্বসূরির টিম গঠনের চেষ্টাগুলো ভেস্তে গেছে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং বাইরে থেকে অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে। ফলে বর্তমানে পররাষ্ট্র ক্যাডারদের সুশৃঙ্খল করা যেন এক বিশাল দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

২১ দিনের রিমান্ড শেষে সাবেক এমপি জাফর কারাগারে 

‘দম’-এ একসঙ্গে আফরান নিশো ও চঞ্চল চৌধুরী

ভয়ংকর আকাশ প্রতিরক্ষা দিল চীন / ইরানের ৩০০ কিলোমিটারের মধ্যে আসতে পারবে না ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান

যমুনা ও সচিবালয়সহ আশপাশের এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ

দিনে স্কুলশিক্ষক, রাতে ভয়ংকর ডাকাত

উখিয়ায় ইউপি সদস্যের গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার

চার বিভাগে অতিবৃষ্টি ও সাত জেলায় ঝড়ের শঙ্কা

মালয়েশিয়ায় সন্ত্রাসবাদে জড়িত ৪ প্রবাসী রিমান্ডে 

শান্তিতে নোবেল পুরস্কার / ট্রাম্পকে পাকিস্তানের মনোনয়ন নিয়ে হোয়াইট হাউসের প্রতিক্রিয়া

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে এসি বিস্ফোরণ, আতঙ্ক

১০

আবরার ফাহাদের দেখানো পথে এনসিপি রাজনীতি করছে : নাহিদ

১১

দুষ্কৃতকারিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার আহ্বানে প্রশাসন নির্বিকার : রিজভী

১২

চট্টগ্রামে দুজনের শরীরে জিকা ভাইরাস শনাক্ত

১৩

‘আসছি, আসছি বলে সাগরে তলিয়ে গেল তিন বন্ধু’

১৪

নেত্রকোনায় গীতবিতান গ্রন্থের আবৃত্তির ব্যতিক্রম আয়োজন

১৫

মার্কিন আলোচনার দাবি প্রত্যাখ্যান ইরানের

১৬

‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’-এর নির্মাতা-শিল্পীদের বিরুদ্ধে আইনি নোটিশ

১৭

বর্ণাঢ্য আয়োজনে ডিএসইসির ফ্যামিলি ডে অনুষ্ঠিত

১৮

এবার সুযোগ পাচ্ছে না গত তিন নির্বাচনকে বৈধ বলা পর্যবেক্ষকরা

১৯

এসএসসির ফল প্রকাশের সময় ঘোষণা

২০
X