রাজধানীর তেজগাঁওয়ের হোলি রোজারি চার্চ এবং এর মূল ফটকের সামনে সাধারণত রাত সাড়ে নয়টার পর থেকেই কমতে থাকে লোক সমাগম। আর হামলার জন্য ঠিক এই সময়টাকেই বেছে নেয় দুষ্কৃতিকারীরা। তবে হামলার বেশ কিছুক্ষণ আগে থেকেই চার্চটির সামনে অবস্থান করছিল তারা। গত বুধবার রাত দশটা এক মিনিটের দিকে এই চার্চ লক্ষ করে ককটেল হামলা চালিয়ে দুটি মোটর সাইকেলে করে পালিয়ে যায় কয়েকজন যুবক। তারা সেখানে একাধিক ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। প্রাথমিকভাবে এতে হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি, তবে এ সময় ওই এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় চারদিক। আতঙ্কে দিকবিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে মানুষ।
ককটেল হামলার এই ঘটনার পর থেকেই হোলি রোজারি চার্চ এলাকায় পুলিশ অস্থায়ীভাবে বাড়তি নিরাপত্তা দিচ্ছে। তবে চার্চ সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা, নিরাপত্তাকর্মী ও চার্চের দায়িত্বশীলদের মধ্যে আতঙ্ক রয়ে গেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ঘটনাস্থল ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে হলি রোজারি চার্চের সামনে ককটেল হামলার প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ খ্রিস্টান এসোসিয়েশন। সংগঠনটি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, উপাসনালয়ের মতো স্থানে হামলা অনাকাংখিত এবং অনভিপ্রেত, যা বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার পরিপন্থি।
হোলি রোজারি চার্চের এই হামলাকে পরিকল্পিত বলে ধারণা চার্চ কর্তৃপক্ষের। চার্চটির ফাদার জয়ন্ত এস. গোমেজ গতকাল কালবেলাকে বলেন, ‘এটি একটি পরিকল্পিত ঘটনা। গত (বুধবার) রাতে চার্চের গেটে দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তা কর্মী আমাদের জানিয়েছে, যারা ককটেল নিক্ষেপ করে পালিয়ে গেছে, তারা অন্তত পনের মিনিট গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। যখন লোকজন চলাচল করছিল, রিকশা যাচ্ছিল তখন তারা ককটেল নিক্ষেপ করেনি। যখন লোকজম কমে গেছে তখন ককটেল নিক্ষেপ করে তারা পালিয়ে যায়।’
ঘটনাটি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশ বাদী হয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সংশ্লিষ্ট তেজগাঁও থানায় মামলা করেছে। তেজগাঁও থানার ওসি মোবারক হোসেন বলেন, ‘এই ঘটনায় সন্ত্রাস দমন আইনে একটি মামলা হয়েছে আমাদর থানায়। মামলাটি তদন্ত করার জন্য একজন নিয়মিত তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে আরও দুজন কর্মকর্তাকে দেওয়া হয়েছে। তারা কাজ করছেন। আশা করি দ্রুতই অপরাধীরা শনাক্ত হবে।’
চার্চের সামনেই চা-সিগারেটের দোকান রয়েছে এবং ককটেল হামলার সময় সেখানে ছিলেন এমন একজনের সঙ্গে কথা হয় কালবেলার। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘বিকট একটা শব্দ শুনে গেটের দিকে তাকিয়ে দেখি চারদিকে ধোঁয়া আর ধোঁয়া। ধোঁয়ায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখি ককটেল মারছে। লোকজন কম থাকলেও সবার মাঝে বেশ আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিল। আমিও ভয় পাইছিলাম। ছেলেগুলা ককটেল মাইরাই পালায়া গেছে। ওদের নিশানা ছিল ভেতরে মারবে, কিন্তু চলন্ত বাইকে থাকায় ককটেল ভেতরে না পইরা গেটের বাঁ পাশে (প্রবেশপথ) লাইগা ফুইটা গেছে।’
কথা বলতে বলতেই তিনি হাত উঁচিয়ে দেখালেন, ‘ওইযে যেখানে ককটেল লেগে বিস্ফোরণ হয়েছে সেখানে বড় কালো দাগ হয়ে আছে।’ গেটের একেবারে সামনেই গির্জায় প্রার্থনার অনুষঙ্গ বিক্রি করেন এক নারী। তিনি বলেন, ‘৩৫ বছর ধরে এখানে আছি। কোনোদিন এমন ঘটনা দেখিনি। গত (বুধবার) রাতের পর থেকে বেশ ভয়ে আছি। না জানি কখন কী হয়। রাত বেশি হলে এই এলাকাটি ফাঁকা হয়ে যায়। তখন দুষ্ট ছেলেপেলেদের আনাগোনা বাড়ে। তার ওপর আবার এই ঘটনা (ককটেল হামলা)। আমরা চাই, চার্চ ঘিরে বিশেষ পুলিশি নিরাপত্তা দেওয়া হোক।’
ককটেল হামলার খবর পেয়ে দ্রুততম সময়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এতে আতঙ্কিত লোকজনের ভীতি কমে। রাতে ঘটনার পরপরই পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের আলাদা আলাদা দল যায় সেখানে। মিস্টির প্যাকেটে থাকা অবিস্ফোরিত দুটি তাজা ককটেল উদ্ধার করে রাত ১২টা আট মিনিটে। উদ্ধার করা ককটেল দুটো সেখানেই নিস্ক্রিয় করেন বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা। থানা-পুলিশের সঙ্গে ঘটনাটির ছায়া তদন্ত করছে ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) তেজগাঁও বিভাগ এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
তদন্তে অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার ইবনে মিজান বলেন, ‘ঘটনাস্থল ও আশপাশের সিসিক্যামেরার ফুটেজ দেখে জড়িতদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। ডিবি ও সিআইডিও ছায়া তদন্ত করছে। শিগগিরই অপরাধীরা আইনের আওতায় আসবে।’
নিন্দা বাংলাদেশ খ্রিস্টান এসোসিয়েশনের : হলি রোজারি চার্চে হামলার প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ খ্রিস্টান এসোসিয়েশন। এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নির্মল রোজারিও ও মহাসচিব হেমন্ত আই কোড়াইয়া গতকাল এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, ‘উপাসনালয় ও তার প্রাঙ্গণ একটি পবিত্র স্থান, যেখানে সৃষ্টিকর্তার আরাধনা করা হয়। সেই পবিত্র স্থানে হামলা অনাকাংখিত এবং অনভিপ্রেত, যা বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার পরিপন্থি। এ ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তদন্তপূর্বক তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা জরুরি।’ নেতৃবৃন্দ তাদের বিবৃতিতে তেজগাঁও চার্চের নিরাপত্তা জোরদার করার পাশাপাশি দেশের সব চার্চ, চার্চ প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করারও দাবি জানিয়েছেন।
মন্তব্য করুন