বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত ১৪ সেপ্টেম্বর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আলু ৩৫-৩৬ টাকা, দেশি পেঁয়াজ ৬৫ ও প্রতি পিস ডিম ১২ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। এরপর ১৮ দিন চলে গেলেও এখন পর্যন্ত সেই দামে এসব পণ্য কিনতে পারছেন না ভোক্তারা। এ সময় বাজার তদারকিতে নেমে সারা দেশের ১ হাজার ১৭১টি খুচরা পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানকে ৪৯ লাখ ৯৪ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। জরিমানা হলেও পরবর্তী সময়ে পাল্টা তদারকি না হওয়ায় অভিযানের পরপরই বেশি দামেই বিক্রি হচ্ছে নিত্যপণ্য। লোকবল সংকটের কারণে সব জায়গায় ঠিকমতো তদারকি করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান। অন্যদিকে বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, গোড়ায় তদারকি না করে মাথায় তদারকির কারণে নির্ধারিত দর কার্যকর হচ্ছে না। ভোক্তা অধিদপ্তরের যে লোকবল আছে, তা দিয়ে মূল দায়ী প্রতিষ্ঠানে তদারকি করলে সুফল ভালো পাওয়া যাবে। তবে খুচরা পর্যায়ের তদারকিকেও মন্দের ভালো হিসেবে দেখেন অনেকে।
বাজার তদারকিতে বড় ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে ভোক্তা অধিদপ্তর সমীহ করছে বলে দাবি করা হচ্ছে। সংস্থাটি খুচরা পর্যায়ে অভিযান চালালেও সংশ্লিষ্ট খাতের বড় ব্যবসায়ী এবং সমিতির সঙ্গে মতবিনিময় ও পরামর্শ সভা করছে, যার কোনো সুফল বাস্তবে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে জেলা পর্যায়ে কয়েকটি হিমাগারে সরেজমিন পর্যবেক্ষণে গিয়ে সরকার নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি করতে বাধ্য করে ভোক্তা অধিদপ্তর।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা, দেশি পেঁয়াজের কেজি ৯০ টাকা এবং আমদানি ৭৫ টাকা, ডিমের হালি ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সরকারি-বেসরকারি হিসাবে দেশে দৈনিক আলুর চাহিদা ২৫ হাজার টন, পেঁয়াজের চাহিদা ৭ হাজার টন এবং ডিমের চাহিদা ৪ কোটির বেশি।
আলু: গত ১৮ দিনে আলুর পাইকারি ব্যবসায়ীরা ২৭ টাকার পরিবর্তে ৩৮ টাকা দরে বিক্রি করছেন। এতে নির্ধারিত দামের থেকে কেজিতে লাভ করছেন ১১ টাকা। ফলে দৈনিক চাহিদার হিসাবে আলুর মজুদদারিদের লাভ হচ্ছে ২৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা, যা ১৮ দিনে দাঁড়িয়েছে ৪৯৫ কোটি টাকা। খুচরা পর্যায়ে ৩৬ টাকা বিক্রি হওয়ার নির্দেশনা থাকলেও বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। এতে কেজিতে ১৪ টাকা অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে ভোক্তাদের, যা দৈনিক চাহিদার হিসাবে ৩৫ কোটি টাকা এবং গত ১৮ দিনে ৬৩০ কোটি টাকা।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছর কৃষি থেকে হিমাগারে মজুদদার পর্যন্ত প্রতি কেজি আলুতে খরচ পড়েছে ১৭ টাকা। অপরদিকে খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, সংরক্ষণ খরচসহ প্রতি কেজি আলুর খরচ পড়েছে ২০ টাকা পর্যন্ত।
পেঁয়াজ: দেশি ও আমদানি করা পেঁয়াজের কেজি পাইকারিতে গড়ে ৫২ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি হচ্ছে, যা খুচরা পর্যায়ে গড়ে ৮২ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি হচ্ছে। এ হিসাবে খুচরা পর্যায়ে সরকার নির্ধারিত দামের থেকে কেজিতে লাভ হচ্ছে ১৭ টাকা ৫০ পয়সা। দৈনিক চাহিদার হিসাবে লাভ হচ্ছে ১২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ১৮ দিনে লাভ হয়েছে ২২০ কোটি ৫০ লাখ টাকা, যা সাধারণ ভোক্তাদের কাছ থেকে নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ডিম: ফার্মের ডিমের দাম পাইকারিতে ১০ টাকা ৪০ থেকে ১০ টাকা ৯০ পয়সায় বিক্রি হচ্ছে প্রতি পিস ডিম, যা খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ১২ টাকা করে। দৈনিক চাহিদার হিসাবে খুচরা পর্যায়ে ভোক্তাদের ডিম কিনতে ২ কোটি টাকা বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে, যা গত ১৮ দিনে ৩৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
ভোক্তা অধিদপ্তর জানিয়েছে, দেশের ১৭ কোটি জনগণের জন্য ভোক্তা অধিদপ্তরের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী মিলিয়ে ২১৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। এর মধ্যে ৮৫ জন কর্মকর্তারা সারা দেশে
৪৫-৪৫টি টিমে অভিযান পরিচালনা করছে, যা কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়। এখন পর্যন্ত ১৭টি জেলায় অধিদপ্তরের কোনো কর্মকর্তা নেই।
বাজার তদারকির বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান কালবেলাকে বলেন, গোড়া কেটে মাথায় পানি ঢাললে হবে না। যেখানে সমস্যা সেখানে আগে যেতে হবে। এটা সত্য ভোক্তা অধিদপ্তরের লোকবল কম রয়েছে। তবে যে লোকবল তা দিয়ে গোড়ায় অভিযান চালালে ভালো ফল পাওয়া সম্ভব। সেজন্য আগেও বলেছি এখন বলছি, কার্যকরী পদক্ষেপ বা ফল পেতে হলে মূলে যেতে হবে। সেখান থেকে সমস্যা সমাধান হলে ওপরের সমস্যা সহজে সমাধান হয়ে যাবে।
অপরদিকে পর্যাপ্ত উৎপাদন, মজুদ ও সরবরাহ থাকার পরও নির্ধারিত দামে নিত্যপণ্য কিনতে পারছেন না ভোক্তারা। নির্ধারিত দামে লোকসানের সম্ভাবনা না থকালেও ব্যবসায়ীরা তা বাস্তবায়ন না করে অধিক মুনাফায় পণ্য বিক্রি করছে। এ ধরনের মুনাফা দুর্নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত কি না, জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, সমস্যার গভীরে না গিয়ে শুধুমাত্র মূল্য নির্ধারণ যে বাজার সমস্যার সমাধান নয়, বরং চূড়ান্ত বিবেচনায় অধিকতর মুনাফার উপায় তা ব্যবসায়ীরাও জানেন, ব্যবসাবান্ধব সরকারও জানে। বেপরোয়া ও একচ্ছত্র মুনাফাচালিত বাজার ব্যবস্থায় অনৈতিক ও অযাচিতভাবে বাজারের
রুই-কাতলারা যেখানে অতি মুনাফার মহোৎসবকে স্বাভাবিকতায় পরিণত করেছেন, সেখানে চুনোপুঁটি বিক্রেতারা টিকে থাকার জন্যই হোক, আর অনৈতিকতার রোলমডেল অনুসরণের প্রেরণায়ই হোক সাধারণ জনগণের জিম্মিদশাকে প্রাতিষ্ঠানিকতায় রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় যুক্ত হবেন, এটাই তো বাস্তবতা।