পড়াশোনা শেষ করে চাকরি নিয়ে বিদেশেই থিতু হওয়া যে কোনো প্রবাসীর ক্ষেত্রে দেশের প্রতি টানটা অন্যরকম। ফেলে যাওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা বন্ধুদের সান্নিধ্যে যেতে সবসময়ই মনপ্রাণ ব্যাকুল থাকে। থাকে পরিবারের সঙ্গে মহামিলনের অপেক্ষা; কিন্তু এসবের কোনো একটি সুন্দর মুহূর্ত বা অভিজ্ঞতায় যদি মৃত্যু যন্ত্রণা স্পর্শ করে, তবে সেই বেড়ানো আর ভালোলাগা চিরদিনের মতো রূপ নেয় আতঙ্কে। স্মৃতিকাতর না হয়ে সারাটা জীবন সেই ট্রমার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
তাদেরই একজন আবরার ফারদিন। মাত্র কয়েকদিন আগেই দেশে বেড়াতে এসেছিলেন চীন প্রবাসী এই সফটওয়ার প্রকৌশলী। বৃহস্পতিবার রাতে বন্ধুদের নিয়ে খেতে গিয়েছিলেন বেইলি রোডে। সেখানেই আগুনের বিভীষিকার মুখোমুখি হন। চোখের সামনে মৃত্যু দেখে বাবা-মা এবং আত্মীয়স্বজনদের ফোন দিয়ে বলেন, ‘আর বাঁচব না।’ একসময় নিজেকে জীবিত আবিষ্কার করেন হাসপাতালের বিছানায়।
শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটটে চিকিৎসাধীন ফারদিন বর্ণনা দেন সেই বিভীষিকাময় মুহূর্তের। ওইদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় অসুস্থ দাদাকে রক্ত দিয়ে বাসায় যাচ্ছিলাম। তখন ফোন দিই দুই বন্ধু মেহেদী হাসান ও উম্মে হাবিবা সুমাইয়াকে। ওরা সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী। ওদেরকে ফোন দিয়ে বলি যে, আমি দেশে এসেছি। তারপর বাসায় যাওয়ার আগে ওদের সঙ্গে দেখা করতে যাই। রক্ত দেওয়ার কারণে শরীর একটু ক্লান্ত লাগছিল। তাই আমরা তিনজন বেইলি রোডের ওই ভবনের তিন তলায় খানাস রেস্টুরেন্টে খেতে যাই। যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই রেস্টুরেন্টে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়। তখন আমরা উঠে গিয়ে দেখি বাইরে ধোঁয়া। পুরো বিল্ডিং ঘুটঘুটে অন্ধকার। চারদিকে শুধু ধোঁয়ার কারণে চোখ জ্বলছিল এবং নিঃশ্বাস নেওয়া যাচ্ছিল না। তখন আতঙ্কে সিঁড়ি দিয়ে ৫ তলা পর্যন্ত যাওয়ার সময় আমি আমার দুই বন্ধুকে হারিয়ে ফেলি।
তিনি বলেন, যারা ওপরে ছিলেন তারা বারবার চিৎকার করে বলছিলেন ওপরে আসবেন না। ওপরে অনেক আগুন। তখন আমি নিচে নামার পর দুই তলায় একদম আগুনের সামনে গিয়ে পড়ি। আর বন্ধুদের খুঁজে না পাওয়ায় আবার সিঁড়ি বেয়ে ওপরের দিকে উঠছিলাম। অনেক মানুষের দৌড়াদৌড়ির মধ্যে একসময় আমি ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়ে যাই। ধোঁয়ায় এবং আঘাতে আমি অনেকক্ষণ নিচেই পড়েছিলাম। অন্ধকারে অনেকেই আমার ওপর দিয়ে দৌড়ে চলে যাচ্ছিল। আমি কিছুটা শক্তি নিয়ে ছাদে যাই। সেখানে যাওয়ার পর আমি একদম শুয়ে পড়ি। ছাদের ওপর আগে থেকেই থাকা কয়েকজন আমার মাথায় পানি দেয়। এরপর আমার অবস্থা কিছুটা ঠিক হয়। তখন আমি বাসার সবাইকে ফোন দেই। আমার বাবা-মা, মামা-মামি, চাচা সবাইকেই ফোন দিই। তাদের সবাইকে জানাই এখানে কী হচ্ছে। আমি আসলে আমার জীবনের আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। তাই সবাইকে ফোন করে শেষ বিদায় নিয়ে ফেলেছিলাম। ছাদে একটা নামাজ পড়ার জায়গা ছিল। সেখানে তওবা করে জীবনের শেষ হিসেবে নামাজ পড়েছিলাম। ছাদে তখন ৫০-৬০ জনের মতো ছিল। সবাই আতঙ্কে ছিল। আমি আর এক আপু মিলে ছাদে থাকা বিভিন্ন কাগজপত্র নিচে ফেলে দিচ্ছিলাম, যেন ছাদে আগুন না বেড়ে যায়। কারণ আগুন ধীরে ধীরে ছাদের মুখে চলে এসেছিল। আমরা ছিলাম পেছনের দিকে। আর পুরো ছাদ একদম তপ্ত হয়ে গিয়েছিল। আমরা আশপাশের ভবনগুলোর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছিলাম , আমাদের একটু পানি দেন, পানি দেন। চোখ জ্বলছিল আমাদের। তখন ফায়ার সার্ভিসের একটি দল এসে ছাদের দিকে পানি দেয়। তখন আমরা আমাদের শরীরটা একটু ভিজিয়ে নিই।
ফারদিন বলেন, ফায়ার সার্ভিস ছাদের দিকে পানি ছিটানোর পর ছাদের আগুন একটু নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর ফায়ার সার্ভিসের একজন উদ্ধারকর্মী এসে যন্ত্রপাতি দিয়ে একটা দরজা কেটে আমাদের বের করে। এরপর ক্রেন দিয়ে ধীরে ধীরে সবাইকে নামানো হয়। শুরুতে বয়স্ক, নারী এবং বাচ্চাদের নামানো হয়। এরপর আমরা সবাই নামি। নিচে নামার পর আমার তখন সেন্স ছিল না। যখন টের পাই আমি বেঁচে আছি, তখন দেখি আমি হাসপাতালে। আগুন লাগার পর প্রায় ৪ ঘণ্টা আমরা ওই বিভীষিকার মধ্যে ছিলাম। বেঁচে আছি সেটাই এখন অবিশ্বাস্য লাগছে।
হাসপাতালে ফারদিনের পাশের দুই বেডেই চিকিৎসাধীন ওই ঘটনার সময় হারিয়ে যাওয়া দুই বন্ধু মেহেদী হাসান ও উম্মে হাবিবা সুমাইয়া। তারা সবাই ভেবেছিলেন কেউ বোধ হয় বেঁচে নেই; কিন্তু দুর্ভাগ্য কিংবা সৌভাগ্যক্রমে তাদের আবার দেখা হয় হাসপাতালে। মেহেদী হাসান বলেন, ফারদিনকে খুঁজে না পেয়ে আমরা ৩ তলায় পাঞ্জাবির শোরুম ইলিয়নের ওয়াশরুমে গিয়ে ঢুকি। সেখানে পানি থাকার কারণে আমি এবং আমার স্ত্রী সেখানে আশ্রয় নিই। প্রায় ২ ঘণ্টা সেখানে আটকে ছিলাম। বাসায় ভাইয়াকে ফোন দিয়ে ঘটনা জানিয়ে বলেছিলাম আমাদের উদ্ধার করার ব্যবস্থা করো। আমরা ইলিয়নের ওয়াশরুমে আটকে আছি। একপর্যায়ে অপেক্ষা করতে করতে তো জীবনের আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমার ওয়াইফ যেন সেন্সলেস না হয় সেজন্য বারবার তার মাথায় পানি দিচ্ছিলাম। পরে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন আমাদের উদ্ধার করেন। আমাদের যদি মোবাইল ফোনটা কেটে যেত তাহলে আমাদের হয়তো উদ্ধার করাই সম্ভব হতো না। কারণ আমরা ছিলাম একদম পেছনের দিকে। ভাগ্যগুণে বেঁচে গেলাম।
হাসপাতালে কথা হয় পাঠাও ফুড ডেলিভারিম্যান ফরিদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি খানাস রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনতে গিয়ে আগুনে আটকা পড়েন। ফরিদুল বলেন, জীবনে এমন মুহূর্তের সম্মুখীন হইনি। বাঁচব যে সেটা ভাবতেই পারিনি। আমি মারা গেলে হয়তো আমার পরিবারটাই শেষ হয়ে যেত। ওপরওয়ালার দোয়ায় বেঁচে ফিরেছি। কারও জীবনে যেন এমন মুহূর্ত না আসে।