সরকারের আয়েশি ব্যয় বাড়ছে প্রতি বছর। সংকটের বছরেও যেন এ ধরনের ব্যয়ে লাগাম পরানো যাচ্ছে না। বছরব্যাপী বিভিন্ন দাপ্তরিক কর্মকাণ্ড সচল রাখতে যদিও এ ধরনের কিছু ব্যয় সরকারকে করতেই হয়। তবে শঙ্কার কারণ হলো সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এই ব্যয়ের সীমা মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাচ্ছে। সরকারের পরিচালন ব্যয়ের আওতায় আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ‘পণ্য ও সেবা’র ক্রয় খাতে ৪৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করার পরিকল্পনা করছে, যা চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে প্রস্তাবিত ব্যয়ের তুলনায় ২ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা বেশি।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ‘পণ্য ও সেবা’র আওতায় সরকারের ব্যয়ের লক্ষ্য ধরা হয় ৪৪ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এই ব্যয় সামান্য কমিয়ে ৪৩ হাজার ৮৮১ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।
সরকার পরিচালনার সুবিধার্থে বর্তমানে দেশে ৪৪টি মন্ত্রণালয় এবং ২৭টি বিভাগ রয়েছে। তাদের আওতায় রয়েছে আরও শতাধিক দপ্তর, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর। যাদের তত্ত্বাবধানে এই সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবা পরিচালিত হচ্ছে সারা দেশে। এ ছাড়া আছে বেশকিছু স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানও।
জানা গেছে, ‘পণ্য ও সেবা’র ব্যয়ের দুটি ধরন আছে। এর একটি সরবরাহ ও সেবা এবং অন্যটি মেরামত ও সংরক্ষণ। এসব প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন দাপ্তরিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, পানি ও টেলিফোন এবং ইন্টারনেট বিল সরকারকে পরিশোধ করতে হয়। এ ছাড়া দাপ্তরিক কম্পিউটার ও সফটওয়্যার ক্রয়, ফটোকপিয়ার মেশিন ক্রয় ও মেরামত, আসবাবপত্র ক্রয়, কাগজ-কালি, কলম, স্ট্যাপলার, মার্কার, সাইনপেন, প্রশিক্ষণ, বিদেশ ভ্রমণ, সভা-সেমিনার, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাঁদাও প্রদান করতে হয়। একই সঙ্গে বিভিন্ন দপ্তরের ব্যবহৃত গাড়ি ও অন্যান্য সরঞ্জামের পেছনেও নিয়মিত মেরামত ও সংরক্ষণ বাবদ করতে হয় বিরাট খরচ, যা প্রতি বছর বাজেটের মাধ্যমে ওই খাতে সুনির্দিষ্ট ব্যয়ের আকার নির্ধারণ করা হয়।
‘পণ্য ও সেবা’ খাতে গত চার বছরের ব্যয়ের ফর্দ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য এ খাতে ব্যয়ের পরিমাণ নির্ধারিত আছে ৩৮ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শূন্য ৯ শতাংশ।
২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে এই ব্যয়ের লক্ষ্য ধরা হয় ৩৬ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। যদিও সেটি ওই বছরের সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৩৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকায় পুনর্নির্ধারণ করা হয়। ২০২০-২১ অর্থবছর পণ্য ও সেবার ব্যয় ছিল ৩০ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত চার অর্থবছরের ব্যবধানে পণ্য ও সেবা খাতে সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি পেতে যাচ্ছে ৯ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা।
অন্যদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সরবরাহ ও সেবায় ব্যয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ২৮ হাজার ২২৬ কোটি টাকা এবং মেরামত ও সংরক্ষণ খাতে ১০ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা। অথচ দুই বছর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে এই ব্যয়ের লক্ষ্য ছিল যথাক্রমে ২১ হাজার ৭১৪ কোটি এবং ৮ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ সব দিক থেকেই ভারী হচ্ছে ব্যয়ের পাল্লা।
এই ব্যয়কে মোটেও নিয়ন্ত্রণহীন বলতে নারাজ অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তারা দাবি করছেন, প্রতি বছর বাজেটের আকার বাড়ছে। সেইসঙ্গে বাড়ছে দ্রব্যমূল্য ও ব্যবহার্য পণ্য ও সেবার দাম। একই সঙ্গে দাপ্তরিক কর্মকাণ্ডের পরিধিও বাড়ছে। তাই ব্যয়ের আকারও বাড়াতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে প্রায় একই রকম মতামত দেন সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ। তিনি কালবেলাকে বলেন, এতে অস্বাভাবিক কিছু দেখছি না। কারণ, প্রতি বছর বাজেটের আকার, ইনফ্লেশন ও কর্মকাণ্ডের পরিধি সমানতালে বাড়ছে। ফলে সরকারের ‘পণ্য ও সেবা’ ক্রয়ের ফর্দ বড় হবে—এটাই বাস্তবতা।
এক প্রশ্নের জবাবে অবশ্য তিনি বলেন, অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অনেক চাহিদা প্রস্তাব আসবে। সেখানে অর্থ ছাড়ের এখতিয়ার রাখে অর্থ মন্ত্রণালয়। আমি বিশ্বাস করি, অর্থ মন্ত্রণালয় নিশ্চয় এই চাহিদা ও ব্যয়ের যৌক্তিকতা পর্যালোচনা করেই প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেবে, যা তারা করেও আসছে।
আর বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, সরকার পরিচালনা করতে গেলে এই খাতে ব্যয় করতেই হবে। সেখানে প্রতি বছর ব্যয়ও বাড়বে। তবে এই ব্যয় যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা গেলে সরকারের অপচয় কম হয়।