আবিদ রাইহান
প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৮ জুলাই ২০২৫, ০৮:৩৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বসনিয়ার মুসলমানদের সুখ-দুঃখের আখ্যান

বসনিয়ার মুসলমানদের সুখ-দুঃখের আখ্যান

ইউরোপ মহাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে বলকান উপদ্বীপে অবস্থিত একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ বসনিয়া। ১৯৯৫ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত কয়েক বছর বসনিয়ার মুসলমানদের ওপর ঘটে যায় ইতিহাসের ভয়াবহতম গণহত্যা ও গণধর্ষণ। ২০২৫ সালের জুলাই মাসে সে ভয়ংকর কালো অধ্যায়ের ৩০ বছর পূর্তি হলো। পার্শ্ববর্তী খ্রিষ্টান সার্বিয়ান বাহিনীর হাতে প্রায় ১০ হাজার বসনিয়ান মুসলিম গণহত্যার শিকার হন এবং প্রায় ৫০ হাজার মুসলিম নারী গণধর্ষণের শিকার হন। গ্রামে গ্রামে স্থাপন করা হয় অস্থায়ী বিচার মঞ্চ এবং নির্যাতন ক্যাম্প। নির্যাতন ক্যাম্প ছাড়াও ধর্ষণ করা হতো বাসাবাড়িতে ও রাস্তায়। বসনিয়ায় বেশ কয়েকটি গণকবর রয়েছে। এ বছর বেঁচে থাকা মুসলিম নারী-পুরুষরা সেসব কবরে গিয়ে স্মরণ করেছেন নিজ দেশের অতীতের বীভৎস ইতিহাস।

বসনিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক নাম ‘বসনিয়া অ্যান্ড হারজেগোভিনা’। অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের দুটি পৃথক অঞ্চল বসনিয়া ও হারজেগোভিনা নিয়ে তা গঠিত। মুসলিম অধ্যুষিত বসনিয়া একই সঙ্গে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে অবস্থিত। এর পূর্বে সার্বিয়া, দক্ষিণ-পূর্বে মন্টিনিগ্রো, উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমে ক্রোয়েশিয়া অবস্থিত। বসনিয়া প্রায় স্থলবেষ্টিত। তবে অ্যাড্রিয়াটিক সাগরে তার ২০ কিলোমিটার সৈকত আছে। বসনিয়া একটি পর্বতসংকুল দেশ। এর উত্তর-পশ্চিম অংশের ভূমি পাহাড়ি এবং উত্তর-পূর্ব অংশ কিছুটা সমতল। দেশটি ৩ মার্চ ১৯৯২ সালে যুগোস্লোভিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। বসনিয়ার মোট আয়তন ৫১ হাজার ১২৯ বর্গকিলোমিটার। মোট জনসংখ্যা ৩৮ লাখ ২৪ হাজার ৭৮২ জন। জনসংখ্যার ৫০.৭ শতাংশ মুসলিম। ধারণা করা হয়, প্রস্তর যুগে বসনিয়ায় মানববসতি গড়ে উঠেছিল এবং বসনিয়ানরা প্রাচীন বুটমির, কাকাঞ্জ ও ভুচেডল সংস্কৃতির ধারক। রাজনৈতিকভাবে বসনিয়া বিভিন্ন সময়ে বানাতে অব বসনিয়া, কিংডম অব বসনিয়া, উসমানীয় সাম্রাজ্য, অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য ও কিংডম অব যুগোস্লোভিয়ার অধীনে ছিল।

বসনিয়ায় ইসলামের আলো ছড়ায় অনেক আগে। তবে রাজনৈতিকভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা লাভ করে খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে। ১৪৬৩ খ্রিষ্টাব্দে উসমানীয় সুলতানের হাতে ‘কিংডম অব বসনিয়া’-এর পতন হলে অত্র অঞ্চলে ইসলামের যাত্রা শুরু হয়। তবে ঐতিহাসিকরা এ বিষয়ে এক মত যে, বসনিয়ায় জোরপূর্বক ও গণধর্মান্তরের ঘটনা ঘটেনি; বরং বসনিয়ায় মুসলমানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জিত হয়েছে কয়েক শতাব্দীর মুসলিম প্রচেষ্টার ফলে। তুর্কি আলেম ও সুফিরা দীর্ঘদিন বলকান অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে কাজ করে গেছেন। বসনিয়ায় ইসলাম প্রচারকারীরা হানাফি মাজহাব, মাতুরিদি মতবাদ ও সুফি আদর্শে উজ্জীবিত ছিলেন। যার প্রভাব এখনো বলকান অঞ্চলে দেখা যায়। উসমানীয় শাসকরাও বলকান অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে, ইসলামী প্রতিষ্ঠান ও জ্ঞানচর্চায় যথেষ্ট আন্তরিক ছিলেন। তবে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করত।

উসমানীয়দের পর মুসলিম সমাজ কিছুটা অসহায় হয়ে পড়ে। ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে উসমানীয় শাসকরা বসনিয়াকে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হলে বসনিয়ান মুসলিমদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ঘটনার আকস্মিকতার জন্য তারা মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। এ সময় বহু মুসলিম তুর্কি শাসিত অঞ্চলে হিজরত করেন। তবে বেশিরভাগ বসনিয়ান মুসলিম নিজ দেশে থেকে যান। অবশ্য অস্ট্রিয়ান শাসকরাও চাচ্ছিলেন বসনিয়ার মুসলিম সম্প্রদায় দেশত্যাগ না করে এবং ইস্তাম্বুলের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করে। ফলে ১৮৮২ সালেই তারা বসনিয়ায় ‘রাইসুল উলামা’ নিয়োগ দেন এবং পাঁচ বছর পর ‘শরিয়াহ আইন’ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। বসনিয়ান মুসলিমদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৯ সালে শাসকরা ‘ওয়াকফ’ ও ইসলামী শিক্ষা পরিচালনায় স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়।

মুসলিমদের দুঃসময় শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বসনিয়াকে কমিউনিস্ট শাসিত যুগোস্লোভিয়ার সঙ্গে একীভূত করা হলে মুসলিমদের দুঃসময় শুরু হয়। কমিউনিস্ট শাসকরা সব ধরনের ধর্মীয় স্বাধীনতা কেড়ে নেন এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধ করেন। মুসলিমরা আরও বিপন্ন হয়ে ওঠেন, যখন ১৯৯০-এর দশকে সাবেক যুগোস্লোভিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এ সময় ক্ষমতাসীন সার্বদের গণহত্যার শিকার হন বসনিয়ান মুসলিমরা। সার্ব বাহিনী মুসলিম সম্প্রদায়কে থামিয়ে দিতে পরিকল্পিতভাবে মুসলিম নারীদের গণধর্ষণ করে। মুসলিম নিধনের জন্য সার্বপ্রধান গ্রামগুলোয় অসংখ্য নির্যাতন শিবির গড়ে ওঠে। বসনিয়া-হারজেগোভিনা কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ৫০ হাজারের মতো বসনিয়ান নারী গণধর্ষণের শিকার হন। শুধু নির্যাতন শিবিরের নয়, তাদের ধর্ষণ করা হতো বাসায়, রাস্তায় সর্বত্র। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বসনিয়ায় মুসলিম নিধনকে ‘গণহত্যা ও জাতিগত নির্মূল প্রচেষ্টা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। যুদ্ধের সময় সহস্রাধিক মসজিদসহ প্রায় চার হাজার মুসলিম স্থাপনা ধ্বংস করা হয়। মুসলমানদের মসজিদ, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, খানকা ও সমাধিসৌধের প্রায় ৮০ শতাংশ এই সময় ধ্বংস করা হয়। বসনিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলিম হলেও সব ধর্মাবলম্বীরা স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করে থাকেন এবং সামাজিক ও ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখে। ‘দ্য ইসলামিক কমিউনিটি ইন বসনিয়া অ্যান্ড হারজেগোভিনা’ বসনিয়ার রাষ্ট্র স্বীকৃত মুসলিম প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান। উসমানীয় শাসনামল থেকে সংস্থাটি মুসলিমদের ধর্মীয় বিষয়গুলো তত্ত্বাবধান করে। এ ছাড়া দেশটির প্রধান আট শহরে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত আটজন মুফতি আছেন। যারা মুসলিমদের স্থানীয় সমস্যাগুলো সমাধান করেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১৯ জুলাই : আজকের নামাজের সময়সূচি

স্ত্রীকে তালাক দিয়ে ২৫ কেজি দুধ দিয়ে গোসল 

সেনাবাহিনীর হাতে ইয়াবাসহ পুলিশ সদস্য আটক 

ইবি ছাত্রের রহস্যজন্যক মৃত্যুর তদন্তের দাবিতে ছাত্রশিবিরের টর্চ মিছিল

বাঙলা কলেজ শিক্ষার্থী শহীদ সাগরের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

কেশবপুরে ৩১ দফার প্রচারণায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা অমলেন্দু দাস অপু

মাদ্রাসা টিকে আছে বলেই আমাদের ওপর বিভিন্ন ঝড় ঝাপটা আসে : ধর্ম উপদেষ্টা 

ইউনিভার্সিটি ইনোভেশন হাব স্বপ্ন গড়ার সূতিকাগার

রাজবাড়ী জেলা ছাত্র কল্যাণ পরিষদ বাঙলা কলেজ শাখার কমিটি গঠন

১০

গণঅভ্যুত্থান মেহনতি মানুষের কষ্ট লাঘব করেনি : সাইফুল হক 

১১

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সাবেক সাধারণ সম্পাদকের ফেসবুক পোস্ট

১২

মাদকাসক্ত যুবককে পিটিয়ে হত্যা করল মা ও ভাই

১৩

এবার পুলিশের সামনেই চাপাতি দেখিয়ে ছিনতাইয়ের ভিডিও ভাইরাল 

১৪

বৃষ্টির দেখা নেই, আমন চাষে বিপাকে কৃষক

১৫

প্রাথমিকে বৃত্তি পরীক্ষায় কারা সুযোগ পাবে, বাছাই হবে যেভাবে

১৬

হাসপাতালের লিফটের নিচে পড়ে ছিল রোগীর অর্ধগলিত লাশ

১৭

পরিবারের সবাই ইয়াবা বিক্রেতা, অতঃপর…

১৮

নির্বাচন পেছাতে ‘সংস্কার-বিচারের’ নামে এখনো ষড়যন্ত্র চলছে : আমিনুল হক

১৯

ডাকাতের রশির ফাঁদে যুবকের মৃত্যু, আহত ২

২০
X