দেশের পাঠাগারগুলো আজ বিলুপ্তির পথে। যেগুলো টিকে আছে সেগুলোর অবস্থা এখন ভীষণ করুণ ও পাঠকের অভাবে ধুঁকছে। সরকারি অনুদানের তালিকায় থাকা প্রায় ৮০ ভাগ গ্রন্থাগার নামসর্বস্ব ও অস্তিত্বহীন। অথচ এসব পাঠাগারে নিয়মিত যাচ্ছে সরকারি অনুদান, বরাদ্দ হচ্ছে বই। এ দেশের পাঠাগারগুলোর এই অব্যবস্থাপনার অন্তঃসারশূন্য চিত্র এবং সংশ্লিষ্টদের অনিয়ম, দুর্নীতির একটি স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন চিত্র তুলে ধরা হয়েছে গতকাল কালবেলায় প্রকাশিত ‘অস্তিত্বহীন-নামসর্বস্ব পাঠাগার, অর্থ-বই বরাদ্দ বছর বছর’ শীর্ষক প্রতিবেদনে।
রিপোর্টটি সময়োপযোগী, তথ্যবহুল ও প্রাসঙ্গিক। আমাদের জীবনে একসময় গ্রন্থাগার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তৈরি করেছে জ্ঞানচর্চার এক বিরাট পরিসর। গ্রন্থাগার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে নির্ণীত হতো সাংস্কৃতিক মান। তবে গ্রন্থাগারের গৌরব, এমনকি অস্তিত্বও নির্ভর করে সাধারণ পাঠকের গ্রন্থ ব্যবহারের অভ্যাসের ওপর। উপযুক্ত ব্যবহার ছাড়া লাইব্রেরির সার্থকতা নেই। অর্জিত শিক্ষার সাহায্যে সাংস্কৃতিক মানকে উচ্চস্তরে নিয়ে যেতে হলে লাইব্রেরিতে যাওয়া দরকার। উপযুক্ত গ্রন্থ সংগ্রহই হলো বিশ্ববিদ্যালয়। আর এ রকম বিশ্ববিদ্যালয় তথা লাইব্রেরিতে পড়েই জ্ঞানবান হয়েছিলেন বিশ্বের বহু জ্ঞানীগুণী মানুষ।
গ্রন্থাগারের ইতিবাচক ভূমিকার এই ব্যাপক বিস্তৃতি ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব জেনেও একুশ শতকের গোড়া থেকে এর ব্যবহার কমতে থাকে। শিক্ষার এই শক্তিশালী আধার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেন অনেকে। দীর্ঘ সময় ধরে যারা বিভিন্ন জেলা গ্রন্থাগার, পাবলিক লাইব্রেরি বা পাড়ার সাধারণ পাঠাগার ব্যবহার করেছেন, তারা এটা সহজেই উপলব্ধি করতে পেরেছেন। মুক্তির দিশা পেতে আজ আর পাঠাগার মুখো হন না বাড়ির মেয়েরা। পাঠের ক্ষুধা মেটাতে গ্রন্থাগারে আসেন না অসচ্ছল মানুষের দল। এর অন্যতম কারণ হতে পারে স্মার্টফোন। হাতের মুঠোয় ধরা পড়েছে জ্ঞানভান্ডার। হয়েছে ডিজিটাল লাইব্রেরি, ই-বুক ইত্যাদি। অন্যদিকে, বহু লাইব্রেরিতে রয়েছে পত্রপত্রিকা, পুস্তকাদির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব। আবার পুস্তক ‘ডিজিটালাইজেশন’-এর ব্যাপারেও আছে নানা সমস্যা।
কালবেলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের মাধ্যমে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় প্রতি বছর দেশের আনাচকানাচে থাকা বেসরকারি পাঠাগারে আর্থিক অনুদান ও বই সহায়তা দিয়ে থাকে। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের তালিকাভুক্ত দেশের ৬০২টি বেসরকারি গ্রন্থাগার রয়েছে দেশজুড়ে। এসব গ্রন্থাগারে সহায়তার ক্ষেত্রে বরাদ্দের ৫০ ভাগ অর্থ প্রদান করা হয় প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে থাকা ব্যাংক হিসাবে। বাকি ৫০ ভাগ অর্থের বই সহায়তা হিসেবে দেওয়া হয়। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বেসরকারি পাঠাগারের জন্য বরাদ্দ পেয়েছে মোট ১৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর মধ্যে শুধু বই কেনায় বরাদ্দ ছিল ৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা। বাকি টাকা বরাদ্দ বেসরকারি পাঠাগারগুলোর নিজস্ব ব্যাংক হিসাবে অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়েছে। অনুদান দেওয়ার ক্ষেত্রে গ্রন্থাগার বাছাইয়ের সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়মকানুন রয়েছে। তবে সেসবের তোয়াক্কা করা হয়নি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। অনুদান ও গ্রন্থাগার তালিকাভুক্তি করা হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। আমলাদের নামেও রয়েছে বেশ কিছু গ্রন্থাগার।
আমরা মনে করি, বেসরকারি গ্রন্থাগারের সরকারি অনুদান নিয়ে যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে, তা তদন্ত সাপেক্ষে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। পাশাপাশি পাঠাগারগুলো কীভাবে ডিজিটালাইজ করা যায়, সে বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন। ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে পাঠাগারগুলোর আধুনিকায়ন হলে সব শ্রেণির পাঠক আবার পাঠাগারমুখী হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
মন্তব্য করুন