বাজেট হলো সরকারের রাজনৈতিক-গাণিতিক পরিকল্পনা। সরকারের বাজেট ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২০২৪-২৫ রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেট প্রণয়ন ও মুদ্রণ প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। নতুন বছরে বিপুল অর্থনৈতিক চাপ মোকাবিলা করতে হচ্ছে সরকারকে। এবার বাজেটে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নতুন অর্থবছরের বাজেটের আকার হতে পারে ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকার আশপাশে। তবে তা ৮ লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করবে না। এটি বর্তমান ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চলমান বাজেটের তুলনায় ৪ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। টাকার অঙ্কে নতুন অর্থবছরের বাজেট বাড়ছে ৩৫ হাজার ১১৫ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ১৩ শতাংশ। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকের মাধ্যমে এ আকার নির্ধারণ করা হচ্ছে, যদিও বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অব দ্য রুরাল পুওর (ডরপ) একটি জাতীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও), যা পানিসংকটে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে এবং সমস্যাগুলো মোকাবিলায় দরিদ্র, বিশেষ করে মহিলা, শিশু এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করে। এ ছাড়া সংগঠনটি স্থানীয়ভাবে বাজেটের সর্বোচ্চ কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে মাঠপর্যায়ে জনগণকে সম্পৃক্ত করে কাজ করছে।
স্থানীয়ভাবে সঠিক পদ্ধতিতে পানি ও স্যানিটেশন খাতে বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করে পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধির উন্নয়ন সম্ভব। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি সরকারের বর্তমান মেয়াদের প্রথম বাজেট। আমরা জনস্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ বিষয়ে বিভিন্ন গবেষণা ও মাঠপর্যায়ে কাজ করি, বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে, যেখানে পানি ও স্যানিটেশনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এবারের বাজেট টেকসই উন্নয়নের অভীষ্ট অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ হবে, কারণ আগামী ছয় বছরে এসব লক্ষ্য পূরণে বিনিয়োগ দরকার। বাংলাদেশ সফলভাবে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (২০০৫-১৫) বাস্তবায়ন করেছে। পরবর্তীকালে ১৭টি সুনির্দিষ্ট টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৬৯টি লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ৬-এ পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধিসংক্রান্ত লক্ষ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অঙ্গীকারবদ্ধ
বাংলাদেশকে বিনিয়োগ করতে হবে, যার একটি বড় অংশ রাজস্ব আদায় বা উন্নয়ন বাজেট থেকে আসবে। সপ্তম এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা চলমান রয়েছে এবং লক্ষ্য অনুযায়ী এগুলোর বাস্তবায়ন সঠিক গতিতে চলছে। নবম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের শেষ অংশটি দেখা যাবে।
উদাহরণস্বরূপ, এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বাংলাদেশকে সবার জন্য ‘সেফলি ম্যানেজড স্যানিটেশন’ নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফের যৌথ পরিবীক্ষণ কর্মসূচি ২০২২ অনুযায়ী, বাংলাদেশ নিরাপদ ব্যবস্থাকৃত পানির কভারেজে ৫৯.০১ শতাংশ এবং নিরাপদ ব্যবস্থাকৃত স্যানিটেশনে ৩১ শতাংশে আছে। অর্থাৎ এখনো দেশের অর্ধেক অঞ্চল নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার বাইরে। ২০৩০ সালের মধ্যে এই বাকি অঞ্চলগুলোকে নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার আওতায় আনতে আমাদের যথেষ্ট বিনিয়োগ করতে হবে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস (এসভিআরএস) ২০২২-এর তথ্যমতে, নিরাপদ পানি ও নিরাপদ স্যানিটেশন এবং নিরাপদ স্বাস্থ্যবিধির অভাবে বছরে প্রতি লাখে ১৬৭ জন মৃত্যুবরণ করে। সারকথা, আগামী ছয় বছরে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং নবম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ৬ অর্জনে বরাদ্দ বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট যদি সুষম হয় তাহলে বরাদ্দ পর্যাপ্ত হবে। আমাদের বক্তব্য হলো, বাজেটটা হতে হবে ন্যায্যতাভিত্তিক। তাহলেই আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব। একটি বিষয়ে বিতর্ক উঠতে পারে যে, পানি ও স্যানিটেশন খাত ছাড়াও অগ্রাধিকার পাওয়ার মতো খাত যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদি আছে। কিন্তু আমরা বলতে চাই, জনসাধারণের স্বার্থ বিবেচনা করলে পানি ও স্যানিটেশন খাত সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। স্যানিটেশন মানে শুধু পরিষ্কার টয়লেট নয়, বরং এ খাতের সঙ্গে যুক্ত পয়ঃব্যবস্থাপনা, পয়ঃনিষ্কাশন এবং কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। এ টোটাল স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ পানির অনেক গুরুত্ব আছে এবং এ ক্ষেত্রে বরাদ্দ হওয়া উচিত নায্যতাভিত্তিক ও জনবান্ধব। এখানে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত তাদের যারা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে ছিন্নমূল বস্তিবাসী, উপকূল অঞ্চলের জনগোষ্ঠী, হাওর এলাকার জনপদ এবং দুর্গম পাহাড়ের বাসিন্দারা। পানি ও স্যানিটেশন উন্নয়নে তাদের অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট প্রণয়ন দরকার।
বর্তমানে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে একক প্রকল্পভিত্তিক। কিন্তু আমরা চাই বরাদ্দ হোক জনসংখ্যার ভিত্তিতে, তাহলে উন্নয়নের সুফল এদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব। আমাদের উন্নয়ন সংস্থা থেকে আমরা বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়নে দেখেছি অনেক বরাদ্দ দেওয়া থাকলেও তা ব্যবহার হয় না। জেলা পর্যায়ে কিংবা জাতীয় পর্যায়ের কর্তৃপক্ষ যুক্তি দেন, যে বরাদ্দ দেওয়া হলো সেটাই তো ঠিকমতো ব্যবহার হয়নি, তাহলে আর বাড়ানো কেন হবে? তাই বাজেট বাড়ানোর পাশাপাশি বরাদ্দ ব্যয়ের ক্ষমতাও বাড়ানো দরকার। যারা বাজেট ব্যবহারের সঙ্গে জড়িত তাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। যেমন, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে, তাদের চাহিদা জানার জন্য। পানিবিষয়ক আলোচনা করে এলাকাভিত্তিক কতটুকু বরাদ্দ লাগবে তা ঠিক করা যেতে পারে। এসব গুরুত্ব সহকারে না নিলে বাজেট বাড়ালেও লাভ হবে না। বাজেট ব্যবহারে সক্ষমতা থাকতে হবে এবং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে যথাযথভাবে বরাদ্দ ব্যয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে।
আমরা বিভিন্ন কর্মসূচি ও প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হাওর ও উপকূলীয় অঞ্চলে দেখেছি, তৃণমূল পর্যায়ে আলোচনা হচ্ছিল না। যেমন, ইউনিয়ন পরিষদে ১৩টি স্ট্যান্ডিং কমিটি আছে। এদের মধ্যে একটি হচ্ছে পানি এবং হাইজিনবিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটি এবং এটি উপজেলাতেও আছে, জেলা পর্যায়েও আছে। এ কমিটিগুলো নিয়ে যখন ওখানকার মানুষের সঙ্গে আলোচনা করেছি, তখন জেনেছি, তারা যে নিজেদের দাবি উত্থাপন করতে পারে বা প্রয়োজনীয় প্রকল্প খসড়া করে জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে জমা দিতে পারে, এ ধারণাই তাদের ছিল না। গত এক দশকে তারা এ চর্চা ধীরে ধীরে রপ্ত করেছে। তারা নিজেরা বাজেট প্রণয়ন করা শুরু করেছে এবং তাদের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা হচ্ছে। বরাদ্দের অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা পায় অংশগ্রহণমূলক বাজেট প্রণয়ন। এ প্রক্রিয়া চলমান থাকলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাগ্য বদলে যেতে পারে। যারা সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, যারা পানি পাচ্ছে না বা দারিদ্র্যের কারণে টয়লেট স্থাপন করতে পারছে না, জলোচ্ছ্বাসের শিকার হচ্ছে এ মানুষগুলো যখন স্থানীয় পর্যায়ে আলোচনায় অংশ নেবে, তখন বাজেটের গুরুত্ব বুঝবে। এজন্য স্থানীয়ভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পানি-স্যানিটেশন অধিকার বাস্তবায়নে জন অংশগ্রহণমূলক বাজেট আলোচনা বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে। বাজেট প্রণয়নের সময় প্রতিটি ওয়ার্ডে এ সংক্রান্ত আলোচনা চলমান রাখা উচিত, ইউনিয়ন পর্যায়েও যেন চলমান থাকে, কারণ ‘শুনতে হবে তাদের কথা, যাদের কথা হয় না শোনা’।
আমরা মনে করি, আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট হতে হবে ‘পানিবান্ধব’।
লেখক: উপনির্বাহী পরিচালক, ডরপ