মাহমুদুল হাসান
প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:১০ এএম
আপডেট : ১২ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:২৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

৫ বছরের কম বয়সী ২৪% শিশুর মৃত্যুই নিউমোনিয়ায়

বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস আজ
৫ বছরের কম বয়সী ২৪% শিশুর মৃত্যুই নিউমোনিয়ায়

ব্যাংক কর্মকর্তা দুর্জয় ঘোষ তার প্রথম পুত্রসন্তানের জন্মের পর স্বাভাবিকভাবেই বেশ পুলকিত হয়েছিলেন। কিন্তু জন্মের কিছুদিন পরই শিশুটির প্রচণ্ড জ্বর আর খিঁচুনি শুরু হয়। শিশুটিকে নিয়ে প্রথমে মুন্সীগঞ্জের স্থানীয় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন দুর্জয়। পরীক্ষার পর জানা গেল তার সন্তান নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। উন্নত চিকিৎসার জন্য শিশুটিকে ঢাকায় নিয়ে আসেন তিনি। এরপর থেকে এক মাস ধরে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের এনআইসিইউতে শিশুটি চিকিৎসাধীন।

গত রোববার সন্ধ্যায় কথা হয় দুর্জয়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত সন্তান নিয়ে যে কষ্ট, সেটা অবর্ণনীয়। ২৯ দিন ধরে এনআইসিইউতে চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসকরাও চেষ্টা করছেন যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে।

দুর্জয় তার সন্তানের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারলেও সবার ক্ষেত্রে তা হয় না। এই যেমন চাঁদপুরের ১৮ দিনের শিশু ইয়াসমিন। প্রচণ্ড জ্বরে কাহিল শিশুটিকে চাঁদপুর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার পর জানা যায় সে নিউমোনিয়ায় ভুগছে। হাসপাতালে আনার আগেই অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। হাসপাতালে আনার আগেই ইয়াসমিনের অবস্থা একেবারে সংকটাপন্ন অবস্থায় পৌঁছেছে। চিকিৎসকের পরামর্শে গত ৭ নভেম্বর রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে আনার পর অবস্থার আরও অবনতি হলে তাকে নেওয়া হয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে। কিন্তু শিশুটিকে বাঁচানো যায়নি।

নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের ভোগান্তির এমন কাহিনি ছড়িয়ে আছে দেশজুড়ে। গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত অর্ধেকের বেশি শিশুর মৃত্যু হচ্ছে চিকিৎসার আগেই। অথচ নিউমোনিয়া একটি প্রতিকার ও প্রতিরোধযোগ্য রোগ। তার পরও দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর বড় কারণ হয়ে উঠেছে এ রোগটি। এমন প্রেক্ষাপটে আজ মঙ্গলবার বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘প্রতিটি শ্বাস বাঁচায় জীবন, নিউমোনিয়া প্রতিরোধে সক্রিয় হোন।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার গ্রামাঞ্চলে বেশি। কিন্তু জেলা-উপজেলা পর্যায়ে নিউমোনিয়ার সঠিক ব্যবস্থাপনায় এখনো সক্ষমতা নেই। ফলে একদিকে বাড়ছে প্রাণহানি, অন্যদিকে জীবন বাঁচাতে ঢাকামুখী হতে হচ্ছে আক্রান্তদের। তারা আরও বলেন, নিউমোনিয়ায় মৃত্যুর হার কমাতে এ রোগের বড় কারণ বায়ুদূষণ কমাতে হবে। একই সঙ্গে করতে হবে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থাও।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ৯৫ শতাংশ হাসপাতালে নিউমোনিয়া চিকিৎসার সুব্যবস্থাপনা নেই। যে কারণে ফুসফুস সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ৪২ শতাংশকে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেওয়া হয়। অন্য কোনো চিকিৎসাসেবা না থাকায় ৩৪ শতাংশ শিশুকে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দেওয়া হয়। অভিভাবকদের অসচেতনতা এবং সরকারি হাসপাতালে অক্সিজেন মাপার যন্ত্রসহ নানা সংকটে দেশে পাঁচ বছর ধরে মৃত্যুর হার প্রায় একই।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) তথ্যমতে, এখনো প্রতি হাজার নবজাতকের মধ্যে প্রায় ৭ দশমিক ৪ জন শিশু নিউমোনিয়ায় প্রাণ হারাচ্ছে। আক্রান্তদের মারাত্মক নিউমোনিয়ায় ভোগা ৪২ শতাংশের রক্তে অক্সিজেনের ঘাটতি (হাইপক্সেমিয়া) থাকে, যা এ রোগের মৃত্যুহার বেশি হওয়ায় অন্যতম বড় কারণ। এই রোগের ফলে প্রতি বছর প্রায় ৭ লাখ শিশুর মৃত্যু হয়, যা পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে মোট মৃত্যুর ১৪ শতাংশ। প্রতি ঘণ্টায় আনুমানিক দু-তিনটি শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায় এবং বছরে প্রায় ২৪ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়। এটি পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ২৪ শতাংশ মৃত্যুর জন্য দায়ী। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের এ গড় বিশ্বব্যাপী হিসাবের চেয়ে বেশি। কারণ বাংলাদেশের শিশুদের নিউমোনিয়ার কারণগুলো বৈশ্বিক পরিস্থিতি থেকে অনেকটাই আলাদা।

শিশুদের চিকিৎসায় দেশের সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্যকেন্দ্র রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছর এখন পর্যন্ত নানা অসুখ নিয়ে তিন হাজারের বেশি শিশুকে হাসপাতালটিতে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ শতাংশই নিউমোনিয়ার। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে শতাধিক শিশুর।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের পেডিয়াট্রিকস পালমনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কামরুজ্জামান বলেন, বিভাগীয় হাসপাতালে থাকলেও জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে পর্যাপ্ত শিশু বিশেষজ্ঞ নেই। নিউমোনিয়ার রোগীদের হাইফ্লো অক্সিজেন ও সি-প্যাপের দরকার হয়। কিন্তু সে ধরনের ব্যবস্থা সেখানে নেই। ফলে জটিল নিউমোনিয়ার রোগী গেলে ঝুঁকি নিতে চান না সংশ্লিষ্টরা, ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। স্বাভাবিক সময়ে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে প্রতিদিন শত শত শিশু ঠান্ডাজনিত বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আসে। কয়েক বছর ধরে রোগীর হার আরও বেড়েছে। এর মধ্যে বড় অংশই আসে নিউমোনিয়া নিয়ে। ঢাকার বাইরে এখনো সেভাবে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা না হওয়ায় ঢাকায় ছুটতে হয়। ফলে অনেকের চিকিৎসার আগেই মৃত্যু হয়।

আইসিডিডিআরবি’র মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের সহযোগী বিজ্ঞানীয় আহমেদ এহসানুর রহমান বলেন, আমাদের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের অবকাঠামো আগের তুলনায় বাড়লেও মাধ্যমিক স্তরের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে নিউমোনিয়া নিয়ে আসা শিশুর প্রায় ৪২ শতাংশ অক্সিজেন সংকটে ভোগেন। এ জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে অক্সিজেন ব্যবস্থাপনায় জোর দেওয়ার পাশাপাশি শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ানো ও পুষ্টির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

একটি দল ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায় : কফিল উদ্দিন 

চাকসু নির্বাচনে নতুন প্রত্যয়ে ছাত্রদল

বন্দর ব্যবসায়ী নেতারা / মাশুল বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত চট্টগ্রাম বন্দর বন্ধের ষড়যন্ত্রের অংশ

ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি নিয়ে ৬ হাজারের বেশি মতামত পেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়

জুলাইয়ের গাদ্দারদের সব রেকর্ড প্রকাশ করা হবে : মুনতাসির

যে ছয় ফিলিস্তিনি বন্দিকে ছাড়তে রাজি নয় ইসরায়েল

ময়মনসিংহে পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার

ধানের শীষের বিজয় মানেই জনগণের মুক্তি : গয়েশ্বর চন্দ্র রায়

রোমে পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা

বাবর আজমকে নিয়ে ধারাভাষ্যে রমিজ রাজার তির্যক মন্তব্য

১০

‘সঠিক ও মানসম্পন্ন সংবাদ উপস্থাপনে সাংবাদিকদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে’

১১

আন্দরকিল্লা মসজিদ আইকনিক করতে ব্যয় ৩০০ কোটি

১২

মেসির চেয়েও ধনী শুধু দুইজন ক্রীড়াবিদ!

১৩

প্রবাসীর ছেলেকে দাদা-দাদির কবরের পাশে ঠাঁই দিল না চাচারা

১৪

শৈত্যপ্রবাহ নিয়ে আবহাওয়া অফিসের বার্তা

১৫

বিপিএলের জন্য নতুন রূপে প্রস্তুত হচ্ছে রাজশাহী স্টেডিয়াম

১৬

সাংবাদিককে আটক করে পুলিশের মারধর, গায়েব করার হুমকি

১৭

রেড ক্রিসেন্ট থেকে এনসিপি নেতাকে অব্যাহতি

১৮

নাসিরের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে আবারও এনসিএল শিরোপা রংপুরের ঘরে

১৯

কিশোরগঞ্জ থাকবে ঢাকাতেই, ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ

২০
X