সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফার যুগপৎ আন্দোলনকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াই বলে দাবি করে আসছে বিএনপি। এ লড়াইয়ে জয়ী হয়েই আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে চায় দলটি। বিএনপি নেতাদের দাবি, দলীয় সরকার তথা শেখ হাসিনার অধীনে কখনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এজন্য নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের বিকল্প নেই। এই ব্যবস্থায় নির্বাচন হলে মানুষ পছন্দমতো জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারবে। দেশে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। এতে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি বাক-স্বাধীনতাসহ সব ধরনের স্বাধীনতা ফিরে আসবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অনেকেরও এটাই অভিমত।
বিএনপির দাবি, আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের গণতন্ত্র হত্যা করেছে। একযুগেরও বেশি সময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি ১০ দফার ভিত্তিতে গত ৩০ ডিসেম্বর থেকে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে। এরপর ১২ জুলাই থেকে একদফার আন্দোলনে নামে দলটি। এই আন্দোলনে ইতোমধ্যে প্রায় অর্ধশত দল সম্পৃক্ত হয়েছে। একদফার আন্দোলন ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত বিএনপিসহ সমমনা জোট ও দলগুলো ঢাকায় পদযাত্রা, মহাসমাবেশ, ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান, গণমিছিল ও কালো পতাকা গণমিছিলের কর্মসূচি করে। সর্বশেষ তারা গত শনিবার
ঢাকায় গণমিছিল করেছে। একদফার যুগপৎ আন্দোলন এবং আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে আজ শুক্রবার ঢাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করবে দলটি। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির যৌথ উদ্যোগে এ দিন বিকেল ৩টায় নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এতে প্রধান অতিথি থাকবেন।
এদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনের শরিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোট এদিন ঢাকায় পৃথকভাবে বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচি পালন করবে। গণতন্ত্র মঞ্চ বিকেল ৪টায় পল্টন মোড়ে, ১২ দলীয় জোট বিজয়নগর পানির ট্যাঙ্কের সামনে, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট পুরানা পল্টন মোড় সংলগ্ন আলরাজি কমপ্লেক্সের সামনে, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য সকাল ১০টায় পল্টন মোড়ে, গণঅধিকার পরিষদ (নুর) বিকেল সাড়ে ৩টায় পুরানা পল্টনের দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে, গণঅধিকার পরিষদ (রেজা কিবরিয়া) বিকেল ৪টায় পল্টন মোড়ে, এলডিপি বিকেল ৩টায় কারওয়ান বাজারের এফডিসি সংলগ্ন দলীয় কার্যালয়ের সামনে, গণফোরাম (মন্টু) ও বাংলাদেশ পিপলস পার্টি (বিপিপি) যৌথভাবে বিকেল ৪টায় আরামবাগে গণফোরাম চত্বরের সামনে, ‘এনডিএম’ একই সময়ে মালিবাগ মোড়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করবে। এ ছাড়া মোস্তাফিজুর রহমান ইরানের লেবার পার্টি সকাল ১১টায় নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে আলোচনা সভা করবে। এর মধ্য দিয়ে এ দিন প্রায় অর্ধশত রাজনৈতিক দল কর্মসূচি নিয়ে ফের ঢাকার রাজপথে নামবে।
যুগপৎ আন্দোলনের শরিক গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু কালবেলাকে বলেন, আওয়ামী লীগ মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। দেশে গণতন্ত্র নেই, বাক-স্বাধীনতা নেই। তাই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে আমরা বিএনপির সঙ্গে যুগপৎভাবে আন্দোলন করছি। চলমান আন্দোলনেই দাবি আদায় করা হবে বলে জানান তিনি।
এদিকে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস আজ। জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশে গণতন্ত্র সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি ও গণতন্ত্রচর্চা উৎসাহিত করার প্রয়াসে দিবসটি পালিত হয়। ২০০৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর এ দিবসের ঘোষণা দেয় জাতিসংঘ। এরপর থেকেই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের উদ্যোগে প্রতিবছর দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
দিবসটি উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার এক বাণীতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের গণতন্ত্রমনা মানুষকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। একই সঙ্গে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যারা জীবন দিয়েছেন, তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং আহতদের সমবেদনা জানান। বাণীতে তিনি আরও বলেন, সারা বিশ্বে বহু মত-পথের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রতি মানুষের আগ্রহকে ভূলুণ্ঠিত করে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে এখনো একদলীয় দুঃশাসনের কালো ছায়া বিরাজমান। বর্তমানে দেশে নাগরিক স্বাধীনতা, ভোটাধিকার, মানবিক মর্যাদা ও মানবিক সাম্য হরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশে কারও ছায়া দেখলেই আঁতকে উঠতে হয়। নানা কালাকানুনের মাধ্যমে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে হরণ করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কণ্ঠরোধ করা হয়েছে। ভিন্নমতের কারণে অনেকেই গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। দেশের প্রধান বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়াকে মিথ্যা ও সাজানো মামলায় বছরের পর বছর কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। এখনো তিনি পুরোপুরি মুক্ত নন। আমরা বর্তমানে এক ভয়াবহ দুর্দিন অতিক্রম করছি। আসুন, বর্তমান দুঃসময় কাটিয়ে উঠতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে গণতন্ত্রের মুক্তির মাধ্যমে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলি।
এদিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অনেকে মনে করেন, রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসতে হলে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারি কালবেলাকে বলেন, বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। গণতন্ত্রটা আজকে একটা কর্তৃত্ববাদী পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এর থেকে বের হওয়ার জন্য অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অত্যন্ত প্রয়োজন। একই সঙ্গে সুশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলেই প্রকৃতপক্ষে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আবার ফিরে আসবে। তবে রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ক্ষমতাসীন সরকারের ভূমিকা। সরকার যদি গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসার চেষ্টা না করে, তাহলে বাংলাদেশকে সামনে একটি বিপৎসংকুল পথ পাড়ি দিতে হতে পারে, যা কাম্য নয়।
মন্তব্য করুন