ঢাকার রায়েরবাগে ইলেকট্রনিক্সের দোকানে চাকরি করতেন মো. মোবারক হোসেন (৩২)। পরিবারে মা, ভাই, স্ত্রী ও তিন বছর বয়সী ছোট্ট আদিবাকে নিয়ে ছিল সুখের সংসার। সেই সংসারে গত বছরের ১৯ জুলাই নেমে আসে অন্ধকার। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন মেয়ের আবদারে চিপস আনতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান তিনি। অবুঝ শিশু আদিবার বাবার জন্য অপেক্ষায় ও ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে দিন কাটছে মোবারকের বৃদ্ধ মায়ের।
নিহত মোবারক হোসেন কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার পৌরসভার পূর্ব নয়াকান্দি এলাকার মো. আবুল হাশেমের ছেলে।
পরিবার জানায়, বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করার পর মা জামেনা খাতুন ও সাত বছর বয়সী ছোট ভাই মোশারফ হোসেনকে নিয়ে ঢাকায় চলে যান মোবারক হোসেন। সেখানে রায়েরবাগ আপন বাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করেন। একটি ইলেকট্রনিক্সের দোকানে কাজ করে পুরো পরিবার চালাতেন।
গত ১৯ জুলাই শুক্রবার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন জুমার নামাজ শেষে বাসায় শেষে শুয়ে ছিলেন মোবারক। এ সময় তিন বছর বয়সী মেয়ে আদিবা তার কাছে চিপস খাওয়ার বায়না ধরে। মেয়ের আবদার রাখতে বাসার নিচে নামতেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন মোবারক। ছোট ভাই মোশারফ হোসেন ও স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসাপতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
আরও জানা যায়, নানা জটিলতার কারণে মরদেহ কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের বাড়িতে নেওয়া হয় শনিবার রাতে। রোববার জানাজা শেষে তার দাফন করা হয়। নিহত মোবারক হোসেনের স্ত্রী শান্তা (শিউলী বেগম) বলেন, ‘আমাদের বড় মেয়ে আদিবার জন্মের আড়াই বছর আগে মারা যায়। আদিবার বাবা ওকে অনেক বেশি ভালোবাসত। মেয়ে যা চাইত তাই দিত। সেদিনও মেয়ের চিপস খাওয়ার বায়না থামাতে গিয়ে…।’ বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
মোবারকের ভাই মোশারফ হোসেন বলেন, ‘আমার ভাই আমার পরিবারের অভিভাবক ছিলেন। ভাই গুলিতে আহত হওয়ার পর হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেরি হয়েছে পুলিশের ঝামেলার কারণে। চিকিৎসার অভাবে আমার ভাই মারা গেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ভাইয়ের লাশ আনতেও অনেক কষ্ট পোহাতে হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল বলে রায়েরবাগ থানার ক্লিয়ারেন্স ছাড়া লাশ দেওয়া যাবে না। ওখান থেকেও ক্লিয়ারেন্স পাচ্ছিলাম না। পরে শাহবাগ থানার ক্লিয়ারেন্সে শনিবার রাত ১১টার দিকে বড় ভাইয়ের মরদেহ হস্তান্তর করা হয় আমাদের কাছে।’
পরে রায়েরবাগ থানায় মামলা করতে গিয়ে তার ভাইয়ের নামেই মামলা দেখে তারা ফিরে আসেন বলে জানান মোশারফ।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে সাহায্য-সহযোগিতার বিষয়ে মোশাররফ বলেন, ‘আমরা আগে থেকেই সবাই একসঙ্গে থাকতাম। ভাই মারা যাওয়ার পর জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা পেয়েছি। এ ছাড়া সরকারিভাবে সব সুযোগ-সুবিধা আমরা পাচ্ছি। ভাই মারা যাওয়ার পর সবাই বাড়ি চলে গেছে। আমি ঢাকায় নবাবপুর একটি দোকানে চাকরি করি।
সরকার বলেছে, প্রতি মাসে একটা ভাতার ব্যবস্থা করবে।’ তার ভাইয়ের ছোট্ট মেয়ে আদিবার ভবিষ্যতের জন্য যেন কোনো ব্যবস্থা সরকার করে, সেই দাবি জানিয়েছেন তিনি।
নিহতের মা বৃদ্ধা জামেনা খাতুন জানান, ছেলে হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তিনি নিজের চোখে দেখে যেতে চান।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে কিশোরগঞ্জ জেলার অন্যতম সংগঠক আশরাফ আলী সোহান বলেন, ‘সরকারের কাছে চাওয়া ছিল আহত ও গণহত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচার, রাষ্ট্র সংস্কার ও আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন বা আহত হয়েছেন তাদের পরিবারকে পুনর্বাসন করতে হবে। তাদের পরিবার যেন চলতে পারে সে জন্য সরকারকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত অনড় থাকব।’
মন্তব্য করুন